ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এবং আজকের বাস্তবতা

প্রকাশিত: ০২:০৫ এএম, ২৯ মার্চ ২০১৬

আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। পৃথিবীর ২০০টি স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে আমরাও রয়েছি। তবে সব কটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে- যা একেবারেই অনন্য, অসাধারণ এক ব্যতিক্রম ঘটনা। ইউরোপীয় দেশগুলো ছাড়া লাতিন আমেরিকা, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রায় সব ক’টি দেশই কতিপয় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দেশের শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সে ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও সশস্ত্র পন্থায় কোনো কোনো জাতিকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কিছু মানুষ কিছু বাহিনি গঠনের মাধ্যমে অস্ত্র ধারণ করেছে, অনেকেই স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, জাতীয় বীরের মর্যাদায় তারা নিজ নিজ দেশের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সেই সব দেশে স্বাধীনতাকামী জনগণ এসব সংগ্রামীকে নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছেন। স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তাদের মেধা, দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পৃথিবীতে প্রায় ১৫০টির মতো রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে পরাধীনতা ছিন্ন করে। তবে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ কোথাও গণহত্যা চালায় নি। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে কোথাও কোথাও বিদ্রোহ এবং অস্ত্র ধারণ করা হলেও কোথাও মুক্তিযুদ্ধের মতো গণযুদ্ধ সংঘটিত করতে হয়নি। ব্যতিক্রম ঘটেছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। তবে আমাদেরকে সরাসরি কোনো বিদেশি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কোনো মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করতে হয়নি। আমরা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে লাড়াই-সংগ্রাম এবং বিদ্রোহ করেছি। কিন্তু পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রদেশ হয়ে যে স্বাধীনতা আমরা ১৯৪৭ সালে লাভ করেছিলাম তা আমাদের কাছে দেশভাগ হিসেবেই অধিকতর বিবেচিত হয়েছে, স্বাধীনতা হিসেবে নয়।

দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে পূর্ববাংলার জনগণকে ঔপনিবেশিক শক্তির চাইতেও খারাপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই ভাষা নিয়ে আন্দোলন করতে হলো, নির্বাচনসহ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক-শিক্ষার ও সাংস্কৃতিক নানা অধিকারের জন্যে আন্দোলন-সংগ্রাম, এমনকি গণঅভ্যুত্থানের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাও ঘটাতে হয়েছিল। এটি ছিল মূলত জাতীয়তাবাদী চেতনার উম্মেষ ঘটানোর ঐতিহাসিক স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ। সেখানে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। কেননা পাকিস্তান রাষ্ট্রপরিচালনায় যুক্ত সামন্ত-সামরিক এবং আমলারা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ধারক ছিল না। সে কারণে পাকিস্তানকে তারা আধুনিক জাতিতাত্ত্বিক আধুনিক কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ধাবিত হতে না দিয়ে এটিকে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বন্দী খাঁচায় বেঁধে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

শাসক শ্রেণি ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলকে রাজনৈতিক ম্যান্ডেট হিসেবে না দেখে ‘পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখেছে। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র ব্যবস্থার শাসকদের কাছ থেকে এর চাইতে আধুনিক চিন্তার আশা করাই বোধ হয় সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শাসক গোষ্ঠী নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং জনগণের ওপর ট্যাংক ও সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে-যেটি একেবারেই বর্বরোচিত হামলা, পোড়ামাটি নীতির মানসিকতা। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু হয় জনগণের মধ্য থেকে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই প্রতিরোধকে গণযুদ্ধে রূপান্তরিত করেন, নয়মাসব্যাপি একটি মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেন। সেটিকে স্তব্ধ করতে পাকিস্তান রাষ্ট্র তার গোটা সামরিক বাহিনিকে সশস্ত্রভাবে জনগণের বিরুদ্ধে নামিয়ে দেয়-যা কেনো সভ্য দেশ তো দূরের কথা, ঔপনিবেশিক শক্তিও করে নি। ঔপনিবেশিক শাসন কালে স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমন করতে পুলিশ বাহিনীকেই প্রধানত ব্যবহার করা হয়েছে, রাষ্ট্র সেনা বাহিনিকে জনগণের ওপর নির্বিচারে হত্যা করার জন্যে নামিয়ে দেওয়ার নজির নেই। পাকিস্তানি বাহিনি শহর, বন্দর, নগর, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করে নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, নারীদের সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে- যে দৃশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী-নাৎসিবাদী সামরিক বাহিনি করেছে। সেটি ঘটেছে দুই পরস্পর বিরোধী সামরিক জোটভুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে যুদ্ধের কারণে।

১৯৭১ সালে তো দুই দেশের মধ্যে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর সেনাবাহিনি কর্তৃক গণহত্যা পরিচালনা করেছে প্রকাশ্যে। সেই গণহত্যার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ অস্ত্র ধারণ করেছে, ভারতসহ গণতান্ত্রিক দুনিয়ার জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ অকাতরে দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছে, তারপরও জয় বাংলা এবং স্বাধীনতা লাভের আকাক্ষাকে ত্যাগ করে নি সাধারণ মানুষ। ১৬ ডিসেম্বর অবশেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনিকে ঢাকার চারদিকে ধাওয়া দিয়ে এনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এমন বর্বর বাহিনির শেষ পরিণতি হয়েছে মাথা নিচু করে অস্ত্র সম্বরণ করা, আত্মসমর্পণ করে বন্দিত্বকে বরণ করা।

৯৪ হাজার পাকিস্তানি সেনা সদস্য ও কর্মকর্তা বন্দি হলেন, পাকিস্তান সরকারের দম্ভ সম্পূর্ণরূপে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল, পাকিস্তানের সিংহাসন এই মুল্লুকে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। পূর্ববাংলার জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীনতার জন্যে যে লড়াই এবং সংগ্রামের শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের সূচনা থেকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা মেধা, প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমে সফল হলেন। গোটা জাতি একটি বীরের মর্যাদা লাভ করেছে। এ হচ্ছে স্বাধীনতার জন্যে ব্যতিক্রমর্ধী মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ-বীরদের শৌর্য-বীর্যও গৌরবময় ইতিহাস। এমন আত্মত্যাগ ও মহত্বের ইতিহাস পৃথিবীর আর কোনো স্বাধীনতালাভকারী দেশ ও জনগণের নেই। ১৯৭১-এ আমাদের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সেই ইতিহাস, সেই গৌরব ও সৌরভ আমাদের জীবনে সংঘটিত করেছেন। ইতিহাসের এমন বর্ণিল ও সুশোভিত রূপ কোথাও নেই-যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তথা স্বাধীনতা লাভে ঘটেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি নাগরিক এমন ইতিহাসের ধারক-বাহক হবেন, গৌরবে উজ্জীবিত হবেন যথার্থ উত্তরাধিকার। এটিই পৃথিবীব্যাপি দেখা যাচ্ছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এমন গৌরবময় স্বাধীনতার ইতিহাস বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন অক্ষুন্ন থাকলেও ক্রমেই মহিমান্বিত ইতিহাসে নানা কলঙ্ক লেপন করা হতে থাকে। বিকৃত ইতিহাস প্রচারের হীন উদ্দেশ্য ১৯৭৫-এর পর থেকে শুরু হয়েছে। ফলে নতুন প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যথাযথভাবে সঞ্চারিত হতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যথাযথভাবে সঞ্চারিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে ১৯৭১-এর বাস্তবতাকে ধারণ করা, পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং এর শাসক গোষ্ঠীকে ১৯৭১-এর মতো ঘৃণা করতে শেখা, ১৯৭১-এর সাড়ে সাত কোটি মানুষের দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ এবং দেশপ্রেমকে হৃদয়াঙ্গম করা, ধারণ করা। বাস্তবে সেটি সেভাবে ঘটেনি। ঘটেনি বলেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাঙালি বিরোধী আচরণকে উপলব্ধি না করে এখনো নতুন পুরাতন প্রজন্মের অনেককেই পাকিস্তান প্রীতিতে হাবুডুবু খেতে দেখা যাচ্ছে।

একদিকে ত্রিশ লাখ মানুষের হত্যাকারীদের ঘৃণা করতে না শেখা, অন্যদিকে নিজের মা-বোনদের ওপর পাশবিক আচরণ-কারীদের প্রতি বেশ বড় সংখ্যক বাঙালির দুর্বলতা প্রদর্শন করার মানসিকতা অসুস্থ দ্বৈতনীতিতে দোলারই লক্ষণ বলে প্রমাণ করে। এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এতো বড় একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভূত ও প্রেতাত্মাদের মৃত্যু ঘটেনি, পাকিস্তানের প্রতি অন্ধত্ব অনেকের মধ্যেই কাটেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা বেড়ে চলছে। এর হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট বা অন্য কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অথবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো বিরোধ ঘটলে। অথচ পাকিস্তানে বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা, প্রেম এতোটা দেখা যায় না, যতটা বাংলাদেশে লক্ষ করা যাচ্ছে। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজে কিছু মানুষ বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও সরকার এবং গোটা সমাজ বাংলাদেশ বিরোধী প্রবল।

বস্তুত পাকিস্তান একাত্তর সালে এমন বর্বর আচরণ করার পরও বাঙালি মুসলানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মনে কোনো রেখাপাত না করার বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর। এমন হীন মানসিকতা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ও বিনাশী, একাত্তরের শহীদদের প্রতি অবমাননাকর। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎকেও চরমভাবে বিপদগ্রস্ত করতে পারে। পৃথিবীর কোনো স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের জনগণের মনোজগতে এমন হীন, বিকৃত ও ঘৃণ্য অন্ধ বিশ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র এখনও ১৯৭১ সালে তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি, বাংলাদেশে তাদের অপরাধ কর্মের জন্যে অনুশোচনাও করেনি। পাকিস্তান এখনও বাংলাদেশকে তাদের অধীনস্ত দেশের দৃষ্টিতেই দেখে। তারপরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তানের প্রতি প্রীতি দেখে বিস্মিত হতে হয়।

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এমনটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং অনাকাঙ্খত। বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং করণীয় অনেক কিছুই নির্ধারিত করতে হবে। নতুবা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে নিরঙ্কুশ গর্ব করার পরিবেশ ব্যাহত হবে। কোনো স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ এমনভাবে চলছে না, আমরাও চলতে চাই না। আমরা একান্তরের মতোই স্বাধীনতাকে সর্বতোভাবে উদযাপন করতে চাই।

patoary

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন