ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভিসানীতি ও পরিকল্পিত গুজব সন্ত্রাস

তাপস হালদার | প্রকাশিত: ০১:১৫ পিএম, ০৩ অক্টোবর ২০২৩

বাংলাদেশের নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে গুজবের ডালপালা আরো বিস্তৃত হচ্ছে। গুজবের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। তারা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তারপর থেকে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। রাজনীতিবিদ,সাবেক ও বর্তমান বিচারপতি, আমলা, পুলিশ, নির্বাচন কমিশনার,সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের নামে ভুয়া তালিকা তৈরি আতংক সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে বলেছে, ভিসা নীতিমালা অনুসারে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের তালিকা তারা প্রকাশ করা হবেনা। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানানো হবে। ব্যক্তিগত ভিসা বাতিলসহ ভিসার রেকর্ড মার্কিন আইনের অধীনে গোপন রাখা হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান বুম বিডির তথ্যমতে, ‘লন্ডন বাংলা চ্যানেল’ নামে পেজ থেকে পুলিশের সাবেক ও বর্তমান প্রায় ৯০ জনের নাম, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশার ৩৫ এবং অর্ধশতাধিক সাংবাদিকদের নামের তালিকা নিষেধাজ্ঞায় আওতায় আছে বলে বিভিন্ন পেজে শেয়ার করা হয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞাকৃত ব্যক্তি নিজ থেকে কিছু না জানালে বাইরে থেকে কোনোভাবে জানা সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ নিষেধাজ্ঞার কথা বলেননি।তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, এবছর ভিন্ন ভিন্ন কারণে নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, হাইতি, সুদান ও নিকারাগুয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

মার্কিন ভিসা নীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তাঁর বিরুদ্ধে ভিসা নীতি আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি যখন ২০১৪ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ভিসা নীতি প্রত্যাহার করে নেন। এখন নরেন্দ্র মোদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বন্ধু। সেখানে মোদি যে সংবর্ধনা পেয়েছেন,নিকট ইতিহাসে এমন সম্মান বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধান কখনো পায়নি। নরেন্দ্র মোদিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মার্কিন কংগ্রেসে দুইবার ভাষণ দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ, প্রায়ই দেখা যায় যাদের বিরুদ্ধে ভিসা প্রয়োগ করেছিল পরবর্তীতে তারাই তাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়েছে।

গত মে মাসে ভিসা নীতি ঘোষণার ঠিক নয় দিন আগে ঠিক একই ভাবে নাইজেরিয়াতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোটের ফলাফল কারচুপি ও গণতন্ত্র বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য বেশকিছু ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। এর আগেও ২০১৯ সালে নাইজেরিয়ার নির্বাচনের একমাস আগে দুই দফায় কিছু ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা দিযেছিল। এবং যাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল তাদের যেহেতু নাম প্রকাশ করা হয়নি ফলে তাদের পরিচয়ও কেউ জানেনি। ফলে এই নিষেধাজ্ঞা সেখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেখানেও বাংলাদেশের মতো সামাজিক মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির নাম ছড়ানো হয়েছিল,পরবর্তীতে দেখা গেছে সবই ছিল গুজব।

আফ্রিকার আরেকটি দেশ উগান্ডা সেখানে ২০২১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর অনিয়মের অভিযোগে বেশ কিছু ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।সেখানকার প্রেসিডেন্ট ১৯৮৬ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় আছেন।তিনি একই সাথে সরকার প্রধান ও সেনাপ্রধান। সেসময় বলা হয়েছিল, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কয়েক ডজন বিরোধী দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করা হয়েছিল। প্রায় তিন বছর হলেও ভিসা নীতি সেখানকার সরকারের সিন্ধান্ত গ্রহণে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। গত ২৩ জুলাইয়ের নির্বাচনে কম্বোডিয়ার নির্বাচনের পর সেখানে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি এমন অভিযোগে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মধ্যে সেই কম্বোডিয়ার সাথে বন্ধুত্ব হয়, আর্থিক সহায়তা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

 

নির্বাচনের আগে পরিকল্পিত ভাবে আরো অনেক গুজব ছড়ানো হবে। এসব মুখরোচক তথ্য বিশ্বাস না করে নিজে অন্তত একবার যাচাই করে নিন। আমাদের হাতের মুঠোতেই এখন সত্য যাচাইয়ের অনেক মাধ্যম আছে। কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে খুব অস্থির,অধৈর্যশীল। হুজুগে বাঙালি হিসেবে অপবাদ তো আছেই। গুজব হোক কিংবা সত্য হোক সবার আগে আমাকেই শেয়ার করতে হবে, কিংবা প্রচার করতে হবে এসব নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। গুজব সাময়িক বিনোদনের খোরাক হলেও সত্য কিন্তু চিরন্তন একটু দেরিতে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি অনেক ক্ষেত্রে বুমেরাংও হয়েছে। মিয়ানমার, ইরান, বেলারুশ, কিউবায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারে নিষেধাজ্ঞা তো কাজেই আসেনি বরং আরো উল্টো হয়েছে। গণতন্ত্র তো ফিরে আসেনি,বরং স্বৈরতন্ত্র আরো পোক্ত হয়েছে। আর মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু রাষ্ট্র চীনের সাথে হাত মিলিয়ে তাদেরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। তারা বলেছে,আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যারা বাধা দিবে তাদেরকে ভিসা দেয়া হবে না। তাদের ভিসা নীতির লক্ষ্য যদি হয়,নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু করা তাহলে নিষেধাজ্ঞা ভাল ফল নিয়ে আসবে। প্রধানমন্ত্রী তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে শুধুমাত্র সরকার একাই করতে পারে না। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বিরোধী দলসহ সকলের ভালো ভূমিকা থাকতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত ভিসা নীতি নির্বাচনের পরে দেয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে নির্বাচন বানচাল করতে বিরোধী দলের সহিংসতাও ভিসা নীতির আওতায় আসবে।

অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবেনা। ভিসা নীতিতে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়বে বিএনপি-জামায়াত জোট। কারণ তারা তো বলছে নির্বাচন প্রতিহত করবে, হতে দেবে না। বিএনপির প্রতিহতের নমুনা তো বিগত দিনে দেখা গেছে, জ্বালাও পোড়াও তো তাদের একমাত্র আন্দোলন। এমনটি হলে নিঃসন্দেহে ভিসা নীতি বিএনপির ক্ষেত্রেই বুমেরাং হবে।

ভিসা নীতি নিয়ে অতিসম্প্রতি গুজবের টার্গেট করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র,মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে।যদিও তিনি বরাবরই গুজব সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হন।গত ৩০ সেপ্টেম্বর ছড়িয়ে দেয়া হলো, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইটেক অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেছেন। এর দুই/তিন আগে বলা হয়েছিল ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়েছেন জয়’,যুক্তরাষ্ট্রে ওমানে রাজনৈতিক আশ্রয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়’, ‘সজীব ওয়াজেদ জয়ের হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছে মার্কিন ট্রেজারারি বিভাগ’,এসব সব অসংখ্য গুজব সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

কোনো প্রকার প্রমাণ, যাছাই-বাছাই ছাড়া এক শ্রেণির হুজুগে বাঙালি এসব মুখরোচক গল্প নিয়ে যে যার মতো ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এক শ্রেণির মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও এসব গুজব বিশ্বাস করছে। সমালোচনাকারীদের জবাব দিতে ২৮ সেপ্টেম্বর মায়ের জন্মদিনে একটি পারিবারিক ছবি পোস্ট করে গুজবের জবাব দেন। ছবির মাধ্যমে জানিয়ে দেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই আছেন।

যারা ভিসা নীতি নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিচ্ছেন বাংলাদেশ -যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে,শেখ হাসিনা সরকারের পতন হবে।তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আর্থিক,সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় খুবেই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রও অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। ভিসা নীতি একটি কূটনৈতিক কৌশল যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হবে।

নির্বাচনের আগে পরিকল্পিত ভাবে আরো অনেক গুজব ছড়ানো হবে। এসব মুখরোচক তথ্য বিশ্বাস না করে নিজে অন্তত একবার যাচাই করে নিন। আমাদের হাতের মুঠোতেই এখন সত্য যাচাইয়ের অনেক মাধ্যম আছে। কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে খুব অস্থির,অধৈর্যশীল। হুজুগে বাঙালি হিসেবে অপবাদ তো আছেই। গুজব হোক কিংবা সত্য হোক সবার আগে আমাকেই শেয়ার করতে হবে, কিংবা প্রচার করতে হবে এসব নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। গুজব সাময়িক বিনোদনের খোরাক হলেও সত্য কিন্তু চিরন্তন একটু দেরিতে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
haldertapas80@gmail

এইচআর/জিকেএস