ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অক্টোবরে কি রাজনীতির রং বদলাবে?

মোনায়েম সরকার | প্রকাশিত: ০৯:২৫ এএম, ০৩ অক্টোবর ২০২৩

রাজনীতির প্রতি যাদের আগ্রহ তারা নজর রাখছেন অক্টোবর মাসে রাজনীতির গতি-প্রকৃতির দিকে। অনেকে মনে করছেন, অক্টোবর মাসে দেশের রাজনীতি এমন একটি অবয়ব ধারণ করবে যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাবে কি আসলে ঘটবে আগামী দিনে। আবার এমন ধারণাও আছে যে রাজনীতি নিয়ে আগাম মন্তব্য করা যাবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির পরস্পরবিরোধী ঠ্যালাধাক্কার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের দিকেই যাবে দেশ।

তবে অক্টোবর মাস ঘটনাবহুল ও উত্তেজনায় ভরা যে থাকবে, তা হয়তো ঠিক। ৪ অক্টোবর দুপুরে দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্তরাজ্য গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু রাস্তা বন্ধ করে, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে সংবর্ধনা নিতে সম্মতি দেননি শেখ হাসিনা।

এই যে জনদুর্ভোগের বিষয়টি শেখ হাসিনা বিবেচনায় নিলেন, এখানেই তার বৈশিষ্ট্য। দল ও দলের অন্য নেতারা যেটা ভাবেন না, তিনি সেটা ভাবেন। এখন দেশের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমূল্য, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে অস্বস্তি ও উদ্বেগের মধ্যে আছে। ঢাকা শহরে অসহনীয় যানজটে নাকাল হচ্ছে মানুষ, এ অবস্থায় ঘটা করে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিলে তাতে মানুষ বিরক্তই হতো। মানুষের মনে নতুন করে বিরক্তি তৈরি না করে শেখ হাসিনা আবারও বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন বলে তাকে অভিনন্দন। দেশে ফিরে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি কোনো উদ্যোগ নেন কি না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে যে জটিলতা মৃত্যুতরি হয়েছে, তা নিরসনে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু করেন কি না, সেটা নিয়েও মানুষের মধ্যে কৌতূহল আছে। খালেদা জিয়া রাজনীতিতে শেখ হাসিনার জন্য কখনো কোনো ছাড় দেননি, প্রতিহিংসার রাজনীতিই অনুসরণ করেছেন, এমনকি তাকে হত্যার চেষ্টা হলেও সরকার প্রধান হয়ে খালেদা জিয়া যে অমানবিক নির্লিপ্ততা দেখিয়েছেন তা ভোলার মতো নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার কাছে মানুষ সর্বোচ্চ মানবিকতাই প্রত্যাশা করে। নিষ্ঠুরতার রাজনীতি শেখ হাসিনা অনুসরণ করবেন না, বিশেষ করে একজন মানুষ যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন তখন।

গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি সম্প্রতি নতুন করে সামনে এসেছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ওই আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। গত রোববার চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো যাবে না বলে মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে তার পরিবারের আবেদন নতুন করে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। আমরা এই মতামত দিয়ে আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে হলে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ কিংবা নির্বাহী বিভাগের হাতে কোনো ক্ষমতা প্রদান করেনি সংবিধান বা প্রচলিত আইন। এ অবস্থায় তাকে বিদেশে যেতে হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। আদালতের সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে বিদেশে পাঠানোর নজির দেশে-বিদেশে নেই দাবি করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনাদের মনে আছে পাকিস্তানের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, সে দেশে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দুর্নীতির দায়ে তার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। তিনিও লাহোর হাইকোর্টের আদেশে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অনেকে আ স ম আব্দুর রবের কথা বলেছেন।

আপনাদের মনে রাখতে হবে- আ স ম রবের বিচার হয়েছিল সামরিক আদালতে। প্রচলিত আদালতে নয়। দেশে তখন কোনো সাংবিধানিক সরকারব্যবস্থা চালু ছিল না। আ স ম আব্দুর রব, কর্নেল তাহেরের সঙ্গে একই মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। পরে দেশের উচ্চ আদালত কর্নেল তাহেরের সেই প্রহসনের বিচার সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনীকে বেআইনি, অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। সে কারণে আ স ম রবের বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি কোনো প্রকার উদাহরণ হিসেবে এ প্রসঙ্গে বিবেচিত হতে পারে না।

 

দুই পক্ষের অনড় অবস্থান আসলে কোন পরিণতির দিকে যাবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংকীর্ণতার পাশাপাশি সহিংসতার প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে নির্বাচনের আগে যখন রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি হয়, তখন সেখানে সহিংসতার আশঙ্কা করাটা খুবই স্বাভাবিক।

 

তিনি বলেন, দেশের উচ্চ আদালত সম্প্রতি সংসদ সদস্য হাজী সেলিমকে এক মাসের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। হাজী সেলিম ৩০ দিনের মধ্যেই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। আদালতের রায়ে তার পাসপোর্ট বাতিল কিংবা ৩০ দিনের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার কোনো প্রকার নিষেধাজ্ঞা না থাকায় এক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

খালেদা জিয়ার সার্বিক অবস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগ সংবেদনশীল উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়ার প্রতি সর্বোচ্চ উদারতা ও মানবিকতা দেখিয়েছেন। দেশের প্রচলিত আইন সংবিধান ফৌজদারি কার্যবিধি যতটুকু ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েছে তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তিনি খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে নিজ বাসায় থেকে দেশের সর্বাধুনিক হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। মানবিকতার এমন নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি দেখানো খুবই কঠিন।

৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার, ফুসফুস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতাসহ নানা রোগে ভুগছেন। কয়েক দিন ধরে খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানি, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর ব্যাপারে পরিবার খোঁজখবর ও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়। এ পরিস্থিতিতে সরকার নমনীয় বলে মনে করেছিলেন অনেকে।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা হলে কারাগারে যেতে হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও তার সাজার রায় আসে। দেশে করোনা ভাইরাস মহামারি শুরুর পর খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। শর্ত দেওয়া হয়, তাকে দেশেই থাকতে হবে। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসা ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন থেকে তিনি সেখানেই রয়েছেন।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে ফয়সালা এখন শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে। দেশে ফিরে তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখালে দেশের রাজনীতিতেও তার বড় প্রভাব পড়বে। কিন্তু খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয় ছাড়াও রাজনীতির অন্য সব বিষয় নিয়েও মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আছে, আলোচনা আছে।

বিরোধীদের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অগ্রাহ্য করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতির মাঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চলতি অক্টোবর মাস। কারণ, এ মাসেই সরকারের পতন ঘটাতে চায় বিএনপি। অন্যদিকে সরকার চায় কোনোরকম আন্দোলন সামাল দিয়ে মাসটি পার করতে। এজন্য মাসজুড়ে সতর্ক অবস্থানে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সঙ্গে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগও।

অক্টোবরকে যদি রাজনীতির সন্ধিক্ষণ ধরা হয়, তবে তা ঘিরে কঠোর কোনো কর্মসূচি এখন পর্যন্ত দেয়নি বিএনপি। গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে দেশব্যাপী টানা কর্মসূচির অংশ হিসেবে সভা-সমাবেশের পাশাপাশি রোডমার্চ করছে দলটি। গত রোববার ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত রোডমার্চ করেছে তারা। সোমবার রাজধানীতে কৃষক সমাবেশ। ৫ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রোডমার্চের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শেষ হবে। সেখান থেকে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা আসার কথা রয়েছে।

এখন থেকে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে। ১৮, ১৯, ২০ অক্টোবর- এই তিন দিনের যেকোনো একদিন ঢাকায় মহাসমাবেশের পরিকল্পনা আছে বিএনপির। ওই সমাবেশ থেকে সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে আলটিমেটাম দেওয়া হবে।

অন্যদিকে, সরকারি দল আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। সভা-সমাবেশ ছাড়া চলতি মাসে চারটি মেগা প্রকল্প উদ্বোধন সামনে রেখে বড় মহড়া দিতে চায় দলটি। ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন তিনি সড়কপথে মাওয়া যাবেন। সেখানে সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেবেন।

২৩ অক্টোবর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের উদ্বোধন করা হবে। ওই দিন মতিঝিলে সুধী সমাবেশ, ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ওই দিন চট্টগ্রামে সুধী সমাবেশ করা হবে। এছাড়া মাসের মাঝামাঝি সময়ে গণভবনে নারী সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। এছাড়া তফসিল ঘোষণার পরে দেশের বিভিন্ন জেলায় নির্বাচনী জনসভা করবেন প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দ্বাদশ নির্বাচন বানচাল করার জন্য বিএনপি নানা ষড়যন্ত্র করছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নানান কর্মকাণ্ডে দলটির পালে হাওয়া বাড়ছে। কর্মসূচিগুলোতে বড় জমায়েত ঘটানোর মাধ্যমে সবাইকে দেখানো হবে, জনগণ আওয়ামী লীগ ও সরকারের পক্ষে।
দুই পক্ষের অনড় অবস্থান আসলে কোন পরিণতির দিকে যাবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংকীর্ণতার পাশাপাশি সহিংসতার প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে নির্বাচনের আগে যখন রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি হয়, তখন সেখানে সহিংসতার আশঙ্কা করাটা খুবই স্বাভাবিক।

অক্টোবর মাস সত্যি সত্যি দেশের রাজনীতির সন্ধিক্ষণ হয়ে ওঠার লক্ষণ এখনো রাজনীতির মাঠে দৃশ্যমান নয়।
০২ অক্টোবর, ২০২৩

লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন