আসুন এবার বাস্তবে ফিরি
হুজুগে বাঙালি নামটা যে আসলে কে দিয়েছে, মাঝে মধ্যে জানতে খুব ইচ্ছে হয়। কথাটা যে সর্বৈব সত্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাঙালি নন ইস্যুকে ইস্যু বানায়। আবার ইস্যুকে ফেলে রাখে অনেক দূরে। যথাযথ ইস্যু ফেলে সে দিকে ফিরেও তাকাবে না। বাঙালিকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা যেদিকে ইচ্ছা, বাঁশি বাজিয়ে সেদিকে নিয়ে যেতে পারেন।
অনেক কঠিন, অথচ খুবই বাস্তবসম্মত কথা। অনেকেই আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন। কেউ কেউ বিরোধিতাও করতে পারেন; কিন্তু একটু চোখ-কান খুলে চারদিকে তাকালেই বুঝে উঠতে পারবেন কথাটা কতোটা সত্যি।
শুধু একটা উদাহরণ দেই। বাঙালিই নয় শুধু, সারা বিশ্বেরই প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিবাদের জায়গা এখন রাজপথ থেকে সরে এসে দাঁড়িয়েছে ফেসবুকের পাতায়। কোনো কিছু নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রথমে তারা ফেসবুক জুড়ে ঝড় তুলবে। এরপর এই ঝড়ের হয়তো একটি-দুটি রাজপথে নেমে আসে।
তো বাঙালিও ঝড় তুলতে শুরু করে দিয়েছিল। ২৪ মার্চ রাত ১২টা থেকে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের কাছে শ্বাসরূদ্ধকর ম্যাচে ১ রানে হারের পর থেকেই ফেসবুক জুড়ে হাহাকার আর কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা। বাংলাদেশে ব্যবহারকারীর ৯৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবেই ফেসবুকে নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন এই ম্যাচটি নিয়ে।
এবার আসা যাক ফেসবুকের বাইরে। বাংলাদেশের হারের পর রাত ১২টায় লোকাল বাসে উঠে বসলাম বাসায় যাবো। বাসের প্রতিটি যাত্রীর মুখেই একই কথা। কিভাবে যে হারলো বাংলাদেশ! ‘ইস’, ‘যদি’র আফসোসে পুড়ে মরছে যেন সবাই। পরদিনও কোথাও বাদ নেই। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, চায়ের দোকান, অফিস-আদালত- সবার মুখেই এই এক আলোচনা। এক ক্রিকেটই দখল করে নিয়েছে আমাদের পুরোটা দিন, ২৪টি ঘণ্টা। যেন জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এটা। একবেলা না খেয়ে থাকা যাবে; কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত এসব নিয়ে আলোচনা, চিন্তা-ভাবনা না করলেই যেন নয়।
এক ক্রিকেটের দিকে মুখ ফেরাতে গিয়ে বাঙালি আসলেই ইস্যু থেকে অনেক দুরে সরে এসে দাঁড়িয়েছে। যে জাতিকে প্রতিবাদি জাতি হিসেবে সারা বিশ্ব চেনে, যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দেয়, যে জাতি স্বাধীনতার জন্য ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে শহীদ হতে পারে, যে জাতি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলতে পারে- তারা আজ নন ইস্যুকে আঁকড়ে ধরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
তথাকথিত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালারা বাঁশি বাজায় আর আমাদের হুজুগে বাঙালি নন ইস্যুর দিকেই ছুটতে থাকে সবচেয়ে বেশি। যেন এটাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হ্যাঁ এটা সত্যি, ক্রিকেট আমাদের আবেগের বড় একটি স্থান। তাই বলে, এটা কখনও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে না।
এই হুজুগে বাঙালিকে তাদের প্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফির একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। ‘দেশের তুলনায় ক্রিকেটটা অতি ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার। একটা দেশের অনেক ছোট ছোট মাধ্যমের একটা হতে পারে খেলাধুলা; তার একটা অংশ ক্রিকেট। ক্রিকেট কখনও দেশপ্রেমের প্রতীক হতে পারে না। সোজা কথায়- খেলাধুলা হলো বিনোদন।’ (দ্রষ্টব্য: মাশরাফি, দেবব্রত মুখোপাধ্যয়, অধ্যায়: বলছেন মাশরাফি)।
অথচ এই ক্রিকেটীয় বিনোদনটাই এখন প্রধান ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, অন্যসব গৌণ। এ বিষয়টাতেই অনেক বেশি চিন্তিত মাশরাফি। একই বইয়ের একই অধ্যায়ে লেখকের প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি বলেছেন, ‘খেলা কখনও একটা দেশের প্রধান আলোচনায় পরিণত হতে পারে না। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যা সমাধান বাকি। সেখানে ক্রিকেট নিয়ে পুরো জাতি, রাষ্ট্র এভাবে এনগেজ হয়ে পড়তে পারে না। আজকে আমাদের সবচেয়ে বড় তারকা বানানো হচ্ছে, বীর বলা হচ্ছে, মিথ তৈরি হচ্ছে। এগুলো সব হলো বাস্তবতা থেকে পালানোর ব্যাপার।’
মাশরাফি কতটা বাস্তববাদী, তার এ কথাটা শুনলেই তা বোঝা যায়। সত্যিই তো তথাকথিত হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা এক ক্রিকেটীয় বাঁশি দিয়েই আমাদেরকে বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে পালিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ দেশের কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়ে গেছে। যেদিকে মানুষের চোখ দেয়া প্রয়োজন। বাস্তবে ফিরে এসে জীবনের অনেক সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন।
মাশরাফির আরেকটা উপলব্ধি শুনলে অবশ্যই হতবাক হতে বাধ্য আমি-আপনি, সবাই। একই বইয়ের একই অধ্যায়ে মাশরাফি বলেছেন, ‘আমাকে প্রশ্ন করুন, তারকা হলেন একজন ডাক্তার। আমি ক্রিকেটার, একটা জীবন কি বাঁচাতে পারি? কক্ষনো না। একজন ডাক্তার পারেন। কই, দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের নামে কেউ তো একটা হাততালিও দেয় না! তাদের নিয়ে মিথ তৈরি করুন, তারা আরও পাঁচজনের জীবন বাঁচাবেন। তারাই তারকা। তারকা হলেন লেবাররা, দেশ গড়ে ফেলছে। ক্রিকেট দিয়ে আমরা কি বানাতে পারছি? একটা ইটও কি ক্রিকেট দিয়ে তৈরি করা যায়? একটা ধান জন্মায় ক্রিকেট মাঠে? জন্মায় না। যারা এই ইট দিয়ে দালান বানায়, যারা কারখানায় আমাদের জন্য এটা-ওটা বানায় বা ক্ষেতে ধান জন্মায়, তারকা হলেন তারা।’
আমারও প্রশ্ন, ভারতের বিপক্ষে ওই ১ রান করে যদি বাংলাদেশ ঐতিহাসিক জয়টা পেয়ে যেতো, তাহলে কী কখনও কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনুর প্রতি নরপিচাশের যে উল্লাস, তা থামাতে পারতো? বাঁচাতে পারতো ২০ বছরের ফুটফুটে মেয়েটিকে? যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। নিজের পড়ার খরচ নিজে নির্বাহ করার জন্য টিউশনি করতো। আবার ছিল সংস্কৃতিমনাও। ছিলেন থিয়েটারের সদস্য। ক্রিকেট কী পারবে আবারও হাস্যোজ্জ্বল চঞ্চল মেয়েটিতে তার মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে?
কিংবা ক্রিকেটের যে এত এত সাফল্য, এত এত উম্মাদনা। সেটা কী পারবে কখনও একটা ব্যাংক ডাকাতি রূখে দাঁড়াতে? বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা লোপাটের মত ভয়াবহ ঘটনা, যে ঘটনায় স্বয়ং গভর্নর আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়েছে, সেটাকেই কিভাবে বেমালুম ভুলিয়ে দিলো ক্রিকেট! অথচ, কতবড় জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এটা। সারা বিশ্বেই তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল।
ক্রিকেট কী পারবে ঢাকা শহরের যানজট কমিয়ে দিতে? ১০ মিনিটের রাস্তা পেরোতে লাগে ২ ঘণ্টা, কখনও কখনও আরও বেশি। হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই যানজটের কারণে। ক্রিকেট কী পারবে এই কর্মঘণ্টাগুলো ফিরিয়ে দিতে? আমরা বাঙালিরা সত্যিই হুজুগে। এক ক্রিকেট নিয়েই বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা। একটা ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকি।
অথচ, মাশরাফির কথাটাই যদি একবার মানতেন সবাই, তাহলে আমাদের মানসিকতা বদলে যেতো। বদলে যেতো পুরো দেশও। কী বলেছিলেন মাশরাফি? শুনুন তার মুখ থেকেই, ‘আমি বলি, এই যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুতু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই প্রবল এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো। আমি তো এই মানুষদের দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটাই বুঝি না!’ (দ্রষ্টব্য: মাশরাফি, দেবব্রত মুখোপাধ্যয়, অধ্যায়: বলছেন মাশরাফি)।
মাশরাফি তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেম নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। আবার দেখুন, তাসকিনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আইসিসি এবং ভারতের বিপক্ষে সারাদেশ তোলপাড়। অথচ সেই তাসকিনই কি না সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার হলেন। যারা তাকে নিয়ে দিনকে রাত, রাতকে দিন বানিয়ে ফেলছেন, তাদের তাসকিন দেখিয়ে দিলেন, এখন ক্রিকেটের দিকে নয়, তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচার হোক, অপরাধী উপযুক্ত শাস্তি পাক- এটাই হোক আমাদের জন্য বড় ইস্যু।
সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে চাইলে হুজুগের চেয়ে বাস্তবতাতেই থাকা বেশি জরুরি। হাজারো জাতীয় সমস্যা আছে। এক একজন ব্যক্তি পর্যায় থেকে যদি নিজেকে পরিবর্তন শুরু করে দিতে পারি, সস্তা আবেগে ভেসে না গিয়ে সময়টা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে সত্যি দেশ বদলে যাবে। ক্রিকেটীয় উম্মাদনা জাতি হিসেবে আমাদের থাকবে; কিন্তু সেটা যেন হয় নির্দিষ্ট পরিসরে, নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে। তাহলে বাকি সময়টা আমরা কাজে লাগাতে পারবো এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো। সুতরাং, আসুন হুজুগ ভুলে, বাস্তবতায় ফিরি।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, জাগো নিউজ
এইচআর/আরআইপি