ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রক্ত স্রোতে ভেসে যাওয়া সেদিনের পিলখানা

এমএম নাজমুল হাসান | প্রকাশিত: ১১:৫৫ এএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

২৫ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত ও বিষাদময় দিন। ২০০৯ সালের এই দিনে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায় শুরু হয় নৃশংস ও হৃদয় বিদারক ঘটনা। আর এর সমাপ্তি ঘটে ৩৬ ঘণ্টার নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। ইতিহাস ঘৃণিত সেই হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিল স্বাধীনতাবিরোধী তথা জামায়াত-বিএনপির ইন্ধনপুষ্ট বিডিআরের কিছু সৈনিক। তাদের নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন বিডিআরে দায়িত্ব পালনরত সামরিক কর্মকর্তারা ও তাদের পরিবারবর্গ। মর্মান্তিক সেই হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা,একজন সৈনিক, দুইজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, নয়জন বিডিআর সদস্য এবং পাঁচজন বেসামরিক লোক নিহত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে একক কোনো ঘটনায় এত সামরিক কর্মকর্তা নিহতের ঘটনা পূর্বে কোথাও ঘটেনি। বিদ্রোহ করা বিডিআর জওয়ানরা জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ না থাকা, রেশন বৈষম্য, ডাল-ভাত কর্মসূচীর অর্থ আত্মসাতের যেসব বিষয় উপস্থাপন করেন তা নিতান্তই ঠুনকো। ক্ষুদ্র এ বিষয় নিয়ে এত বড় হত্যাযজ্ঞ চালানোর কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়না কিংবা বিশ্বাসযোগ্য কথা না। এই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে কাজ করেছে দেশি-বিদেশী চক্রান্তকারী।

জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে দেওয়া দলটি ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৪৭ দিন পরেই ঘটে ইতিহাস নিন্দিত হত্যাকাণ্ড। দেশেকে অস্থিতিশীল করতে দেশি-বিদেশী চক্রান্তগোষ্ঠী পরিকল্পনামাফিক পিলখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) কিছু সদস্যদের ব্যবহার করে সীমান্তরক্ষী বাহিনীটিকে ধ্বংস করে এবং সামরিক বাহিনীকে খেঁপিয়ে তুলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে সদ্য ক্ষমতা গ্রহণ করা সরকারকে হটানোর পরিকল্পনা করা হয়।

সেদিন টিভি চ্যানেলে বিডিআর জওয়ানদের বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচার করে ঢাকার বাহিরের ব্যাটালিয়নের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানো হয়। পিলখানার দরবার হলে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালকসহ ১৬৮ কর্মকর্তার ব্যাপারে দেশীয় কোন গণমাধ্যম কিছু জানাতে না পারলেও বিদেশী গণমাধ্যম ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিডিআর মহাপরিচালকসহ ১৫ সেনা কর্মকর্তার হত্যার খবর প্রচার করতে সক্ষম হন। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের পূর্বের দিন অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের কিছু সদস্য বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সাথে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে বিএনপির সাবেক এই নেতা বিডিআরের সদস্যদের পিলখানার ৫ নম্বর গেটের দিকে এগিয়ে দিয়ে যান। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তরের তিন নম্বর গেটে কিছু যুবক বিডিআর-জনতা ভাই ভাই স্লোগান দিয়ে বিদ্রোহী জওয়ানদের সমর্থনে মিছিল বের করে।

কয়েকজন ডিএডি, এডিএ, জেসিও,নায়েক ও হাবিলদারের নেতৃত্বে পিলখানার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা সম্ভব ছিলনা। এর নেপথ্যে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াত -বিএনপির সরাসরি ইন্ধন না দিলে সম্ভব ছিলনা। পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের পূর্বের দিনে বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সাথে বৈঠকই সেটা প্রতীয়মান হয়। মূলত এটা ছিল সামরিক বাহিনীকে সদ্য ক্ষমতা গ্রহণ করা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করার দেশি-বিদেশী চক্রান্ত।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিজিবির (তৎকালীন বিডিআর) সদর দপ্তর পিলখানায় তিন দিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহ উদ্বোধন করেন সদ্য ক্ষমতা গ্রহণ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি রাইফেলস সপ্তাহ শেষ হওয়ার পূর্বেই ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘটে গেলে বিডিআর জওয়ানদের দ্বারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ঐদিন সকাল নয়টায় পিলখানার দরবার হলে শুরু হয় বার্ষিক দরবার। সরাদেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ দুই হাজার পাঁচশত ৬০ জন সদস্য দ্বারা দরবার হল পরিপূর্ণ। মঞ্চে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা।

তখনকার জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও জনকণ্ঠের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসন্ধানে জানা যায়, জওয়ানদের একটি দল সকাল নয়টার পূর্বেই অস্ত্রাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত মেজরকে জিম্মি করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। এরপর সাড়ে নয়টার দিকে দরবার হলে মহাপরিচালকের বক্তব্যের সময় মঞ্চের বাম দিকের পেছন থেকে অতর্কিতভাবে মঞ্চে প্রবেশ করে সিপাহী মইন ও কাজল। মইন মহাপরিচালকের দিকে অস্ত্র তাক করেন। এসময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে নিরস্ত্র করেন। এর পরপরই বিদ্রোহী জওয়ানদের একটি অংশ দরবার হলে ঢুকে মহাপরিচালকের সামনে তাদেও দাবি নিয়ে হৈ-চৈ শুরু করেন। মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিহ ইউনিট নিয়ন্ত্রণের জন্য বলেন। তখনই সিপাহি সেলিম রেজার নেতৃত্বে একটি দল সশস্ত্র অবস্থায় দরবার হলে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কিছুসময়ের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে
বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হলের চর্তুদিকে গুলি করা শুরু করেন।

সকাল সাড়ে দশটার দিকে কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন বিদ্রোহী জওয়ানরা। দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্রই মহাপরিচালক শাকিলকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন চার সেনা কর্মকর্তা। এরপর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে। তার পূর্বে দরবার হলের বাইরে প্রথমেই হত্যা করা হয় ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হককে। শুরু হয় সেনা কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারকে হত্যা, নির্যাতন, জিম্মি,লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। মুত্যপুরীতে পরিণত হয় পিলখানা।

ঢাকা ও সাভার সেনানিবাস থেকে সাজোয়া যান ও ভারী অস্ত্র নিয়ে বেলা ১১ টার সময় ধানমন্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেয় সেনাসদস্যরা। বিডিআরের ১ ও ৫ নম্বর গেটের বিভিন্ন পয়েন্টে আর্টিলারি গান ও সাঁজোয়া যান স্থাপন করা হয়। বিদ্রোহী জওয়ানরা সদর গেট ও ৩ নম্বর গেট থেকে সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার থেকে সোয়া ১২টার দিকে বিদ্রোহী জওয়ানদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে তারা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। তখন বিদ্রোহী জওয়ানরা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিলখানায় আসতে হবে।

পিলখানায় কর্মরত ডিএডি তৌহিদ, ডিএডি নাসির উদ্দিন খান, ডিএডি মির্জা হাবিবুর রহমান, ডিএডি আব্দুর রহিম,ডিএডি জলিল, সুবেদার গোফরান মল্লিক, সিপাহি সেলিম রেজা, সিপাহি মইন ও সিপাহি কাজলসহ কিছু জওয়ানরা সেদিনের সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

এরপর দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিডিআরের সদর দপ্তরের ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য (তৎকালীন যুবলীগের চেয়ারম্যান) জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (তৎকালীন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক) মির্জা আজম। তারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিডিআরের প্রতিনিধিদলের দেখা করার ব্যবস্থা করেন।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহী জওয়ানদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার দিকে বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানরা প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন । তারা আরো বেশি বেপরোয়া আচরণ শুরু করে এবং পিলখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলে।

পরের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বিডিআর জওয়ানরা পোষাক বদলে পিলখানা থেকে পালিয়ে যাওয়া শুরু করে। এরপর রাতে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহী জওয়ানরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের নিকট অস্ত্র সমার্পণ করেন এবং অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চাবি বুঝিয়ে দেন। এরপর পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয় পুলিশ।

পুলিশ পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরের দিন অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি একাধিক গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। যেখান থেকে তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিছু সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার পরে ম্যানহোলে ফেলে দেওয়ার কারণে তাদের মরদেহ নদীতে পাওয়া যায়। ক্ষত-বিক্ষত এমনকি বিকৃত করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ। এ বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান।

সংকট উত্তোরণে সরকার ও সেনাবাহিনীকে বিরোধীদলসহ দেশবাসীকে সহযোগিতার দরকার ছিল। সেখানে তৎকালীন বিরোধী দলের (বিএনপি) উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকে। যারা মাধ্যমে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রে তাদের সম্পৃকতা স্পষ্ট হয়। এমন ভয়াবহ মানবতা গর্হিত কাজে জাতি যখন শোকে স্তম্ভিত,তখন তারা ক্ষমতার মসনদ নিয়ে কথাবার্তা বলা শুরু করে।

বিএনপি-জামায়াত জোটের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। তারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটা ক্ষমতা গ্রহণের পরেই ক্ষমতাচ্যুতির জন্য যে নীল নকশা প্রণয়ন করেন তা বাস্তবে ধরা দিলনা। ভেস্তে গেল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির মনের খায়েশ। ফিরে যেতে পারল না সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যের পাকিস্তানি ভাবধারায়। দেশ রক্ষা পেল জঙ্গীবাদী, পশ্চাৎপদ মানসিকতার লোকের দ্বারা শাসিত হওয়া থেকে। জাতি হারাল তার চৌকস ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে। যারা দেশ ও জাতির সার্বভৌম রক্ষাসহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে চলছিল। আর যেন এমন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পিলখানার রক্ত স্রোতে ভেসে যাওয়া সকল নিহতের আত্মার শান্তি কামনা করি। একই সাথে হত্যাযজ্ঞে যারা জড়িত তাদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর হোক এটা আগামীর প্রত্যাশা।

লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/এমএস