সবাইকেই সংযত হয়ে কথা বলতে হবে
বন্দুকের গুলি আর মুখের কথা কখনো ফেরানো যায় না। আগে তবু মুখের কথা বলে অস্বীকার করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন আর অস্বীকার করারও সুযোগ নেই। অডিও বা ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলেই শেষ। মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু তার মুখের কথা। বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই। খালি মুখের কথার কারণে গত ১৫ বছরে কত প্রভাবশালীকে ধরাশায়ী হতে দেখেছি আমরা। মন্ত্রী থেকে শুরু করে মেয়র, স্থানীয় নেতা- কত হিরো জিরো হয়ে গেল নিজের কথার কারণে। তাই আমাদের সবারই কথা বলার ব্যাপারে সংযত থাকা উচিত।
মুখ খোলার আগে দশবার ভাবা উচিত। এটা সব মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে রাজনীতিবিদদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। কারণ রাজনীতিবিদরা প্রতিদিনই কথা বলেন, কথা বলতে হয়। তাদের কথা অসংখ্য মানুষ শোনে, বিশ্বাস করে, তাদের অনুসরণ করে। রাজনীতিবিদদের কথা বিপুলসংখ্যক মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। শুধু কথার ফাঁদে ফেলে মানুষের ভোট পাওয়া যায়, আবার কথার কারণেই ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। কথার এ গুরুত্বটা সবাই জানেন না বা বোঝেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই গুরুত্বটা বুঝেছেন ভালো করে। কথা বলার বিপদটাও উনি টের পেয়েছেন। তাই তো সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনাদের সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে। আক্রমণকারী নয়, সংযমী হয়ে থাকতে হবে। মিটিং-মিছিলে সংযত হয়ে কথা বলতে হবে।’
ক্ষসতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের এই উপলব্ধি প্রশংসার যোগ্য। নির্বাচন সামনে রেখে সবাইকে সংযত হয়ে কথা বলা উচিত। পচা শামুকে পা কাটার মতো, একটু উল্টাপাল্টা কথা আপনার অনেক অর্জন ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারে। কিছু কিছু বিষয় আসলে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যেমন ধরেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতির যে টালমাটাল অবস্থা তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
নির্বাচনের আগে সরকারের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা এখন দ্রব্যমূল্য। আপনি যত আন্তরিকই হোন, এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তাই আপনাকে কথা বলতে হবে সাবধানে। মানুষের কষ্টটা দরদ দিয়ে ফিল করতে হবে। আপনি এমন কিছু বলতে পারবেন না, যা মানুষের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যার, সেই বাণিজ্যমন্ত্রী যদি বলেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়; তখন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। মানুষ মনে করে সরকার অসহায়, সিন্ডিকেট সরকারের চেয়েও বড় ক্ষমতাশালী।
সরকারের অসহায়ত্ব মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা দিতে পারে। তাই কথা বলার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। বিনয়ী হতে হবে। নত হয়ে মানুষকে বলতে হবে, ‘আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। কিন্তু পুরোপুরি সফল হতে পারছি না। কিন্তু আমরা আপনাদের কষ্টটা অনুভব করছি এবং সবসময় আপনাদের পাশে আছি।’ কিন্তু আপনি যদি নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে সিন্ডিকেটের ওপর দায় চাপান, নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন; তাহলে মানুষ আপনার ওপর আস্থা রাখতে পারবে না।
এসব কারণেই হয়তো ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের সংযত হয়ে কথা বলতে বলেছেন। কিন্তু শুধু কর্মীরা বা নেতারা সংযত হয়ে কথা বললে হবে না। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, সংযত থাকতে হবে। সবচেয়ে বেশি সংযত থাকতে হবে, যিনি সবচেয়ে বেশি কথা বলেন, তাকে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কথা বলতেন খুবই কম, কালেভদ্রে। জাতির জরুরি তিনি মুখ খুলতেন। কিন্তু তার উত্তরসূরি ওবায়দুল কাদের কথা বলেন প্রতিদিন। কোনো ইভেন্ট না থাকলে বাসায় বসে ভিডিও করে তা গণমাধ্যমে পাঠিয়ে দেন।
ওবায়দুল কাদের প্রতিদিন কথা বলেন, বেশি কথা বলেন, তা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। ওবায়দুল কাদের একসময় সাংবাদিকতা করতেন। লেখালেখিও করতেন। তার লেখা বেশ কিছু বই পাঠকপ্রিয় হয়েছে। তিনি কাব্যিক ঢঙে কথা বলেন। শুনতে খারাপ লাগে না। কিন্তু কীভাবে বলছেন, তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কী বলছেন। রাজনীতিবিদরা কী বলছেন সেটা নাকি সবসময় ধরতে হয় না। পলিটিক্যাল রেটরিক বলেও একটা কথা আছে। মেঠো বক্তৃতা সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্যই করা হয়। কিন্তু মেঠো বক্তৃতারও একটা সীমা থাকে। সীমা লঙ্ঘন করলে তা রাজনীতির শিষ্টাচারকেও ছাড়িয়ে যায়।
‘তলে তলে আপস’এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পাবলিকে খায় বলেই তিনি এসব কথা বলেছেন তিনি। ‘পাবলিক খায়’ এমন কথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে বলতে হবে কেন। তিনি তো ফুটপাতের মলম বিক্রেতা নন বা হিরো আলম নন। পাবলিক কী খায় সেটা বিবেচনা করে তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কথা বলবেন না। পাবলিক যাতে ভালো কিছু খেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাই তার দায়িত্ব।
ওবায়দুল কাদের এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগ যখন টানা ক্ষমতায় থাকে, তখন টানা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করায় কোনো কৃতিত্ব নেই। ওবায়দুল কাদেরের আসল গৌরব তিনি ছাত্রলীগের দুঃসময়ের কান্ডারী। ৭৫এর পর যখন দেশে আওয়ামী লীগ খুঁজে পাওয়া ভার ছিল, তখন ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের হাল ধরেছিলেন অসীম সাহসিকতায়।
ওবায়দুল কাদেররা ছাত্রলীগের হাল ধরেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে গণতন্ত্রের লড়াইটা চালাতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। এটা মানতেই হবে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে সফল ও ভাইব্র্যান্ট মন্ত্রীর নাম ওবায়দুল কাদের। শারীরিক কারণে এখন হয়তো আগের মত সক্রিয় থাকতে পারেন না। কিন্তু একসময় ওবায়দুল কাদেরের সারপ্রাইজ ভিজিট প্রশাসনে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। তিনি হেঁটে সমস্যা চিহ্নিত করতেন, সমাধান করতেন।
আওয়ামী লীগের এই দুর্দিনের কান্ডারী যখন বেফাঁস কথা বলেন, তখন শুনতে ভালো লাগে না। সংযত হয়ে কথা বলার যে পরামর্শ তিনি নেতাকর্মীদের দেন, তা এখন সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য তার নিজের ক্ষেত্রেই। কদিন ধরেই তিনি জনসভায় গেলেই স্লোগান দেন ‘খেলা হবে’। স্লোগানটি নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমানের। কিন্তু এখন তা ওবায়দুল কাদেরের হয়ে গেছে। সমস্যা হলো শামীম ওসমানের কণ্ঠে যে স্লোগান মানায়, ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠে তা বড্ড বেমানান।
তবে ‘খেলা হবে’ স্লোগানকেও ছাড়িয়ে গেছে তার ‘তলে তলে আপস’ তত্ত্ব। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশের চেয়ে বাইরের মানুষের টেনশন বেশি। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে। র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর এসেছে ভিসা নিষেধাজ্ঞা। এসব পদক্ষেপ সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এরই মধ্যে ওবায়দুল কাদের বললেন, ‘কোথায় নিষেধাজ্ঞা? কোথায় ভিসানীতি? তলে তলে আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরা আছি। শত্রুতা কারো সঙ্গে নেই। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, এমন ভারসাম্য সবার সঙ্গে করে ফেলেছেন, আর কোনো চিন্তা নেই। নির্বাচন হবে, যথাসময়ে হবে।’
ওবায়দুল কাদের হয়তো নেতাকর্মীদের চাঙা করতে এসব কথা বলেছেন। কিন্তু তলে তলে আপস করে ক্ষমতায় আসার আকাঙ্খা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্যের সাথে বেমানান। আওয়ামী লীগ ভারতের আশীর্বাদে ক্ষমতায় আছে, এমন একটা ধারণা তৈরির চেষ্টা আছে দীর্ঘদিনের। এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যদি বলেন, ‘আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরা আছি’ তাহলে সেই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অবশ্য পরে ওবায়দুল কাদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘ভারতের সহযোগিতায় ক্ষমতায় থাকব, এরকম উদ্ভট চিন্তা, আজব চিন্তা আমাদের মাথায় আসেনি। আমরা বুঝি সম্পর্কটা ভালো হলে অনেক দিক থেকেই ভালো।’
‘তলে তলে আপস’এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পাবলিকে খায় বলেই তিনি এসব কথা বলেছেন তিনি। ‘পাবলিক খায়’ এমন কথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে বলতে হবে কেন। তিনি তো ফুটপাতের মলম বিক্রেতা নন বা হিরো আলম নন। পাবলিক কী খায় সেটা বিবেচনা করে তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কথা বলবেন না। পাবলিক যাতে ভালো কিছু খেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাই তার দায়িত্ব। শুধু ‘খেলা হবে’ বা ‘তলে তলে আপস’ নয় ওবায়দুল কাদেরের বেফাঁস কথার তালিকা বহু লম্বা। সর্বশেষ তিনি বিএনপি নেতাদের মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে দিতে চেয়েছেন।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের সংযত হয়ে কথা বলার যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা এখন সবচেয়ে বেশি মেনে চলতে হবে তাকেই। কারণ তিনিই দলের মুখপাত্র, তিনিই নীতিনির্ধারক। তার একটি কথা দলকে অনেক এগিয়ে যেমন নিতে পারে আবার অনেক অর্জন নষ্টও করতে পারে।
১৫ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন বাংলা।
এইচআর/জিকেএস