অবাক কলকাতা ভ্রমণ!
‘হেই, তুমি এখনও ঘুমচ্ছো, কলকাতা কি যাওয়া লাগবে না?’ কিছুটা ধমকের সুরে।
‘হ্যাঁ ভাই যাবোতো।’ ঘুম কাতর কণ্ঠে।
‘আমি রাত সাড়ে নয়টার বাসের টিকিট কেটেছি। তোমার আর আমার। সরাসরি বেনাপোল চলে যাব। এখন যাচ্ছি ডলার কিনতে। এরপর অফিসে এক নজর দেখা করে রাত নয়টায় কল্যাণপুর কাউন্টারে থাকবো। ঠিক নয়টায় কিন্তু চলে এসো।’
‘জি ভাই, চলে আসবো। কিন্তু ভাই বাস ভালোতো।’
‘ইয়ার্কি পাইছো নাকি। এসি গাড়ি, ভিআইপি গাড়ি, ভালো না হয়ে পারে।’
দিনের শুরুটা হয়েছিল ঠিক এভাবেই। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সাংবাদিক সহকর্মী বড় ভাই রিপন ফোন দিয়ে এমনটাই বলেছিলেন। কিন্তু আমাদের চিরকুমার সংঘের সভাপতি রিপন ভাই বরুনাদের মত কথা রাখেননি। তিনি কাউন্টারে এসেছিলেন রাত সোয়া দশটায়। এসে জানালেন গাড়ি সাড়ে দশটায়। আর আমি বেকুবের মত নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে মশার খাবার হলাম অযথাই।
মনকে বুঝ দিলাম প্রথমবারের মত কলকাতা যাচ্ছি। মশাদের না হয় একটু ফ্রী খাবার দিয়ে গেলাম। তার উপর প্রথমবারের মত দেশের বাইরেও যাত্রা বটে। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সে বাস আসলো। কিন্তু বাসতো বেনাপোলের না, সাতক্ষীরার। রিপন ভাই জানালেন, সাতক্ষীরা থেকে নেমে বেনাপোল যাবেন। ভাবলাম রিপন ভাই অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে পরিপূর্ণ। এর আগে চার-পাঁচবার ভারত গিয়েছেন। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডেও তিনি ঘন ঘনই যান। তার প্রতি অগাথ বিশ্বাস নিয়েই বাসে উঠলাম।
‘একে ট্রেডার্স’ কোম্পানির বাস দেখেই কেমন যেন লাগলো। কারণ বাসের সবগুলো জানালার কাঁচই ছিল ভাঙ্গা, সূক্ষ্মহাতে সুপার গ্লু নামক পদার্থ দিয়ে অতি যত্ন করে জোড়া তালি দিয়ে মোড়ানো। ভয়ে ভয়েই উঠলাম। ওঠার পর রিপন ভাই গল্প জুড়লেন। এক পর্যায়ে জানালেন তার বংশের অধিকাংশ লোক মারা যায় রোড অ্যাক্সিডেন্টে।
এ শুনে আমার অন্তরাত্মা আবারও কেঁপে উঠলো। বললাম, ‘ভাই তাহলেতো আপনিও লিস্টে আছেন।’
‘হু, তাতো আছিই।’ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রিপন ভাই বললেন। এদিকে আমার মন বলছে না জানি কি আছে কপালে। ভাবলাম, লিস্টটা যদি আজকেই শুরু হয় তবে তো আমিও...।
জ্যামের রাস্তা, মোটামুটি ধীর গতিতেই চালাচ্ছেন। বেশ খুশিই হলাম। ড্রাইভার আমার মনের কথা বুঝতে পারছে। তাই তিনি আস্তে আস্তে সতর্কতার সঙ্গে চালাচ্ছেন। ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে বাস গাবতলি পাড় হলো। কিন্তু বাস তখনও ঠেলাগাড়ি গতিতে চলছে। হঠাৎ বাসের মধ্যে শোরগোল। কাহিনী জানার জন্য কান পাতলাম। জানতে পারলাম, বাস চল্লিশ কিলোমিটার গতি উঠলে বাসের ব্রেক কাজ করেনা। শুনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ ওষ্ঠাগত।
অবশেষে বাস ড্রাইভারের সঙ্গে যাত্রীদের তুমুল তর্ক বিতর্ক। যাত্রীদের এক দফা এক দাবি, এই বাসে তারা যাবেন না। বাস স্থির হয়ে বসে থাকলো প্রায় এক ঘণ্টা। বাকি যাত্রীরা সবাই কেউ সাতক্ষীরা, কেউ যশোর যাচ্ছেন, দেরি হলে সমস্যা নাই। আমাদের গন্তব্য কলকাতা। দায়িত্ব নিলেন রিপন ভাই। গিয়ে বললেন এই বাসে কে কে যেতে চান তারা বাসে ওঠেন। আর যারা যাবেন না তারা নেমে দাঁড়ান। পরের বাসে আসেন। দেখলাম সব যাত্রী যে যার মত উঠে নিজ নিজ আসনে বসলেন। রিপন ভাই ভাব নিয়ে এসে আমাকে বললেন, এর নাম হলো ‘ঠেলার নাম বাবাজী।’
এরপর একটু এগিয়ে আবার বাস স্থির। এবার কারণ জ্যাম। আর এর মধ্যে বাসের ক্ষিপ্ত লোকজন পারলে ড্রাইভার, হেলপার পাশাপাশি রিপন ভাইকেও পেলে ছিড়ে খায়। বাস নিয়ে নানা গবেষণা। হঠাৎই জানতে পারলাম আমাদের পেছনের আসনে এক লোক নাকি অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। পুরো ভাব নিয়ে ড্রাইভারকে বললেন ‘তোমার কাগজ পত্র দেখাও।’ তিনি কি সব দেখলেন। দেখার পর জানালেন গাড়ির তেলের টাঙ্কিতে সমস্যা। যে কোন সময় ব্লাস্ট হয়ে যেতে পারে। বিশাল জ্ঞানী লোক, কাগজ দেখেই টাঙ্কির সমস্যা বুঝে গেলেন।
শুরু হলো গুঞ্জন। কিছুক্ষণ পর সামনের এক যাত্রী জানালেন গাড়ির তেলের টাঙ্কিতে ফুটা, সব তেল পড়ে যাচ্ছে। এরপর একজন এসে বললেন, ‘বাসেতো টাঙ্কিই নাই ও চালায় কিভাবে?’ এদিকে বাস পড়ে আছে দীর্ঘ জ্যামে। কয়েকজন নিচে নেমে গেলেন বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে জানালেন বাসের চাকা পাংচার। বললেন, ‘একটু আগে কে যেন যেতে চাইলেন এখন কি যেতে চান।’ দেখি রিপন ভাই চুপচাপ কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে। আমি হাত তুলে জানালাম, আমি এই বাসেই যাব। ভদ্রলোক পুরো হতবাক।
তবে ভোগান্তির চরম সীমানায় পৌঁছলাম দীর্ঘ জ্যামে আটকে থেকে। সকাল সাতটার দিকে আমরা পাটুরিয়া ফেরিঘাটে পৌঁছলাম। এরপর বাস স্বাভাবিকভাবেই বাস চলতে লাগলো। অবশেষে দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে আসলাম সাতক্ষীরার নাভারণ। সেখান থেকে পুণরায় বাস যোগে বেনাপোল। কিন্তু এখানে এসেও মাথায় হাত। কয়েক হাজার লোক বর্ডার ক্রস করতে লাইনে দাঁড়িয়ে। অফিশিয়াল কার্যপ্রণালী সেরে ওপার যেতে যে পথ ১০ মিনিটে ফুরায় সেখানেই লাগলো প্রায় দেড় ঘণ্টা। তবে শত বিড়ম্বনার পর পৌঁছলাম দাদাদের শহর কলকাতায়।
বর্ডার পাড় হয়ে উঠলাম কলকাতার অটোতে। উদ্দেশ্য বনগাঁও রেইল স্টেশন। সেখান থেকে কাটলাম শিয়ালদা স্টেশনের টিকিট। রিপন ভাইয়ের সঙ্গে উঠলাম কলকাতার ট্রেনে। এ কামড়া ও কামড়া ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে দুই জনের দুটো সিট পেলাম অনেকটা ভাগ্যের জোরেই। দুপুর আড়াইটায় চলতে শুরু করলো ট্রেন। বনগাঁও থেকে শুরু করে চান্দপাড়া, ঠাকুর নগর, গবরডাঙ্গা, মসলন্দপুর, সংহতি, হাবরা, অশোক নগর, গুমা, বিড়া, দত্তপুকুর, বামনগাছি, বাড়াসাত, হৃদয়পুর, মধ্যমগ্রাম, নববাড়াক্কু, বিশরপাড়া কোদালিয়া, বিরাটী, দুর্গানগর, দমদম ক্যান্টনমেন্ট, দমদম জংশন হয়ে মোট ২২টি স্টেশন ঘুরে আমরা নামলাম বিধাননগর। শিয়ালদার আগের স্টেশনে, কারণ সময় কম থাকার কারণে অ্যাক্রোডিটেশন কার্ড আনতে গেলাম। বিধাননগর থেকে ট্যাক্সিতে রওয়ানা হলাম স্বপ্নের ইডেন গার্ডেনে।
ট্রেন আর ট্যাক্সিতে কলকাতার কিছুটা দেখলাম। অনেকটা পুরনো ঢাকার মতই। সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায় পৌঁছলাম ইডেনে। এখানে এসে কিছুটা জাঁকজমকের ছোঁয়া পেলাম। বিশ্বকাপ উপলক্ষে পুরো এলাকাকে সাজানো হয়েছে। এরপর অ্যাক্রোডিটেশন কার্ড সংগ্রহ করে ঢুকলাম ইডেনের মাঠে। এদিকে ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। আগের দিন থেকে খাওয়ার সুযোগই হয়নি। কিন্তু ইডেনে ঢোকার উত্তেজনায় আপাতত খাবার চিন্তা ছাড়লাম। জানলাম, ছয়তালায় প্রেস বক্স। কোন লিফট নেই। হেঁটে যেতে হবে। এবার বুঝতে পাড়লাম উত্তেজনার বসে না খেয়ে ঢোকাটা মোটেও ঠিক হলো না।
অনেক কষ্টেই গেলাম প্রেস বক্সে। মাঠ দেখে যতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। প্রেস বক্স থেকে ততটাই হতাশ হলাম। আধুনিক কোন সুযোগ সুবিধাই নেই এখানে। এমনকি ধ্বজভঙ্গ সিঁড়ি গুলো দিয়ে উঠার সময় মনে হয়েছে এই বুঝি ভেঙ্গে পড়লো এরা। আর শৌচাগার, সেতো তিন গ্রাম দূরে। গ্যালারি পাড় হয়ে যেতে যেতে অনেকের...
যাই হোক কিছু অফিশিয়াল কাজ সেরে আর পেরে উঠতে না পারায় নিচে নামলাম কিছু খাবার উদ্দেশ্যে। অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে এক হোটেলে খাওয়ার পর বের হলাম হোটেল খুঁজতে। কিন্তু অদৃষ্টে ভোগান্তি লেখা থাকলে তা কি আর শেষ হয়। প্রায় ২০টা হোটেল ঘোরার পরও খুঁজে পেলামনা একটা রুম। সবার একই কথা ‘আপনারা বাংলাদেশ থেকে এত লোক এসেছেন কি করে থাকে বলুন।’ ঘণ্টাখানিক ঘোরার পর এক সহকর্মীর হোটেলে একটু বিশ্রাম নিতে উঠলাম। অফিশিয়াল কিছু কাজ সেরে আবার নামলাম হোটেল খোঁজার উদ্দেশ্যে।
অনেকটা ভাগ্যের জোরেই খুঁজে পেলাম স্থানীয় এক বাংলাদেশী ছেলেকে। আমার এক সহকর্মীর বন্ধুর ছোট ভাই, নাম জুবায়ের। ব্যবসায়ী কাজে কলকাতাতেই তার থাকা হয়। সে অনেক খুঁজাখুঁজির চেষ্টা করলো। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে নানা জায়গায় ফোন আর ঘুরতে লাগলো একের পর এক হোটেল। না পেয়ে সে আমাকে নিয়ে গেল তার রুমে। চার তলা সিঁড়ি ভেঙ্গে বসলাম তার রুমে। এমন সময় তার এক বন্ধু এসে বলল একটা রুমের ব্যবস্থা হয়েছে। হাসি মুখে দেরি না করেই ব্যাগ নিয়ে চললাম। কিন্তু কোথায় কি। রুম নেই। আমরা আসার আগে কেউ একজন বেশি টাকা দিয়ে সে রুম দখল করে নিয়েছে।
আবার গেলাম তার বাসায়। এমন সময় একজন বলল একটু দূরে একটা হোটেলে একটা রুম আছে। ভাড়া একটু বেশি পড়বে। বাধ্য হয়েই চললাম। অবশেষে আমি আর রিপন ভাই খুঁজে পেলাম কলকাতায় একটা মাথা গোজার ঠাই। জুবায়েরকে ধন্যবাদ জানিয়ে রুমে ঢুকলাম। গোসল, খাওয়া সেরে বিছানায় পরতেই শরীর জানিয়ে দিল তার হাল। চোখ একটু লাগতেই হঠাৎ কিছু একটা পরার শব্দ পেলাম। জানালা খুলে তাকিয়ে দেখি ছাদ ভেঙ্গে এক লোক নিচে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। রিপন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ এবার না আবার হাজতেই থাকতে হয়।
না হাজতে যেতে হয়নি। এখনও আছি হোটেল রুমেই। সকাল হতেই মনে মনে হাসলাম। আমার কলকাতা ভ্রমণের বিড়ম্বনার কথা ভেবে। বের হব গতকালের সেই লোকটির খোঁজ জানতে। ভাবছি দাদাদের দেশে মনে হয় আমি বড্ড বেমানান।
আরটি/এমআর/আরআইপি