ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানার উপায় কী?

এরশাদুল আলম প্রিন্স | প্রকাশিত: ০৯:২৬ এএম, ১১ মার্চ ২০২৪

রাজধানীতে আবার বেড়েছে কিশোর গ্যাং-এর দৌরাত্ম্য। মাঝে কয়েক বছর এদের উপস্থিতি কিছুটা কম দেখা গেলেও সম্প্রতি আবার তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজধানী থেকে তারা এখন জেলা, উপজেলা এমনকি কোনো কোনো গ্রামেও উৎপাত শুরু করেছে।

উঠতি বয়সী এসব তরুণরা দলবদ্ধ হয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো না কোনো বড় ভাই'র অধীনে তারা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। এলাকা নিয়ন্ত্রণের নামে তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল বা দখলে সহায়তা, উচ্ছেদ ও জবরদখলসহ সব ধরনের অপরাধেই জড়িত।

এছাড়া এলাকার সব ব্যবসা-বাণিজ্য তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। ফুটপাত থেকে চাদাবাজি, দোকান থেকে মাসিক বা সাপ্তাহিক চাদা উঠানো- কোনো কাজেই তারা পিছিয়ে নেই। এছাড়া যৌন হয়রানি, কারণে অকারণে যাকে তাকে মারধর করা-এসবই তাদের রুটিন কাজ। ইন্টারনেট, কেবল টিভি, ময়লা ব্যবসাও তারা নিয়ন্ত্রণ করে। এলাকার রিকশা গ্যারেজ থেকে চাদা আদায় অথবা ফুটপাতের সবজিওয়ালা থেকে চাদা আদায় কোনো কিছুতেই তারা পিছিয়ে নেই।

এসব তরুণ গুণ্ডা দলের বিভিন্ন নাম আছে। সাধারণত বড় ভাইয়ের নামেই এসব কিশোর গুন্ডা বাহিনীগুলো পরিচিতি পায়। নাবিল বাহিনী, গাংচিল বাহিনী, ভাস্কর বাহিনী, কবজি কাটা গ্রুপ, বিরিয়ানি সুমন গ্রুপ, শুটার আনোয়ার গ্রুপ, লও ঠেলা, দে ধাক্কা ও লাড়া দে বাহিনীসহ আরও নানা নামে এরা এলাকায় পরিচিত। এরা এলাকায় মাস্তানি-সন্ত্রাসি করে বেড়ায়। প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই এসব গুন্ডারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়, আশ্রয়ে- প্রশ্রয়ে এলাকায় সন্ত্রাসী করে বেড়ায়।

এলাকার ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের নেতার অধীনে এসব কিশোররা সন্ত্রাসী করে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে এরা সে দলেরই গ্যাং। দলের নেতারা এদেরকে মদদ ও প্রশ্রয় দেয়। দলে নিজের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য লোকবল দরকার। কিশোর গ্যাং হচ্ছে বড় ভাইদের সেই লোকবল যারা নেতার জন্য কাজ করে, নেতার জন্য শ্লোগান দেয়।

সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত ২১ জন কাউন্সিল এসব কিশোরা গ্যাং-দের প্রশ্রয় দেয়। ২০২২ সালে তৈরি ওই প্রতিবেদন বলছে, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৬৬টি ও চট্টগ্রামে ৫৭টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে।

ঢাকার অন্যান্য জেলায় রয়েছে ২৪টি গ্যাং (দৈনিক প্রথম আলো)। বাকিগুলো অন্যান্য জেলায়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও এসব কিশোর গ্যাংরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অপরাধ করলে ক্ষেত্র বিশেষে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু তাদের কথিত বড় ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এরা শেষমেষ বের হয়ে আসে। পুলিশ বলছে, বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৭৮০টি মামলা হয়েছে।

পুলিশের ভাষ্য, ঢাকাতেই এসব কিশোর গ্যাং বেশি। কিন্তু ঢাকার বাইরেও এদের উপস্থিতি ও দৌরাত্ম যে বেড়ে গেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিভিন্ন সময়ে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে যায়। এমন খবর প্রায়শই গণমাধ্যমে আসে। তবে, গত নির্বাচনের পরে যেন এদের দৌরাত্ম্য আরো বেড়েছে। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে এটাই মনে হয়।

এসব কিশোর গ্যাং-এ ১০ থেকে ৫০ জন সদস্য থাকে যাদের বয়স ১০/১২ থেকে শুরু করে ৩০ বছর পর্যন্তও হতে পারে। অপেক্ষাকৃত ছোটোরা দলের প্রাথমিক সদস্য। বয়স বাড়লে দলের বড় দায়িত্ব পায়। ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যতো খুন হয়েছে তার ২৫টিতে কিশোর গ্যাং-এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সংখ্যাটা যথেষ্ট বড়। একটি দেশের রাজধানীতে যতো খুন হয় তার ২৫টিতে যদি কিশোর গ্যাং জড়িত থাকে তবে বুঝতে হবে এরা রাজধানীর মূল অপরাধ জগতের বড় অংশীদার। এদেরকে যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে আগামী দিনে দেশের পুরো অপরাধ জগৎ এরাই নিয়ন্ত্রণ করবে। একটি দেশের কিশোররা যদি এভাবে বেড়ে ওঠে তবে দেশের নাগরিক হিসেবে সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ কী আর দেশের ভবিষ্যতই বা কী?

 

আইন নেই একথা বলার সুযোগ নেই। সমস্যা হলো আইনের প্রয়োগ নিয়ে। শিক্ষায় সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পারিবারিক বন্ধন ও মূল্যবোধহীন সমাজে কিশোররা শেকড়হীন ছন্নছাড়া জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দেশের স্বার্থেই এই আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে।

 

কিশোর গ্যাং-এর এসব সদস্যরা স্কুল-কলেজের ছাত্রী বা তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে। এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছে। শ্লীলতাহানী ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে অনেকে। মেয়েদের বাবা-মা-ভাইরা তাদের সন্তান ও বোনদের নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকে। ঘরে না ফেরা পর্যন্ত তারা অস্থির থাকে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক বাবা-ভাই প্রাণও হারিয়েছেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার জন্য তাদের কোনো বিচার হয় না। এদের কারণে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন।

এসব কথিত বড় ভাইদের মধ্যে অনেকে এলাকার জনপ্রতিনিধি। বিশেষ করে অনেক কাউন্সিলরা কিশোর গ্যাংদের বড় অভিভাবক। এলাকার কিশোরগ্যাংদের সব দায়-দায়িত্ব তারা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। মাস্তানি করে এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও চাদাবাজিসহ নানা অপরাধে তাদের ব্যবহার করা হয়। নির্বাচনে প্রচারণা থেকে শুরু করে কাউন্সিলরদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সব ধরনের কাজেই তারা অংশ নেয়।

এসব কিশোর গ্যাং সৃষ্টি বা কিশোরদের বখে যাওয়ার পেছনে মোটা দাগে দুটি কারণকে চিহ্নিত করা যায়। মূলত পারিবারিক বন্ধন ও শিক্ষার অভাবেই এসব কিশোররা জীবনের প্রথমভাগেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এসব কিশোর গ্যাংদের অধিকাংশ সমাজের নিম্নবিত্ত ও স্বল্পবিত্ত পরিবারের সদস্য। মধ্যবিত্ত পরিবারেরও কিছু কিছু রয়েছে। তবে তারা যে আর্থ-সামাজিক স্তরেরই হোক না কেন, মূলত পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব থেকেই তারা এ পথে আসছে।

দ্বিতীয়ত, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থা ও আইন ও বিচার ব্যবস্থা এসব কিশোরদের গ্যাং হয়ে উঠতে উৎসাহ যোগায়। তারা জানে, অপরাধ করলেও রাজনৈতিক বড় ভাইরা তাদের আশ্রয় দেবে। তারা এটাও জানে যে, তাদের বড় ভাইদের হাত অনেক লম্বা। বড় ভাইদের সঙ্গে থানা-পুলিশেরও রয়েছে দহরম-মহরম। তাই তারা বেপরোয়া। যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। সম্প্রতি এক কিশোরের ইচ্ছা হলো সে হাজাম হবে। খতনা কীভাবে দেয় তা শিখতে কিশোরের কৌতূহলের বলি হয়েছে তিন বছর বয়সী শিহাব শেখ। বিকেলে বাড়ির উঠানে খেলছিল শিহাব। তাকে একা পেয়ে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে যায় কিশোর হামিম শেখ (১৭)। এরপর শিহাবের হাত-পা ও মুখ বেঁধে তাকে খতনা দেওয়ার চেষ্টা করে হামিম। এতে শিশুটির পুরুষাঙ্গ কাটা পড়ে। ব্যথায় শিশু হামিম অচেতন হয়ে পড়ে এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। এসব ঘটনা কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা যোগ করছে।

সমাজে এক সময় ধর্মীয় শিক্ষা ছিল। নীতি, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ ধর্মীয় শিক্ষার মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু এ সমাজ এখন ধর্মীয় শিক্ষা বিমুখ। ফলে, অপরাধ ও অনৈতিক কাজে বাধা দেওয়ার আর কিছু নেই, কেউ নেই। আইন আছে। কিন্তু আইনের পুরোপুরি প্রয়োগ নেই। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থাতেই আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ সম্ভব।

কিশোর অপরাধ চিহ্নিত ও দমনে দেশি আইন আছে, আছে আন্তর্জাতিক আইনও। আন্তর্জাতিক আইন কয়েকটি নৈতিক মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে। ১৯৫০ সালে জাতিসংঘের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কিশোর অপরাধের সংজ্ঞার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ওই অধিবেশনের মূল বক্তব্য ছিল অপ্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত সব অপরাধই কিশোর অপরাধ। কিশোর অপরাধকে সামাজিক ও মনস্ত্বাত্তিকভাবে দেখার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য পৃথক বিচার ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

আইনানুযায়ী ১৮ বছরের আগে কেউ অপরাধ করলে তাকে কিশোর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর ৯ বছরের কম বয়স্ক হলে আইনের দৃষ্টিতে সেটি অপরাধ হিসেবেই দেখা হয় না (ধারা ৮২, দণ্ডবিধি ১৮৬০ সাল)। তবে ৯ থেকে ১২ বছরের কেউ অপরাধ করলে সে যদি সেই কাজের পরিণতি বুঝতে না পারে অর্থাৎ সে যে অপরাধ করেছে তা না বুঝতে পারলে সে অপরাধ করেনি। এখানে ওই কিশোরের মানসিক অবস্থা বা তার অপরাধ প্রবণ মন বা কাজের পরিণতি বোঝার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতার আলোকে এটি যুক্তিসঙ্গতও।

তবে কিশোর গ্যাংদের বড় একটা অংশ এই বয়সের (৯-১২ বছরের)। এছাড়া আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় এ বয়সের অনেক কিশোররা সহজেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবে, মূল কথা হলো, শিশু আইনানুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। কাজেই, দণ্ডবিধি ও শিশু আইনের আলোকে, ১৮ বছরের আগে কেউ অপরাধ করলে তা শিশু বা কিশোর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে ও সে অনুযায়ী তাদের বিচার হবে। দেশে প্রথম শিশু আইন হয়েছিল ১৯২২ (বেঙ্গল চিলড্রেন অ্যাক্ট)। পরে সেটি বাতিল হয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালে এখানে শিশু আইন হয়। সেটি বাতিল হয়। বর্তমান আইনটি ২০১৩ সালের। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল আইনও আছে। এসব আইনানুযায়ী বিচারও হচ্ছে। বিচারাধীন শিশুদের জেল হাজতের পরিবর্তে সেফ হোমে বা সংশোধনাগারে পাঠানোর বিধান আছে।

কাজেই, আইন নেই একথা বলার সুযোগ নেই। সমস্যা হলো আইনের প্রয়োগ নিয়ে। শিক্ষায় সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পারিবারিক বন্ধন ও মূল্যবোধহীন সমাজে কিশোররা শেকড়হীন ছন্নছাড়া জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দেশের স্বার্থেই এই আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে।

লেখক: আইনজীবী, প্রাবন্ধিক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন