ইলিশ খাবেন না বৈশাখে, প্লিজ!
অমনও শুনেছি, স্বামী বেচারা এ সময় অগ্নিমূল্যে ইলিশ কিনতে রাজি না হওয়াতে দাম্পত্য সম্পর্কটি শেষাবধি বিচ্ছেদে গড়িয়েছে। বৈশাখে ইলিশ চাই-ই। ইলিশ ছাড়া বৈশাখ উদযাপন অসার যুক্তি ভূতের বাড়ি। বাজার ও মিডিয়ার কী ভয়ঙ্কর প্রতাপ। ইলিশ বৈশাখের, বাণিজ্যিক কারণে বাণিজ্যিক মিডিয়া- এমন ধারণা চারদিক উৎসবের আমেজে প্রচার করছে।
বন্ধুপ্রতিম, মেধাবী মুখ খালেদ মুহিউদ্দিনই প্রথম ব্যক্তি যিনি সাংবাদিক হয়ে, সাংবাদিকতার শিক্ষক হয়ে, মিডিয়ার মানুষ হয়ে- মিডিয়ার এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বলেছেন। বলছেন এখনও। মনে আছে, ইন্ডিপেডেন্ট টেলিভিশনের আগে তিনি যখন সাপ্তাহিক কাগজ সম্পাদক ছিলেন, জনপ্রিয় দৈনিক আমাদের সময়-এ একটি কলাম লিখেছিলেন। তথ্য দিয়ে, যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ইলিশ বৈশাখের নয়।
কার কথা শোনে কে?
মানুষের মধ্যে যুক্তিহীনতা, বিজ্ঞানহীনতা, প্রকৃতিবিরোধিতা, ধর্মান্ধতা ভয়ঙ্করভাবে কাজ করে। শিক্ষিত হলেই লোকের মধ্যে যুক্তিপ্রবণতা কাজ করে তা নয়, বরং লেখাপড়া জানা অনেকের মধ্যে কখনও কখনও যুক্তিহীনতার মাত্রা ভয়াবহভাবে কাজ করে। প্রচলিত শিক্ষা তাকে একটা ছকের মধ্যে থাকতে, ভাবতে, শিখতে সাহায্য করে। এই ছক থেকে সে সহজে বেরুতে পারে না। ফলে ছকের বাইরে বা বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে কোনো বিষয়ে বললে, সে তখন প্রস্তুত থাকে না, তার কথা শুনতে। তখন স্বাভাবিকভাবেই বৃত্তের বাইরের মানুষটিকে শক্র বলে ভাবে। অথচ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এলেই, বাইরে এসে দাঁড়ালেই বরং মোহভঙ্গ ঘটে, নির্মোহভাবে দেখা যায়, ভাবা যায়, বোঝা যায় ভেতরে কি ঘটছে। ভেতরে থাকলে অনেক সময় বোঝা যায় না, বাইরে আসতে হয়।
মুখে আমরা সবাই প্রগতিশীল। বিজ্ঞানমনস্ক। প্রকৃতিপ্রেমী। প্রকৃতি ভালোবাসি, ভী-ষ-ণ ভালোবাসি বলে ফেনা তুলি মুখে। অথচ প্রকৃতি যে কী তাই বা কজনে বুঝি? কখনও কখনও চারপাশ দেখে মনে হয়, আমরা বড্ড হুজুগে, সবাই করছে তাই আমাকেও তা করতে হবে, সবাই যাচ্ছে তাই আমাকেও যেতে হবে, সবাই খাচ্ছে তাই আমাকেও খেতে হবে। কেন, কি কারণে, কি করব বা করব না- তা একটিবারের জন্যও ভাবি না, ভাববার চেষ্টাও করি না।
বৈশাখ। বর্ষবরণ। ঋতুচক্রের খেলা। এতো প্রকৃতিরই উৎসব। প্রকৃতিকে বরণ করে নেওয়ার, প্রকৃতির সঙ্গে মিলবার, নিজেকে মেলাবার উৎসব। একজন বাঙালি হিসেবে পহেলা বৈশাখকেই সবচেয়ে বড় উৎসব বলে মনে করি। এমন সার্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাঙালির জীবনে আর কোথায়? কিন্তু কী ভয়ঙ্কর! প্রকৃতির এই উৎসবে, এমন দিনে, এমন প্রকৃতি বিরোধিতা!
হ্যাঁ, আমি প্রকৃতি বিরোধিতাই বলব, পহেলা বৈশাখের নামে ইলিশ নিধন, প্রকৃতি বিরোধিতা ভিন্ন কিছু নয়। ইলিশ বৈশাখের নয়। বৈশাখের সঙ্গে, ইলিশের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। বৈশাখের সঙ্গে ইলিশকে যুক্ত করে যে ইলিশ নিধন তা নেহায়েত পুঁজি, বাণিজ্য ও মুনাফা সর্বস্বতা। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, বুঝবেন- এই ইলিশ বাণিজ্য ও বাণ্যিজিক মিডিয়ার। যদি প্রকৃতি সম্পর্কে, প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে ন্যূনতমও কোনো জ্ঞান থাকে তাহলেই বোঝা যায়, ইলিশের সঙ্গে বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দিয়েছে কোন সময় কোন ফুল ফুটবে, কোন ফল ধরবে, কোন মাছ পাওয়া যাবে কখন। এইসময় ইলিশের প্রজননের। এখন ইলিশমিথুন কাল। ইলিশ এখন সঙ্গম করবে, যৌনসুখে সুখ সাগরে ভাসবে, সাত আসমান ঘুরে আসবে। এমন সময় ইলিশ নিধন নিতান্ত প্রকৃতি বিরুদ্ধ। এখন ইলিশ খেলে ইলিশের বংশ বিস্তার হবে কিভাবে? আইনগতভাবেও এই সময় ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে কী আইনও ভঙ্গ করছি না আমরা? তাজা ইলিশ, টাটকা ইলিশ বলে ‘সুপারশপে’ অগ্নিমূল্যে যে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে তা কেন খাচ্ছি? এই ইলিশ তো স্বাদহীন, গন্ধহীন, বাসি। আবহাওয়া, প্রকৃতি, বিজ্ঞান- কোনো বিচারেই ইলিশ খাওয়ার সময় বৈশাখ নয়, বর্ষা।
সুযোগ হয়েছিল খ্যাতিমান পুষ্টিবিদ সিদ্দিকা কবীরের সঙ্গে কাজ করার। তিনি ছিলেন খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে দেশে-বিদেশে সম্মানিত পরিচিত নাম। তার কাছে একদিন জানতেও চেয়েছিলাম, বৈশাখ বরণের খাদ্য তালিকা। বলেছিলেন, বৈশাখে ইলিশ খাওয়া নিতান্ত মূর্খতা, বিজ্ঞানহীনতা। আবহমান কাল থেকে গ্রাম বাংলায়, বৈশাখের দিনে পান্তাভাত, যেকোনো বড় মাছের ভাজা টুকরো, ছোট মাছের ঝোল, ডাল-সবজি চচ্চরি, নানা প্রকারের ভর্তা, মুড়ি-মুরকি, খই, চিড়া, দই- এ সবই বর্ষবরণে খাবার রীতি।
পুঁজি ও বাণিজ্য তার মুনাফার জন্য কত কিছুই না করে! কত কিছুই না ধ্বংস করে আবার সৃষ্টি করে তারই স্বার্থে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম কোনো কিছুই বাদ যায় না তার হাত থেকে। বর্ণবাদী পুঁজিবাদ কালো মানুষকে ফর্সা হতে বলে। স্লিম ফিগারের প্রচারণায় ‘বুলেমিয়া’র মতো রোগ ছড়িয়ে দেয়। আধুনিকতার নামে কাপড় খুলে উদোম করে মেয়েদের। লোম তুলতে ‘ব্লিচ ক্রিম’ বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়। পুরুষদেরও ছাড়ে না পুঁজি, বাধ্য করে ‘মেন্স অ্যাকটিভ’ কিনতে। যৌনতা, যৌনাঙ্গেও হাত দেয় পুঁজি। রেহাই পায় না নারী-পুরুষ কেউই!
পুঁজির এই বাণিজ্যিক প্রচারণায় মিডিয়াও যুক্ত হয়, নিজেকে যুক্ত করে মুনাফার লাভে-লোভে। কারণ মিডিয়া, সেও তো পুঁজিরই!
লেখক : উপসম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র
[email protected]
এইচআর/এবিএস