ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সশস্ত্র বাহিনীর গৌরব জাতিসংঘেও প্রশংসিত

তাপস হালদার | প্রকাশিত: ০২:১৭ পিএম, ২১ নভেম্বর ২০২৩

সুমহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গঠন হয়। বাঙালি জাতির মহান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে শত্রু মুক্ত করতে জনতার সাথে একাত্ম হয়ে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রথমে বাহিনী গুলো আলাদা ভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করলেও ২১ নভেম্বর যৌথ ভাবে অভিযান শুরু করে। তিন বাহিনী নিয়ে তৈরি হয় সশস্ত্র বাহিনী। যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত টার্নিং পয়েন্ট।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে যৌথ বাহিনী অপারেশন শুরু করলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দ্রুততম সময়ে পতন নিশ্চিত হয়। এবং ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। ১৯৮২ সাল থেকে ২১ নভেম্বর তিন বাহিনী সম্মিলিত ভাবে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালন শুরু করে। এর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ, বিমানবাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর, নৌবাহিনী ১০ ডিসেম্বর আলাদা ভাবে দিবসটি পালন করতো।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গ ত্যাগ করে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে অনেক বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তবে স্বাধীনতার আগেই দেশের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে অনেকেই নিরবে কাজ শুরু করেছিলেন। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

১৯৬৮ সালে পাকিস্তান ভাঙ্গার অভিযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বেশ কিছু বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নামে দেশদ্রোহী মামলা করেছিল পাকিস্তান সরকার। যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুসহ সকল আসামীকে গ্রেফতার ও সেনানিবাসে কোর্ট মার্শালে বিচার শুরু হয়। এবং মামলার অন্যতম আসামী বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকিস্তানি সেনা হেফাজতে হত্যা করা হয়। এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলার কারনে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পাকিস্তান সরকার মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুসহ সকল সামরিক কর্মকর্তারা নিঃশর্ত মুক্তি পান।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালির সদস্যরা চাকরির নিরাপদ জীবন ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখ ভাগে লড়াইয়ের পাশাপাশি মুজিবনগর সরকারকে সহায়তা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, চিকিৎসা সহায়তা প্রদানসহ অনেক কাজেই নিয়োজিত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ জনগণ যাঁরা গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদেরকে মূলত বলা হতো গণবাহিনী। আর নিয়মিত যুদ্ধের জন্য সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনী এবং জেড ফোর্স, এস ফোর্স ও কে ফোর্স নামে তিনটি বিগ্রেড গঠন করা হয়, যার নেতৃত্বে সশস্ত্রবাহিনীর তিন কর্মকর্তা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য ৭ জন বীর সদস্যকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ দেয়া হয়। এছাড়া ৫৮ জনকে বীর উত্তম, ১৩৪ জনকে বীর বিক্রম এবং ১৭৮ জনকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হয়।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর একজন স্বৈরশাসক ক্ষমতা দখল করে। তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে তথাকথিত অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে বেশ কিছু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য নিহত হন। কোর্ট মার্শালের নামে তথাকথিত বিদ্রোহের দায়ে সশস্ত্রবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং অনেককেই বিনা কারণে বরখাস্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর একটি অংশের জড়িত থাকা এবং অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখল করে দু’জন সেনা শাসক দেশ পরিচালনার কারণে দীর্ঘ পনের বছর সেনাবাহিনী ও জনগণের মাঝে একপ্রকার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। যার কারণে দেশ ও জাতির অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে।

‘৯১ সালে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসলেও বিএনপি সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে বারবার রাজনীতির মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সশস্ত্র বাহিনীকে কখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করেননি। বরং ১৯৭৪ সালের বঙ্গবন্ধুর প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় তিন বাহিনীর পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের কাজ চলছে। দেশ-বিদেশে উন্নততর প্রশিক্ষণসহ আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন সমরাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে।

দেশ ও জনগণের কাজে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। নিজেদের উপর অর্পিত সামরিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম,মেগা অবকাঠামো নির্মাণ, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে আসছে। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ, বিভিন্ন এলাকার অবকাঠামো পুনর্নির্মাণসহ দেশ ও জনগণের সেবায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

 

আজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শীর্ষ শান্তিরক্ষা প্রেরণকারী দেশ। সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে বিশ্ব দরকারে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে। জাতিসংঘ থেকে যার স্বীকৃতিও মিলেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিয়েরা লিওনে দ্বিতীয় মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা ভাষা। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। শুধু নিরাপত্তা নয়, চিকিৎসাসহ মানবিক সেবা দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর অকুণ্ঠ ভালোবাসা অর্জন করেছে। আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম প্রশংসিত।

 

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এযাবৎ প্রায় ৪০ টি দেশে ৫৪ টি মিশনে কাজ করেছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। শান্তিরক্ষা মিশনে সশস্ত্র বাহিনী প্রেরণে বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থানে আছে বাংলাদেশ।১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে প্রথম যোগ দেয়।এরপর ১৯৯৩ সালে নৌ ও বিমানবাহিনী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী নিজেদের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে।

বৈশ্বিক করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ‘লক-ডাউন’ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, জনগণের মধ্যে মহামারি প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, বিদেশ ফেরত মানুষদের কোয়ারান্টাইন নিশ্চিত করা, দুঃস্থ ও অসহায় মানুষদের কাছে খাদ্য পৌঁছানোসহ নানাবিধ কার্যক্রম অত্যন্ত প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী মালদ্বীপের করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হেলিকপ্টারে কোভিড আক্রান্ত জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা, চিকিৎসক, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে এসেছে।

করোনা পরিস্থিতিতে আটকে পড়া দেশি-বিদেশি নাগরিকদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ১৭ টি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করতে গিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর অনেক সদস্য আক্রান্ত ও বেশ কিছু সংখ্যক মৃত্যুবরণ করলেও তারা দায়িত্ব থেকে কখনো পিছপা হননি। দেশের প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সশস্ত্র বাহিনী দ্বিধাহীনভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সংকট মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে।১৯৮৮,১৯৯৮,২০০৮ ও ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যাসহ ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলাসহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচের ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ সত্যিই গর্বে আমার বুক ভরে যায়। বাংলাদেশের মালিক আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ। সেজন্যই সফল হয়েছে আজ আমার নিজের মাটিতে একাডেমি করা। আমি আশা করি, ইনশাআল্লাহ এমন দিন আসবে, এই একাডেমির নাম শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, সমস্ত দুনিয়াতে সম্মান অর্জন করবে।

আজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শীর্ষ শান্তিরক্ষা প্রেরণকারী দেশ। সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে বিশ্ব দরকারে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে। জাতিসংঘ থেকে যার স্বীকৃতিও মিলেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিয়েরা লিওনে দ্বিতীয় মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা ভাষা। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। শুধু নিরাপত্তা নয়, চিকিৎসাসহ মানবিক সেবা দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর অকুণ্ঠ ভালোবাসা অর্জন করেছে। আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম প্রশংসিত।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
haldertapas80@gmail

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন