ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

তনু হত্যা ও গণমাধ্যমের সাতপাঁচ

প্রকাশিত: ০৩:১৯ এএম, ২৮ মার্চ ২০১৬

“২০ মার্চ রাত সোয়া ১০টা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন কাজ সেরে সবে বাড়ি ফিরেছেন। এত রাতেও মেয়েটা ফেরেনি। কখনো এমন হয় না। ইয়ার হোসেন খুঁজতে বেরোলেন। তাঁকে বেশি দূর যেতে হয়নি। বাড়ির কাছেই কালভার্টের পাশে প্রথমে পাওয়া গেল মেয়ের এক পাটি জুতা, তারপর লাশ।"

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর বাবা ইয়ার হোসেন মেয়ের মৃত্যুর তিন দিন পর মেয়ের লাশ উদ্ধারের বর্ণনা দেন এভাবেই।

ইয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী। সেদিন আমার ডিউটি ছিল বেলা দুইটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। রাত সোয়া দশটায় সাইকেলে করে বাসায় ফিরলাম। দেখি, তনুর মা মেঝেতে মন খারাপ করে বসে আছে। বলল, মেয়ে বাসায় ফেরেনি। আমার প্রতিবেশী ক্যান্টনমেন্ট বালক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিকদার কামাল। আমি বাসা থেকে বের হয়ে আগে তাঁকে বিষয়টি জানাই। এরপর টর্চলাইট নিয়ে মেয়ের খোঁজে বের হই। বেশি দূর যাইনি। বাসার কাছেই একটি কালভার্ট আছে। আমি কালভার্টের পাশে টর্চলাইটের আলো ফেললাম। দেখি আমার মেয়ের একটি জুতা পড়ে আছে। আমি চিৎকার দিয়ে কালভার্টের পাশের নিচের অংশে নেমে যাই। আমার গলা শুনে ছোট ছেলে রুবেল বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। ১৫ থেকে ২০ গজ দূরে ওর মোবাইলটা পড়ে ছিল। আমি খুঁজতে খুঁজতে এগোই। একটু উঁচু জায়গায় জঙ্গল ও গাছগাছালির মধ্যে তনুকে পেলাম। গাছের তলায় ওর মাথা দক্ষিণ দিকে আর পা উত্তর দিকে পড়ে আছে। মাথার নিচটা থেঁতলে গেছে। পুরো মুখে রক্ত আর আঁচড়ের দাগ। আমরা পাঁচজন মিলে ওকে সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) নিয়ে যাই।’

ইয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘আমার মেয়ে দুইটা টিউশনি করত। এক দিন পর পর যেত। সাড়ে চারটার দিকে যখন বেরোত, ওর মা আনোয়ারা বেগম এগিয়ে দিত। ফেরার পথেও ওর মা কিছু দূর গিয়ে নিয়ে আসত। ওই দিন তনু ওর মাকে বলেছিল, সে একাই আসতে পারবে। এখানে থেকে আমার মেয়েটা স্কুল ও কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছে। আমি এখানে ৩১ বছর চাকরি করি। সাত-আট বছর ধরে কোয়ার্টারে থাকি। নিরাপদ এলাকা। কারা ওকে মেরেছে? এখন এ নিয়ে কী বলব? আল্লাহ দেখেছেন। আমি এর উপযুক্ত বিচার চাই।’

বাবার জবানিতে নিখুঁত পরিপাটি বিস্তারিত বর্ণনা ছাপা হয় ২৫ মার্চের দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা প্রথম আলো’তে। প্রতিবেদনের একটি অংশে উল্লেখ করা হয় ‘মেয়ের মৃত্যুর তিনদিন পর প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন বাবা।` প্রশ্ন জাগে মেয়ের মৃত্যু শোকে ধাতস্থ হয়ে বাবার মুখ খোলার আগ পর্যন্ত যেন তনুর মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি গণমাধ্যম। আর সে কারণেই ২০ মার্চ ঘটে যাওয়া বর্বরতার সাক্ষী তনুর ক্ষত বিক্ষত নিথর দেহ সংবাদ মূল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। নাকি বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন?

সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা-ডিজিএফআই এর প্রদত্ত সংবাদ প্রকাশ করে অথবা প্রকাশে বাধ্য হয়ে ভুল করেছি স্বীকার করায় ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের নাস্তানাবুদ পরিণতি দেখে ‘ক্যান্টনমেন্ট সংশ্লিষ্ট খবর প্রকাশের ভুল করতে চায়নি হয়তো দেশের বহুল প্রচলিত সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলগুলো। আবার এও হতে পারে, প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় অসংখ্য ধর্ষণের ভিড়ে ঘটনাটি ধর্ষিত হয়ে মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল সাদাকালো ছাপার অক্ষরে।  আর তথাকথিত নৈতিকতার প্রশ্নে টিভি স্ক্রিনেতো ধর্ষণ হত্যার ঘটনাকে কভারেজ দেয়া চলে না। তাছাড়া তনু কেইবা? একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণির মেয়েরাতো ধর্ষণ হত্যার শিকার হতেই পারে। তারা তো অর্থের সুরক্ষা বর্মে আবৃত নয়। আর তাদের সাথে একটু ‘অমন’ করলে উপরমহলের ফোন তদবিরেরও কোন ভয় থাকে না।

অথচ তনু হত্যা ঘটনার মাত্র ৭২ ঘন্টা পর কোন এক সকালে হঠাৎ করেই যেন গণমাধ্যম সোচ্চার হয়ে উঠলো তনু হত্যার বিচার দাবিতে। আবারো প্রশ্ন জাগে রাতারাতি কী ঘটলো যে ক্যান্টনমেন্টের ক্ষমতাকে এক রকম বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তনু হত্যাকাণ্ডকে মিডিয়া এজেন্ডায় স্থান করে দিল?

উত্তর আপনার আমার সবার জানা। উত্তর সামাজিক মাধ্যমের তৎপরতা। এবং ন্যায়ের দাবিতে সোচ্চার জনসাধারণের সমন্বিত বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে তনু হত্যাকাণ্ড পাবলিক এজেন্ডায় পরিণত হওয়া। আর যেই না পাবলিক এজেন্ডা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠতে শুরু করেছে অমনি গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে দায়িত্বশীল তৎপর। পাবলিক এজেন্ডা মিডিয়া এজেন্ডা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ন্যায় বিচারের প্রশ্নে। কিন্তু প্রশাসন এখনো দ্বিধান্বিত। এমনকি নিউজ চ্যানেল ৭১ এর টকশোতে ঘটনার পাঁচদিন পর কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার টেলিফোনে জানান, “তনুকে ধর্ষণ করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে আরো সময় লাগবে।" এমন কি সীমাবদ্ধতার অজুহাত দেখিয়ে বলেন, “অপরাধীরা তো আর পুলিশকে জানিয়ে অপরাধ করে না।"

অপরাধীকে নিশ্চিতভাবে সনাক্তকরণে সময় লাগতেই পারে। কিন্তু প্রশাসনের এমন বক্তব্যে আবারো প্রশ্ন জাগে অপরাধী খোঁজার সদিচ্ছা নিয়ে। আর ভয় হয় কখন যেন বলে বসে “তনুকে হত্যাই করা হয়নি।"

সামাজিক মাধ্যমের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের ফলে যখন অসংখ্য মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে, গণজাগরণ মঞ্চের জনতা রোডমার্চের ডাকে পথে নেমেছে তখন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন সাতদিনের মাঝে দোষী সনাক্ত করার আশ্বাস দেয়। আর তনু হত্যার বিচারের দাবিতে আপামর জনসাধারণ যখন তোলপাড় করছে রাজপথ তখন নিশ্চয়ই খুব শিগগিরই আমাদের সুশীল সমাজের সুধীজনেরাও তাদের বিশেষ মূল্যবান বক্তব্য দিয়ে টিভি নিউজগুলোকে সমৃদ্ধ করবে বৈকি।

অনেক প্রশ্ন করলাম। উত্তর খুঁজতে যাইনি। কারণ জানি আমার প্রশ্নের সব উত্তরই বারবার ধর্ষিত হয়, হত্যার কবলে পড়ে। তারপরেও অনুমতি নিয়ে শেষ প্রশ্নটি করতে চাই-গণমাধ্যম কি কেবল বাণিজ্যিকীকরণের জোয়ারে পাবলিক সেন্টিমেন্ট নিয়ে এজেন্ডা-এজেন্ডা খেলায় মেতে থাকবে? প্রশাসন কি ঠুনকো ভাবমূর্তির মিথ্যা গ্রহণযোগ্যতা টেকানোর স্বার্থে উদ্ভট প্রলাপ বকে যাবে? ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সাগর রুনির খুনিদের গ্রেপ্তার করার আশ্বাসের মতো ৭দিন বা আরো কোনো নতুন আশ্বাস দিয়ে যাবে প্রশাসন? নাকি প্রশাসন বহুল প্রচলিত সাধারণের চিন্তা-আর্মিতো আর্মি’কে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দোষীকে এলিয়েন আর ক্যান্টনমেন্টকে ভিন্ন বিপদসংকুল গ্রহ হিসেবে প্রতিপন্ন করে ব্যক্তির দায় সমষ্টির কাঁধে চাপাবে?

আমি উত্তর জানতে চাই না।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন