মানুষ কী চায়, আন্দোলন না নির্বাচন?
দুর্গাপূজার পর সরকার পতনের আন্দোলনের শেষ ধাপ শুরু হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হলেও সরকার বা সরকারি দল সেটা নিয়ে খুব উদ্বেগে আছে বলে মনে হয় না। বরং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের কাছে ভোট চাইতে শুরু করেছে। দলের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল স্লোগান হচ্ছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন- এমন অবস্থানে অবিচল রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যথাসময়ে, যথানিয়মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করছে নির্বাচন কমিশনও। এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, কোন দল এলো, আর কোন দল এলো না সেটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ হবে তা হলো- ভোট যদি ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হয়, যদি ভোটারদের উপস্থিতি ভালো থাকে, তারা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে তাহলেই ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’ হয়েছে বলা যাবে বলে মনে করেন ইসি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বিভাগীয় কমিশনার, উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্বাচনসংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা অনুষ্ঠানে এরকম মনোভাবই প্রকাশ করেছেন তিনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের দায়িত্ব পালনে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দলীয় চিন্তাভাবনার ঊর্ধ্বে থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, প্রশাসনে বা সরকারে পুলিশ ও নির্বাহী পরিষদের ভূমিকা এবং গুরুত্ব অপরিসীম। সরকার বলতে আমরা পুলিশ ও ডিসিকেই বুঝি। কাজেই আপনারাই সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, আপনাদের চিত্তে তা ধারণ করতে হবে। নির্বাচন খুব ঘনিয়ে এসেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচন আয়োজন কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ, চাইলাম হয়ে গেলো, এরকম নয়। যেহেতু নির্বাচনের দায়িত্ব আপনাদেরও, সেহেতু নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে, কিন্তু যেভাবেই হোক দেশে নির্বাচন হবেই- এমন দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দেবে। আমার একটাই কথা উন্নয়ন চাইলে নৌকায় ভোট দেবেন, আর দেশের ধ্বংস চাইলে বিএনপি-জামায়াতকে বেছে নেবেন।
১৪ অক্টোবর বিকেলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন কাওলা সিভিল এভিয়েশন মাঠে আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই নৌকায় ভোট দিয়ে আবারো যেন দেশবাসীর সেবা করতে পারি। আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি নৌকায় ভোট দেন, আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেন। উপস্থিত জনতাকে ওয়াদা করিয়ে তিনি বলেন, ওয়াদা চাই আপনারা কী দেবেন নৌকা মার্কায় ভোট? উপস্থিত সবাই দুই হাত উঁচিয়ে নৌকায় ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, শুধু নিজে দিলে হবে না- পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, দেশে-বিদেশে সবার কাছে প্রচার করতে হবে; দেশের উন্নয়নে একমাত্র আওয়ামী লীগই আছে, আওয়ামী লীগই গণতন্ত্র দিতে পারে।
বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে চায় অভিযোগ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে কী আসবে না- তারা দ্বিধাদ্বদ্বে ভোগে। কারণ তারা নির্বাচন করবে, তাদের নেতা কে, তাদের প্রধানমন্ত্রী কে হবে? ওই দুর্নীতিবাজ, পলাতক (তারেক রহমান) আসামি? না এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী (খালেদা জিয়া)? তাহলে কে করবে? এজন্যই তাদের চেষ্টা, নির্বাচন বানচাল করার।
বিএনপি বিদেশে ধরনা দেয়, তা কাজে লাগবে না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা বিদেশে, এখানে-সেখানে ধরনা দেয়। ওসব ধরনা কোনো কাজে লাগবে না। জনগণের শক্তি, বড় শক্তি। আমি জনগণের শক্তিতেই বিশ্বাস করি। জনগণের ওপরই আমার আস্থা। ১৫ আগস্ট বাবা, মা, ভাই সব হারিয়েছি। আমি সব হারিয়ে এসে পেয়েছি এই বাংলাদেশের জনগণকে। আজ বাংলাদেশের জনগণই আমার পরিবার। বাংলাদেশের জনগণই আমার আপনজন। কাজেই তাদের জন্য কাজ করা- এটা আমি আমার কর্তব্য, দায়িত্ব হিসেবেই নিয়েছি। জনগণ ভালো থাকবে, সুখে থাকবে- সেটাই আমি চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের একটাই লক্ষ্য- বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা আমরা পেয়েছি। আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় না থাকে, অন্য কেউ আসে, তাহলে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে।
নৌকায় ভোট দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, নৌকা মার্কা স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়েছে, মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়িয়েছে, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, উন্নয়ন দিয়েছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিয়েছে, পানির সমস্যা সমধান করেছে, যোগাযোগ সহজ করেছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, ১০০টা অর্থনৈতিক অঞ্চল করেছে, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে।
বিএনপি সরকার পতনের হুমকি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিচ্ছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। দেশের মানুষ আন্দোলন বা অন্য কোনো অস্থিরতা চায় না। মানুষ ভোট দিতে চায়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়। সরকার যদি নির্বাচন করে ফেলে এবং বিএনপি এবারও নির্বাচনের বাইরে থাকে, তাহলে দলটি বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অন্য বারের মতো চূড়ান্তপর্বে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হবে বলেই মনে হচ্ছে।
আজকের ঢাকা বদলে যাওয়া একটি শহর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ঢাকা শহরে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম হিসাব করে আমরা হাসপাতাল তৈরি করে দিয়েছি। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছি। ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল চালু হয়েছে, এটা মতিঝিল পর্যন্ত যাবে। পরবর্তী ধাপে মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত মেট্রোরেল চলবে। পাতাল রেলের প্রকল্পের কাজ শুরু করেছি। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছি। ঢাকায় সার্কুলার ওয়াটারওয়ে নির্মাণের পদক্ষেপ নিয়েছি। পুরো ঢাকা ঘিরে এলিভেটেড সার্কুলার রোড করে দেব। কোনো জমি অধিগ্রহণ না করে, পুরো ঢাকা ঘিরে হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। বাকিটুকু আমরা করে দেব। ঢাকার যেখানে রেলগেট আছে, সেখানে যানজট হয়। কাজেই ওভারপাস করে দেব। যাতে যোগাযোগের আর অসুবিধা না হয়।
রেলের জন্য আটকে থাকতে না হয়। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রায় শেষের পথে। পূর্বাচল এক্সপ্রেসেওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ দিয়েছেন বলেই। তিনি আরও বলেন, বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু হচ্ছে, এখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। আন্তর্জাতিকভাবে যোগাযোগ হবে। কক্সবাজারে সর্বাধুনিক বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানের আমরা করে দিচ্ছি। চট্টগ্রাম, সিলেটও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আমাদেরই করা। কাজেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, একমাত্র নৌকা পারে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপির অনশন কর্মসূচির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আজ দেখি, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিএনপি নেতারা অনশন করেন। আমি জিজ্ঞেস করি, তারা কয়টা থেকে অনশন শুরু করেছিলেন? বাসায় কী দিয়ে নাশতা করে এসেছেন? বাড়িতে কী দিয়ে ভাত খাবেন? কয় ঘণ্টার অনশন? নাটক করারও একটা সীমা থাকে। তারা এ নাটকই করে যাচ্ছে। বিএনপি নেতাদের প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, তারেক রহমানের মা তো অসুস্থ। আপনারা অনশন করেন। তাহলে ছেলে কেন মাকে দেখতে আসে না। এটা কেমন ছেলে, সেটা আমার প্রশ্ন।
বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা নাকি আমাদের উৎখাত করে দেবে। সময় দিয়েছিল ১০ ডিসেম্বর। বিজয়ের মাসে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করবে? যে সরকার জনগণের রায় নিয়ে বারবার নির্বাচিত হয়েছে। দেশের মানুষ এটা মেনে নিতে পারে না।
আল্লাহর মাইর, দুনিয়ার বাইর মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছিল। তখন আমাকে ইঙ্গিত করে বলেছিল আওয়ামী লীগ ১০০ বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। বলেছিল, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরে থাক বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারবে না। কিন্তু কি হয়েছে তা সবাই জানে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির আহ্বায়ক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল ‘গ্রাম হবে শহর’। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মূল স্লোগান হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ইশতেহার দিয়ে আসছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
অতীতে আমরা কী কী করেছি, আমাদের কী কী অর্জন রয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হয়। এবারের নির্বাচনী স্লোগানের মূল প্রতিপাদ্যে যুব সমাজের কর্মসংস্থান থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই বলতো অবকাঠামো নেই, রাস্তাঘাট নেই, এ দেশে শিল্প হবে না। বিদেশিরা আসবে না, বিনিয়োগ করবে না। আমরা আগে অবকাঠামো করেছি, রাস্তাঘাট করেছি। শিল্পায়নের পথে সব বাধা দূর করা হয়েছে। বিনিয়োগের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। এখন আমাদের লক্ষ্য হবে শিল্প কারখানা স্থাপন করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে দেশে শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করা। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে মানুষের আয় বাড়ানো।
স্মার্ট বাংলাদেশের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির আশাবাদ ব্যক্ত করে ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল উন্নত জীবনযাপন। উন্নত জীবনযাপনের জন্য উৎপাদন খাত বাড়ানো, শিল্প কারখানা গড়ে তোলা। তার জন্য যা করার সবই হয়েছে। শিল্পায়নের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের অর্থনীতি চাঙা হবে।
বিএনপির সরকার পতনের হুমকি দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিচ্ছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। দেশের মানুষ আন্দোলন বা অন্য কোনো অস্থিরতা চায় না। মানুষ ভোট দিতে চায়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়। সরকার যদি নির্বাচন করে ফেলে এবং বিএনপি এবারও নির্বাচনের বাইরে থাকে, তাহলে দলটি বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অন্য বারের মতো চূড়ান্তপর্বে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হবে বলেই মনে হচ্ছে।
১৬ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস