ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিএনপি ও জাতীয় পার্টির পথ খোঁজা

মোনায়েম সরকার | প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ২৯ আগস্ট ২০২৩

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিএনপি সরকারের পতন না ঘটিয়ে নির্বাচনে যাবে না বলে বার বার হুংকার ছাড়লেও সরকার পতনের কোনো লক্ষণ কেউ দেখছেন বলে মনে হয় না। আমেরিকাসহ পশ্চিমা কিছু দেশ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখালেও শেষ সিদ্ধান্ত যে দেশের রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষকেই নিতে হবে তা নিশ্চিত।

রাজনীতির বিদেশ ফ্যাক্টর উপেক্ষা করা না গেলেও কোন দেশের প্রভাব কোন পক্ষকে কীভাবে সুবিধা দেবে, সেটা এখনো খুব পরিষ্কার নয়। তবে এক্ষেত্রে ভারতের মনোভাব বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ এজন্যই যে ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী এবং আমাদের দেশের রাজনীতির পটপরিবর্তনে ভারতের অভ্যন্তরেও নানাভাবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে।

ভারত যে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবে এবং কখনো কখনো কলকাঠি নাড়ে সেটা অস্বীকার করা সত্যের অপলাপ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা স্বেচ্ছায় ভারতের ওপর নির্ভর করেছিলাম। ভারত একাত্তরে যে ভূমিকা পালন করেছিল, তা স্মরণীয় বটেই। রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু-মিত্র নেই বলা হলেও ভারতের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর নয়। আমেরিকা ও আরও কেউ কেউ প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যেভাবে তৎপরতা দেখাচ্ছে, তা কোনোভাবেই প্রশংসাযোগ্য নয়। আবার বাংলাদেশে কি ঘটছে, না ঘটছে তা নিয়ে ভারতও চোখ বুজে আছে মনে করার কারণ নেই।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে আসার পর থেকেই বাংলাদেশে রাজনীতির হাওয়ায় নতুন বাতাস বয়ে যাওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বিএনপি বিষয়টিতে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে, তারা দুঃখ পেয়েছে। আওয়ামী লীগ আছে ফুরফুরে মেজাজে। আমেরিকা আওয়ামী লীগকে পছন্দ না করলেও বিএনপি নিয়ে কতটা আস্থা তাদের সেটা কেউ খুব নিশ্চিত করে বলতে পারবে কি? কিন্তু ভারতের পক্ষপাত যে আওয়ামী লীগের প্রতি, তা নিয়ে সংশয় অনেকেরই নেই।
বিএনপি শেষপর্যন্ত নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টিও নির্বাচন থেকে দূরে থাকবে বলে এতদিন যারা উৎফুল্ল ছিলেন, তারা এখন হতাশ। বিশেষ করে চারদিনের ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের যেসব কথা বলেছেন, তাতে মনে হয় না দলটি বিএনপির দেখানো পথে হাঁটবে। ভারতকে নাখোশ করবে।

জিএম কাদের ২৮ আগস্ট ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কিছু কথা বললেও সফর নিয়ে বিস্তারিত কিছুই বলেননি। এরপর থেকে তিনি মুখে কুলুপ এঁটেই আছেন। চুপ করে আছেন দলটির শীর্ষ নেতারাও।

অন্যদিকে জিএম কাদের ভারত সফরে যাওয়ার আগের দিন ১৯ আগস্ট দুপুরে রওশন এরশাদ গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি জোট, ভোট ও নিজের দলের অবস্থান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। পরে তার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, সংবিধান অনুযায়ী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি জিএম কাদের সম্পর্কে বলেন, জিএম কাদের যেভাবে কথাবার্তা শুরু করেছে, মনে হচ্ছে সে বিএনপির সঙ্গে জোট করবে। যদিও আগে থেকেই রওশন এরশাদের অবস্থান একেবারেই পরিষ্কার। তিনি সরকারের সঙ্গে থাকতে চান। আর জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় সরব। তবে ভবিষ্যতে রাজনীতির হাওয়া বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।

মূলত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রওশন এরশাদের বৈঠকের পরেই জাতীয় পার্টির মধ্যে নানা রকম গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এ গুঞ্জনে ঘি ঢেলে স্বয়ং রওশন এরশাদ নিজেই আরেক নাটকীয় ঘটনা ঘটান। জিএম কাদের ভারত সফরে থাকতেই তাকে সরিয়ে দলের চেয়ারম্যান হওয়ার সিদ্ধান্ত জানান রওশন এরশাদ। এনিয়ে দলের মধ্যে তোলপাড় শুরু হলে একপর্যায়ে রওশন এরশাদ তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

দিল্লি থেকে দেশে ফিরে দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করে জিএম কাদের বলেন, রওশন এরশাদ আমার মাতৃতুল্য। তিনি খুবই অসুস্থ, তাকে দিয়ে কিছু লোকজন বিভিন্ন বিষয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিচ্ছেন। ওই কুচক্রী মহল যতই ষড়যন্ত্র করুক, দলের মধ্যে কোনো বিভেদ তৈরি করতে পারবে না। তবে বাস্তবে যে জাপা ঐক্যবদ্ধ নেই, সেটা রাজনীতি সচেতন সবারই জানা।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের মুখে কুলুপ আঁটলেও ভারত সফর নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা চলছে বলেও গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। জাপা সূত্রে জানা যায়, দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো জাতীয় পার্টিকেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেখতে চায় ভারত। দেশটির চাওয়া, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে-পরে কোনো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির তৈরি না হোক। একটি সুন্দর পরিবেশের মধ্য দিয়ে নির্বাচন হোক ও সেই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিক। ভারতের এমন বার্তা নিয়েই চারদিনের সফর শেষ করে দেশে ফেরেন তিনি।

জানা যায়, ভারত সফরকালে সে দেশের সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নির্বাচন ঘিরে জাপার অবস্থান তুলে ধরেছেন জিএম কাদের। তিনি বলেছেন, জাপা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের ভাঙচুর বা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চায় না। তারা নির্বাচনে যাবে, তবে সেটি হতে হবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এ বিষয়ে ভারতও তাদের সম্মতি জানিয়েছে। তবে কেউই সফরের সময় জিএম কাদেরের সঙ্গে ভারতীয় কর্মকর্তাদের একান্ত বৈঠকে আলোচনার বিষয়বস্তু এবং নির্বাচনে সরকারের সঙ্গে জাপার থাকার বিষয়ে কোনো নির্দেশনার বিষয়ে জানাতে পারেননি।

 

যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা-বিশ্বাসের সংকট চরমে, সেহেতু যে কোনো বিষয় নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। যে যেখানে যা-ই করুন না কেন, নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে দেশের মানুষকে জিম্মি না বানাইলে ভালো। আমরা মনে করি, দেশের ভেতরে বা বাইরে গিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র না করে সব রাজনৈতিক দলেরই উচিত দেশের মানুষকে আস্থায় নেওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়া। মানুষকে বাদ দিয়ে পথ খুঁজলে পথ হারানোর আশঙ্কাই প্রবল।

 

নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জাপার প্রতি ভারতের আলাদা কোনো নির্দেশনা বা পরামর্শ ছিল কি না- এ বিষয়ে চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ জাপার এক নেতা বলেন, সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাওয়া মানেই জাপাকেও নির্বাচনে চাওয়া। এটার জন্য আলাদা কিছু বলার নেই। ভারত নির্দিষ্ট কোনো দলকে সমর্থন দিচ্ছে না। বিএনপিসহ সব নিবন্ধিত দলও যাতে নির্বাচনে আসে, সেটাই তাদের মূল বার্তা। তিনি বলেন, ভারত প্রত্যাশা করে, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে। জাপাও সেটাই চায়।

ভারত নিয়ে আলোচনার রেশ না কাটতেই আলোচনায় এসেছে সিঙ্গাপুর। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা দেশটিতে যাওয়ায় এ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। যদিও দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা গেছেন চিকিৎসার জন্য।

গত ২৭ জুন থেকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। মস্তিষ্কের বহির্ভাগে টিউমারের অসুখ নিয়ে তিনি সেখানকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার শারীরিক অবস্থা এখন অনেকটাই ভালো এবং শিগগির দেশে ফিরবেন বলে দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

এর মধ্যে গত ২৪ আগস্ট স্ত্রীকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে গেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দুদিন পরেই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসও স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান। এরপর সিঙ্গাপুর যান জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। সব মিলিয়ে নানা আলোচনা এখন ডালপালা মেলছে।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের তিন নেতা ও জাপা মহাসচিবের সিঙ্গাপুরে অবস্থান এরই মধ্যে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। দলের পক্ষ থেকে চিকিৎসার কথা বলা হলেও গুঞ্জন থেমে নেই। এমনকি এ নিয়ে কানাঘুষা চলছে খোদ বিএনপিতেও।

বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতার বিরাজমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নেতারা একান্তে আলাপ করতেই সিঙ্গাপুরে গেছেন। সেখান থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো করণীয় নির্ধারণ করতে পারেন।

অন্যরা অবশ্য মনে করছেন, এসব কিছুই নয়। চলমান এক দফার আন্দোলন এখন একটা পর্যায়ে এসেছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বিএনপি ও শরিকদের রাজপথে গা ঝাড়া দিয়ে নামার পরিকল্পনা রয়েছে। তার আগে অসুস্থ নেতারা একরকম প্রস্তুতি হিসেবেই শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন।

বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও। বিএনপির তিন নেতার সিঙ্গাপুরে অবস্থান বিষয়ে গত রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, বিএনপির তিন নেতা সিঙ্গাপুরে গেছেন। পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে, এটা কি আদৌ চিকিৎসা, নাকি আরও কোনো ষড়যন্ত্র করার উদ্দেশ্যে তারা সিঙ্গাপুরে গেলেন। এটা অনেকের প্রশ্ন।

যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা-বিশ্বাসের সংকট চরমে, সেহেতু যে কোনো বিষয় নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। যে যেখানে যা-ই করুন না কেন, নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে দেশের মানুষকে জিম্মি না বানাইলে ভালো। আমরা মনে করি, দেশের ভেতরে বা বাইরে গিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র না করে সব রাজনৈতিক দলেরই উচিত দেশের মানুষকে আস্থায় নেওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়া। মানুষকে বাদ দিয়ে পথ খুঁজলে পথ হারানোর আশঙ্কাই প্রবল।

২৮ আগস্ট, ২০২৩
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন