সায়মা ওয়াজেদের বিজয়ে গর্বিত পুরো বাংলাদেশ
বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের এক অনন্য বিজয়। জাতিসংঘের অন্যতম বৃহৎ সংগঠনের আঞ্চলিক পরিচালক পদে বাংলাদেশের বিজয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে বিজয়ী হয়েছেন। গত ১ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ১১ টি সদস্য দেশের ভোটে ৮-২ ভোটের বিশাল ব্যবধানে তিনি নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, উত্তরকোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, তিমুর লেস্টে এই দশটি দেশ ভোট প্রদান করে। মিয়ানমার ভোট দানে বিরত থাকে। সাময়া ওয়াজেদ পুতুলের বিজয় মোটেও সহজ ছিল না। কারণ তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন নেপালের শম্ভু প্রসাদ আচার্য। যিনি প্রায় তিন দশক ধরে দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করা একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আবারও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় ভারত। দেশটির সমর্থন সায়মা ওয়াজেদের বিজয় সহজ হয়ে যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে,২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় ডব্লিউএইচওর ১৫৪ তম অধিবেশনে এই মনোনয়ন অনুমোদন দেয়া হবে। এবং নবনিযুক্ত আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ আগামী ১ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে সাময়া ওয়াজেদ পুতুলই হবেন প্রথম বাংলাদেশি। এর আগে বাংলাদেশ থেকে আর কেউ এমন পদে নির্বাচিত হননি কিংবা দায়িত্ব পালন করেননি।
উল্লেখ্য বর্তমানে আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ভারতের পুণম ক্ষেত্রপাল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি কার্যালয়ের মধ্যে এটি একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই অঞ্চলের দেড়শ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা জড়িত। এখানে বিশ্বের মোট ৩৫ শতাংশ জনগণ বাস করেন। এখন তিনি এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবায় কাজ করবেন।
সায়মা ওয়াজেদের মনোনয়ন যথার্থ ছিল বলেই তিনি সদস্য দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছেন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। বিশেষত অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে সারা বিশ্বেই পরিচিত। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মহাপরিচালকের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সায়মা ওয়াজেদের মনোনয়ন নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত চিকিৎসকদের অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট অমিত চক্রবর্তী বলেছিলেন,‘সায়মা ওয়াজেদ পুতুল লাইসেন্স প্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানী এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আইনজীবী। তাঁর মনোনয়ন নিয়ে যারা কথা বলছেন,তারা পক্ষপাতদুষ্ট। এর মধ্যে কোনও সারবত্তা নেই। উনি এই পদের সেরা চয়েস। তিনি যদি এই পদে আসেন তা হলে ডব্লিউএইচও আরও অনেক বেশি মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন। অতিমারীর পরে বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটি মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভুগছেন। তিনি দায়িত্ব পেলে এই বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারবেন।'
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এবং ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির উপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০১৩ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ সংস্থাটি তাঁকে ‘ডব্লিউএইচও এক্সেলেন্স’ পুরস্কারে ভূষিত করে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাতনি, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার দেশরত্ন শেখ হাসিনার কন্যা হওয়া সত্ত্বেও তিনি পারিবারিক পরিচয়ের বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তথাকথিত রাজনীতির বাইরেও যে মানব কল্যাণ করা যায় তিনি সেটা করে দেখিয়েছেন। জাতিসংঘের অন্যতম মর্যাদাবান সংগঠনের আঞ্চলিক পরিচালক হওয়ার গৌবর শুধু সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের একার নয়, এটি পুরো বাংলাদেশের।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের উদ্যোগে ২০১১ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় অটিজম বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন।গঠিত হয় ‘South Asian Autism Network(SAAN)’। ঢাকায় যার সদরদপ্তর করা হয়।তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ‘নিউরোডেভলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট-২০১৩’ পাশ হয়। একসময় অটিস্টিক শিশুরা সমাজের বোঝা ছিল,সমাজে অবহেলিত ছিল। তারা বিড়ম্বনার শিকার হতো। বাবা-মা বাধ্য হয়ে তাদেরকে লুকিয়ে রাখতো। সাময়া ওয়াজেদের কল্যাণে অটিস্টিক শিশুরা সমাজের মূলস্রোতে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি এক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের অটিস্টিক শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
সাময়া ওয়াজেদ পুতুল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। জলবায়ু ঝুঁকির ৪৮ টি দেশের জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ), যার চেয়ারম্যান বাংলাদেশ। জোটের দূত হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে দূত হিসেবে আরও আছেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ কামাল, ফিলিপাইনের উপ-স্পিকার লেন লেগার্দা ও রিপাবলিক অব কঙ্গোর জলবায়ু পরিবর্তন প্রধান বিশেষজ্ঞ তোসি এমপানু। সিবিএফের চার দূত জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সদস্য দেশগুলোর জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের ছায়াসঙ্গী হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সফরে পুতুলকে দেখা গেছে। বিশেষ করে জি-২০ সম্মেলনে মায়ের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা যাওয়ার পর অনেকের মধ্যে একটি কৌতূহল ছিল, পুতুলই কি তাহলে আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্ব? এই কৌতূহলের জবাব দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গত ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘পুতুলের নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা খুবেই কম। ভবিষ্যতে কে নেতৃত্বে আসবে সেটা বাংলাদেশের জনগণ ঠিক করবে আর আমার দল। ছেলে মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছি। তাদের শিক্ষাটাই একমাত্র সম্পদ। তাদেরকে বলেছি যে শিক্ষা দিয়েছি সে শিক্ষা অনুয়ায়ী দেশের কল্যাণে কাজ করতে।’
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল মায়ের (দেশরত্ন শেখ হাসিনা) কাছ থেকে উপযুক্ত শিক্ষা নিয়েই দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও দ্রুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন।প্রধানমন্ত্রীর সন্তান মানেই ক্ষমতা,প্রভাব-প্রতিপত্তি,ব্যবসা বাণিজ্য থাকবে এটাই দেশের ইতিহাস। কিন্তু সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের মা চার বারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া স্বত্বেও ক্ষমতার কোথাও তিনি নেই, নিজের মেধা-মনন দিয়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে কাজ করে যাচ্ছেন। এ অর্জন, কৃতিত্ব শুধুমাত্র মাত্র তাঁর। এখানে মায়ের ক্ষমতার কোনো ভূমিকা নেই। বরং নিজের মেধা দিয়ে মায়ের কাজকে তিনি সহযোগিতা করছেন। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এমন দৃশ্য সত্যিই বিরল। তিনি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত নন। কিন্তু রাজনীতির অর্থ যদি হয় মানব কল্যাণ তাহলে সেই রাজনীতি নিরলস ভাবে করে যাচ্ছেন।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাতনি, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার দেশরত্ন শেখ হাসিনার কন্যা হওয়া সত্ত্বেও তিনি পারিবারিক পরিচয়ের বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তথাকথিত রাজনীতির বাইরেও যে মানব কল্যাণ করা যায় তিনি সেটা করে দেখিয়েছেন। জাতিসংঘের অন্যতম মর্যাদাবান সংগঠনের আঞ্চলিক পরিচালক হওয়ার গৌবর শুধু সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের একার নয়, এটি পুরো বাংলাদেশের। এই অর্জন বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকেই সম্মানিত করলো সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
haldertapas80@gmail
এইচআর/জিকেএস