বৈশাখী উৎসবে নারীর ড্রেসকোড
দিন পনের আগের কথা, আমি আমার সেঝো বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। বোনের কিশোরী কন্যা দশম শ্রেণিতে পড়ে। আমি যাওয়ার সাথে সাথেই সে এসে হামলে পড়লো। অতি উৎসাহে আলমারি খুলে বের করে আনলো লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ-কাঁচের চুড়ি, মাটির মালা, লাল টিপ। আমি সব বুঝেও জিজ্ঞেস করলাম এসব কি। ভাগ্নী আহ্লাদের সাথে উত্তর করল, এগুলো তার বৈশাখীর সাজ পোশাক। এবারের পয়লা বৈশাখে পড়ার জন্য কেনা হয়েছে। আমি টিপ্পনী কেটে বললাম, গতবারের কথা মনে নেই, এবারতো মেলায়ই যেতে পারবিনা। সে দীপ্ত কণ্ঠে বললো, অবশ্যই যাব। সাথে করে জ্যামিতি বক্সের কাঁটা কম্পাস নিয়ে যাব।
যদিও কিশোরী ভাগ্নীকে মুখে একথা বলেছি কিন্তু মনে মনে চেয়েছি অন্য রকম। আশায় ছিলাম গত বছরের ভিন্নচিত্র দেখব এবারের বৈশাখী উৎসবে। প্রশাসনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো কমতি থাকবে না। গত বছরের নববর্ষবরণ উদযাপনে টিএসসিতে ঘটে যাওয়া বর্বরতার কথা কেউই ভুলে যায়নি। একদল মানুষরুপী হিংস্র হায়েনা তাদের মনুষ্যত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে দিনের আলোয় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নারীর উপর। হাজারো মানুষ এই বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেছে।
যুগ যুগ ধরে এই স্থানটিতে বর্ষবরণের উৎসব পালিত হয়ে আসছে। বৈশাখী উৎসবই শুধু নয়, বাঙালির যে কোনো প্রাণের উৎসব পালনের কেন্দ্রস্থল টিএসসি চত্ত্বর। সেই স্থানেই ঘটেছিল জনসমক্ষে নারীর শ্লীলতাহানির এতবড় ঘটনা। শিশুসন্তানের সামনে তার মাকে অপমানিত করা হয়েছে। স্বামীর সামনে তার স্ত্রীকে করা হয়েছে যৌন নির্যাতন। সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদ করেছে, বিচার চেয়েছে এই ঘৃণ্যতম ঘটনার। কিন্তু কতটুকু বিচার হয়েছে সেই প্রশ্ন বাতুলতামাত্র।
এই নির্লজ্জতার, এই পাশবিকতার বিচারের তেমন কোনো আশা গত তিনশত ষাট দিনেও মেলেনি। আরেক বৈশাখ সমাগত। গত বৎসরে ঘটে যাওয়া ঘটনার সুস্থ বিচার হলে আমার ভাগ্নীকে আজ আর খড়গ হাতে চন্ডির ভূমিকায় নিজেকে কল্পনা করার প্রয়োজন হতো না। টিএসসির ঘটনার সার্থক সাফল্যে আরো অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা জন্ম নিয়েছে এবছর। বাসের ভেতর নারীর শ্লীলতাহানি ঘটেছে। আদীবাসী নারীকে যৌন নিপীড়নের পর মৃতদেহ রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। আর তনুর রক্তের দাগতো এখনো শুকায়ইনি। কলেজপড়ুয়া মেয়েটিকে শারীরিক নির্যাতনের (যা এখন প্রশ্নবিদ্ধ) পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে দেশ। রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে মানবতা। কিন্তু বিচারের বাণী এখনো নীরবেই কাঁদছে।
নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের ঘটনা যখনই ঘটেছে তখনই নির্বিচারে দোষ দেওয়া হয়েছে নারীর পোশাককে। মেপে দেয়া হয়েছে শরীরের কতটুকু অংশ দৃশ্যমান থাকতে পারে। কখনো কারো খোলা পীঠ দায়ী হয়েছে, কখনো দায়ী হয়েছে ক্লিভেজ। শালীন পোশাকের সংজ্ঞা কি সেই-অর্থে জানা নেই। তবে বলা হয়েছে প্রতিটি নির্যাতিতা নারীই অশালীন পোশাকে নিজেকে সমাজের কাছে জাহির করতে অভ্যস্ত ছিলেন। নারী নিজেকে তার ছোটখাট পোশাকের মাধ্যমে প্রভোক করেছে নিজের সর্বনাশের। সোহাগী জাহান তনুর হিজাবও এই দায় থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তনুর পোশাকেও দোষ ছিল, শুধু মাথায় হিজাব করলে কি হবে তনু আসলে আঁটোসাঁটো ড্রেস পরত। গত বছর বৈশাখের ঘটনায়ও নারীর পোশাকের ব্যাপক দোষ ছিল। নারী কেন লো-কাট ব্লাউজে ঘরের বাইরে বের হয়েছিলো। দুষ্টু ছেলের দল এসব দেখে একটু দুষ্টুমিতো করতেই পারে! সবচাইতে ভালো হয় মেয়েরা ঘরে থাকলে। রান্নাবাটিটাই মেয়েদের জন্য সব আনন্দের মূল হবে না কেন বাপু! বৈশাখের দিন মেয়েরা ইলিশ ভাজবে, পান্তার যোগান দেবে, গুড়ের পায়েশটা, চিনির পায়েশটা রান্না করবে। কিসের এত বাবা টই টই করে ঘরবার উৎসব করে বেড়ানো!
বৈশাখে এত এত ফ্যাশন হাউসগুলো কত রঙ বেরঙের কাপড় বানাচ্ছে। নারীর জন্য আলাদা কোনো বৈশাখী পোশাকের কথা কি কারো মাথায় এসেছে। এমন কোনো পোশাক- যা পড়লে পুরুষের কাছে সেটা অশালীন মনে হবে না। যেই পোশাক প্রভোক করবে না নারীকে যৌন নিপীড়নের।
এভাবে অন্ধকার দিয়ে আলোকে ঢেকে রাখা হবে না জানি আরো কত শত যুগ। আমাদের আরো কতদিন সময় লাগবে গত বৈশাখের ঘৃণ্য নারকীয় ঘটনার বিচার পেতে? নারী কোনো লোভনীয় খাদ্যদ্রব্য নয় যে তাকে মোড়কে আচ্ছাদিত করে রাখতে হবে। মানসিকতা বদলাতে পারলে নারীর পোশাককে আর অশালীন মনে হবে না। অপরাধীদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না করে নারীকে শুধু পরতের পর পরত কাপড় পড়ালেই সমস্যার সমাধান হবে না। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সাথে সাথে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প নেই। একটি অপরাধ ধামাচাপা দেয়া মানেই আরেকটি অপরাধ জন্ম নেয়া। আমরা মানুষরা তবুও স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি শংকা বিহীন বর্ষবরণ উৎসব। স্বপ্ন দেখি আর কোনো আদিবাসী নারীর প্রাণ দিতে হবে না তার সম্ভ্রমসহ। যেমন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম তনু হত্যার উপযুক্ত বিচার হবে।
জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে অতি সম্প্রতি সরকারিভাবে ঘোষিত হয়েছে, বর্ষবরণের দিন বিকেল পাঁচটার পর টিএসসি প্রান্তর পরিত্যাগ করতে হবে। ছোটবেলার কথা মনে পড়লো-মুরুব্বিরা ভয় দেখাতেন, রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলে তাই রাস্তায় বেরুনো নিরাপদ নয়। যে কোনো সময় গাড়িচাপা পড়ে মরার সম্ভাবনা থাকে। সমাধান হলো ঘরে বসে থাকো, রাস্তায় যেওনা। নিরাপত্তা নেই তাই পাঁচটার পর ঘরে ফিরে যাও। ড্রেসকোড দিয়ে গৃহবন্দী করে আর কতোকাল নারীর পথচলা থামিয়ে রাখা হবে। এর উত্তর কে দেবে কে জানে!
লেখক : মানবাধিকারকর্মী
এইচআর/এমএস