ধর্ষণ, কথিত আত্মহত্যা, আপোস : কি বিচিত্র এই আমরা!
কুমিল্লা সেনানিবাসে নিষ্ঠুর ও পাশবিকভাবে সোহাগী জাহান ‘তনু’ হত্যার প্রতিবাদে যখন সারা বাংলাদেশ বিক্ষোভে কাঁপছে, তখন শরিয়তপুরে গাছের ঝোপের নিচে মরে পরে আছে ধর্ষিতা কিশোরী চাঁদনী। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে,পথে প্রান্তরে,পাটক্ষেত-ধানক্ষেতে, চলন্ত বাসে ধর্ষণ এখন তিনবেলা আহারের মতো নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে । এই দেশে শত শত ধর্ষিতার মিছিলে আজ কেউ ধর্ষিত হলে আগামীকাল আর তার নাম মনে থাকে না। নিম্নবিত্ত ঘরের এই অসহায় কিশোরী চাঁদনীর নামটিও হয়তো মুছে যাবে সময়ের আবর্তে, যেভাবে ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে শুরু করেছে গত ৭ই মার্চ ধর্ষণের পর সরকারী বাসভবনের ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলা গৃহকর্মী জনিয়া বেগমের কথা। হয়তো আপোস কৌশলে মুছে যাবে কথিত ‘আত্মহত্যা’ দাবি করা সংগীত শিল্পীর স্বামীর মুখের আঁচরের দাগ। কেউ জানবে না গৃহকর্মী জান্নাতের আবাস স্থলটি কেনো তার জন্যে অনিরাপদ হয়ে উঠেছিলো? কি কারণে দরিদ্র ঘরের খেটে খাওয়া একটি তাজা কিশোরীর প্রাণ পলকেই নিষ্প্রাণ হয়ে গেলো? বলা হয়েছে গৃহকর্মী জান্নাত এর আত্মহত্যার প্রবণতা ছিলো। যদি তাই হয়,তাহলে আত্মহত্যা প্রবণতার মতো এতো স্পর্শকাতর বিষয়টি অনুধাবন করেও ঐ দম্পতি কেন তা অবহেলা করলেন? কেনইবা আত্মহত্যা প্রবণ দরিদ্র কিশোরী মেয়েটি নিজ পরিবারে গিয়েই আত্মহত্যা করলোনা? হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া যেন সামাজিক অবক্ষয়ের একটি নতুন উপসর্গ বা কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে হত্যাকারীরা হত্যার পর তড়িঘড়ি করে ভিক্টিমকে সিলিংফ্যানের সাথে অথবা বাথরুমের শাওয়ারের সাথে ঝুলিয়ে দিচ্ছে। হত্যার পর তড়িঘড়ি করে সবকিছু আড়াল করতে না পেরে তারা আত্মহত্যার প্রহসন অবলম্বন করে। গত কিছুদিন আগে স্যোশাল মিডিয়াতে গাছের সাথে ঝুলে থাকা একটি কিশোরীর ছবিতে দেখা গেছে মেয়েটির হাঁটু মাটিতে লেগে ছিলো। যা দেখে মনে হয়েছিলো মেয়েটিকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। গত কয়েক মাসে এ ধরনের আত্মহত্যা চোখে পড়েছে পাঁচ থেকে ছয়টি। শরীরে জখম, ক্ষত আর ধর্ষণের প্রমাণ সাথে বহন করে মাটিতে পা রেখেই তারা আত্মহনন করে বলে বলা হয়ে থাকে। আমার মনে হয় আত্মহত্যার এই সাম্প্রতিক প্রবণতার কারণে যদি আলামত পাওয়ার ভিত্তিতে মামলা গুলি শ্রেণিবিভাগ করা যায় তাহলে ধর্ষণপ্রবণ এবং হত্যাপ্রবণ মানুষেরা কিছুটা হলেও সাবধান হতো এবং তদন্ত কাজ অনেক সহজ হয়ে যেতো।
কোনো সমাজ কখনোই সামগ্রিকভাবে ধর্ষণমুক্ত ছিলোনা। আইন অথবা ঐশী বাণীর কঠিন প্রয়োগ বা প্রভাবে ধর্ষণ কোনো অঞ্চল থেকে একেবারেই নির্মূল হয়ে যাবে এ কথা বলা কঠিন। উন্নত অনুন্নত সকল দেশেই ধর্ষণের,গণ ধর্ষণের কম বেশি খবর পাওয়া যায়। সমাজ বিজ্ঞানীরা ধর্ষণকে একটি সামাজিক ব্যাধি এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন, কারণ এটি ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনৈতিক বলপ্রয়োগ। তাঁরা মনে করেন ধর্ষণের কারণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে ধর্ষণের মাত্রা ও এর প্রাদুর্ভাব তাই একেক দেশে একেক রকম হয়ে থাকে। উন্নত দেশের সাথে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য অনেক বেশি। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন ধর্ষণ অবদমিত কামের বহিঃপ্রকাশ। ফ্রয়েড মনে করতেন মানুষ সহজাত হিংস্র প্রবৃত্তি নিয়েই জন্মায় এবং তা সভ্যতার চাপে অবদমিত হয়ে থাকে। সময় সুযোগ মত তা মানুষকে হিংসাশ্রয়ী ধ্বংসাত্মক কাজ করতে উৎসাহিত করে। ফ্রয়েড আরো বলেছেন, লিবিডো হচ্ছে মানুষের মৌল কাম বা প্রাণশক্তি। মানুষের বিকাশ ঘটে ঐ অন্ধ আদিম কামশক্তির সাথে সঙ্ঘাতের মধ্যে দিয়ে । তাঁর এই কামচালিত শক্তিই লিবিডো তত্ত্ব নামে পরিচিত। মানুষের জীবনে লিবিডোর গতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, কোনো বিশেষ কাম্যবস্তু না পেলে সেখান থেকে সে লিবিডো সরিয়ে অন্য বস্তুতে স্থানান্তর করতে পারে। নারীবাদীরা ধর্ষণকে দেখেন পুরুষাধিপত্যের একটি কৌশল হিসেবে। তাঁরা মনে করেন এর উদ্ভব ঐশ্বরিক এবং ঐন্দ্রজালিক, যা নারীর উপর পুরুষের বল প্রয়োগের মূল হাতিয়ার। এটি এক ধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার যা ক্ষমতা সংগঠন বা বিন্যাসর মাধ্যমে একদল মানুষ অন্য একদল মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে । তাঁরা মনে করেন সভ্যতা এখনো লৈঙ্গিক। যুগে যুগে নারী পুরুষ লিঙ্গের আধিপত্যর শিকার।
পৃথিবীর সকল ধর্ম এবং সভ্যতাই `পুরুষতন্ত্র কে’ দেখতে চেয়েছে শক্তিশালী মহাপরাক্রমশালী প্রভুর মতো। পুরুষকে স্থান দিয়েছে স্রষ্টার পরে। পুরুষ যাই করুক না কেন তাই শ্রেষ্ঠ। নারীবাদী ধারণায় ধর্ষণ শুধু কাম বিকৃতি নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি নারী বিদ্বেষের, ঘৃণা আর বঞ্চনার। আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এবং সংশোধনী ২০০৩ সহ আরো অনেক আইন নারীর অধিকার ও সম্মান রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। কিন্তু এই আইন চালিয়ে যাওয়ার জন্যে যে সামর্থ্যর প্রয়োজন হয়, নিম্নবিত্তরা সেই বাধা অতিক্রম করে ন্যায় বিচারের চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেন না। গৃহকর্মী জান্নাত আক্তার শিল্পীর পরিবার আপোসের মুচলেকা দিতে বাধ্য হয়েছে। দরিদ্র মানুষের কাছে মৃত মানুষের জন্য ন্যায় বিচারের প্রয়োজন কখনই মৌলিক চাহিদার চেয়ে বেশি নয়, যা সৌদি আরবে প্রচলিত ‘ব্লাড মানি’ প্রদানের মতো । তনুর বাবাকে নগদ বিশ হাজার টাকা এবং এক খণ্ড জমি দেবার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে। ধর্ষণের পর ন্যাম ভবন থেকে ছুঁড়ে ফেলা জনিয়াদের পরিবার ধর্ষিতা হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও জীবন বাঁচানোর তাগিদে এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে আর বিচার চাইতে যায় না ।
প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ এর “১০,০০০ এবং আরো একটি ধর্ষণ” উপন্যাসে বাংলাদেশের অসহায় নির্যাতিত মেয়েদের করুণ বাস্তব চিত্রটি অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে,বিজ্ঞ জজ ও ধর্ষিতা ময়নার কথোপকথনে: বিজ্ঞ জজ- তুমি রেপিষ্টদের বিরুদ্দে মামলা কর নাই?
ময়না- না করি নাই।
বিজ্ঞ জজ -তুমি তাগো চিনতে পারছিলা?
ময়না - হ, চিনতে পারছিলাম।
জজ সাহেব - তাইলে মামলা কর নাই ক্যান?
ময়না - এই হুয়রের দ্যাশে হুয়রগো বিরুদ্দে মামলা কইরা কি অইবো? আপনে কি জানেন, আমারে থানায় আইন্যা চাইর দিন ওসি আর দারোগা-পুলিশে ধর্ষণ করছে।
বিজ্ঞ জজ- তুমি কও কি?
ময়না- আহেন, আপনেও আমারে ধর্ষণ করেন … আহেন জাউরাগো দ্যাশটারে আমি জাউরায় ভইরা দ্যাই।
বাদী বিবাদীর বিশাল অর্থনৈতিক বৈষম্যর কাছে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা গরীবের ঘোড়া রোগের মতো। আপোসে সমাধান করে নেয়াটাই এদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ, অন্যথায় পরিবারের একজনের ধর্ষণ আর হত্যার জন্যে পুরো পরিবারটিই হুমকির সম্মুখীন হয়ে যায়। হত্যা আর ধর্ষণের বিচার চাইতে গেলে পুরো পরিবারটিই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে ধর্ষিত হতে থাকে সমাজ সংসারের কাছে। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ কখনই ধর্ষিতার পাশে দাঁড়ায় না। সমাজের মুখ থেকে বের হয়ে আসে নারীর সমস্ত শরীর পাপের বস্তু- ‘নারী তেঁতুলের মতো’, ‘এক হাতে তালি বাজেনা’, ‘মেয়েটির পোশাক ভালো ছিলোনা’ ইত্যাদি। এ ধরনের বক্তব্য ছড়িয়ে দিয়ে সমাজ ধর্ষণকে এক প্রকার বৈধতাই প্রদান করে।
যারা ধর্ষণকে পোশাকের কারণ বলে উস্কে দেয় তারা নিশ্চয়ই এটি বলবেন না যে শিশুদের পোশাক শিশু কামিতার জন্য দায়ী? যারা এ ধরনের কথা বলে বলে সমাজকে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের ভীত ভেঙ্গে দিতে হবে। আমরা জানিনা `তনু`র হত্যাকারীরা ধরা পরবে কিনা। ধরা পরলেও সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা। তবে তনুর সাথে সাথে আমরা জান্নাত, জনিয়া আরো অন্যান্য জানা অজানা সকল ধর্ষণ, নিপীড়িত, হত্যা এবং সাজানো আত্মহত্যার শিকার হওয়া নারী ও শিশুর সঠিক তদন্ত ও ন্যায় বিচার চাই। সকল অত্যাচারিত নারী ও শিশুর পক্ষে `তনু`র নামটি ধর্ষকদের, হত্যাকারীদের জন্যে হয়ে উঠুক একটি প্রতিবাদের নাম, একটি মারণাস্ত্রের নাম। প্রয়োজনে জনগণের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে বিচার কার্যক্রম দ্রুততর করার জন্যে নতুন আইনের প্রস্তাবনা হোক। ধর্ষকেরা, হত্যাকারীরা অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সুযোগে গৃহকর্মীদের জীবন আপোসে কিনে ফেলছেন, কিন্তু এই গণজোয়ার তারা কিনবেন কিভাবে?
লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স ট্রেনিং সেন্টার, বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স লিমিটেড
[email protected]
এইচআর/এমএস