ড. আতিউর প্রধানমন্ত্রীর সুনাম ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন
মুসা সাদিক সাবেক সচিব। বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রণাঙ্গন সংবাদদাতা। চাকুরিজীবনে রাষ্ট্রপতির সচিবসহ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নানা পট পরিবর্তনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনটি বই লিখেছেন। ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’ (বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই), ‘মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম’- গ্রন্থগুলো ইতিহাসবিদ ছাড়াও সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির সাম্প্রতিক ঘটনায় জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের সহকারী সম্পাদক ড. হারুন রশীদ
জাগো নিউজ : বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ উদ্ধারে যে পদক্ষেপ নিয়েছে সে ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?
মুসা সাদিক : বাংলাদেশ ব্যাংক চুরি হয়ে যাওয়া ৮শ কোটি টাকা উদ্ধারে এ পর্যন্ত যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। বলতে গেলে তারা কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এখান থেকে ইমেইল পাঠানো হয়েছে ফিলিপাইনের ব্যাংকে। ফিলিপাইন থেকেও রিসিভ করা হয়েছে। কারো কোনো সই (স্বাক্ষর) নেই। কেউ দায় নিতে চায় না। কিছু কেরানীসুলভ কাজকর্ম করে দায় সারা হয়েছে। ঘটনার পর আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছিলাম। তারা এটা নিয়ে আদৌ কোনো চিন্তিত আছে বলে মনে হয় না। ব্যাংকে গিয়ে দেখি তারা হাসাহাসি করছে, ঢলাঢলি করছে। অর্থাৎ রোম পুড়ছে আর নিরু বসে বাঁশি বাজাচ্ছে।
জাগো নিউজ : আপনি রাষ্ট্রপতির সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রশাসনিক উদ্যোগের ব্যাপারে আপনার বাস্তবসম্মত ধারণা আছে। এক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল বলে আপনি মনে করেন।
মুসা সাদিক : দেখুন প্রথম যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেখানে কিন্তু মূল বিষয়টি ছিল নিরাপত্তা। রাষ্ট্র বা সরকার কী জন্য। জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানই এখানে মূল কথা। আজকে যদি আমেরিকার ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকে ৪ ফেব্রুয়ারি ১ মিলিয়ন ডলার আসতো তাহলে এটা জানার পর পরই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করতেন এই টাকা উদ্ধারের জন্য। ৫ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকে ঢাকায় পাঠাতেন। এবং তারা টাকা না নিয়ে ওয়াশিংটনে ফেরৎ যেতেন না। শুধু আমেরিকা নয় আত্মমর্যাদাশীল যে কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট/ প্রধানমন্ত্রী একই ধরনের পদক্ষেপ নিতেন।
আমার দীর্ঘকালের বন্ধু একাত্তরে যিনি কুমিল্লায় লেফট্যানেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেন, ২০০৮ এ যিনি ভারতের সেনাপ্রধান হন এবং বর্তমানে ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জেনারেল অব. ড. ভিকে সিংয়ের সঙ্গে টেলিফোনে সম্প্রতি আমার কথা হচ্ছিল। তিনি আমাকে বললেন ‘ইউর ইনএকশনস আর ইউর এ্যাকশনস’ (Your inactions are your actions) অর্থাৎ তোমাদের নিষ্ক্রিয়তাই হচ্ছে তোমার ভূমিকা। এতগুলো টাকা লোপাট হলো অথচ আমরা নির্বিকার? আরে না কাঁদলে তো মাও সন্তানকে দুধ দেয় না। আমাদের টাকা উদ্ধারে যদি আমরা নিজেরাই তৎপর না হই তাহলে টাকা কী উড়ে উড়ে এমনিতেই দেশে চলে আসবে?
অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও আমি বলবো লোপাট হওয়া অর্থ উদ্ধারে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিত। আমাদের অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত আজই ম্যানিলায় চলে যাওয়া। সেখানকার সরকারের সাথে কথা বলে টাকা উদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এবং টাকা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থেকে যাওয়া, চাপ অব্যাহত রাখা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করতে পারেন। ফিলিপাইনের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য। এক দেশের অর্থ আরেক দেশে চুরি করে নিয়ে যাওয়া বিশ্বের কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট/প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করেন না। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যদি এ ব্যাপারে সরকার প্রধানদের ফোন করেন তাহলে তারা একে স্বাগত জানাবেন। এবং অবশ্যই বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবেন। কারণ এটা তাদের জন্য একটা সুযোগ। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের জন্য অবদান রাখতে পারবেন।
জাগো নিউজ : এত বড় অর্থ লোপাট কী করে সম্ভব হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা এখানে কী রকম বলে আপনি মনে করছেন?
মুসা সাদিক : বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগসাজশ ছাড়া এত বড় অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমি মনে করি কর্মকর্তাকর্মচারীদের এখানে যোগসাজশ রয়েছে। এবং তারা এর বেনিফিশিয়ারি বা সুবিধাভোগী। এত বড় একটি ঘটনা ঘটলো অথচ তাদের গায়ে ফুলের টোকাটি পর্যন্ত লাগেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দুঃখবোধ বা অনুতাপ আছে বলেও মনে হয় না। এতবড় একটি ঘটনা ঘটলো, বাংলাদেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা হ্যাকাররা চুরি করে নিয়ে গেল অথচ এ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কোনো বিকার নেই!
আজকে যদি কোনো মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটতো তাহলে মন্ত্রীবাহিনী, নেতা, পাতিনেতা ও চামচারা মৌমাছির মতো সেখানে গিয়ে ভিড় করতো। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘ভূমিকম্প’ হয়ে গেছে তারা কেউ সেখানে যায়নি।
জাগো নিউজ : অর্থ চুরির নৈতিক দায় নিয়ে গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেছেন। এটাকে কিভাবে দেখছেন?
মুসা সাদিক : দেখুন ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করার পর বলেছেন, পদত্যাগপত্র পেয়ে নাকি প্রধানমন্ত্রী চোখের পানি ফেলেছেন। এই কথা মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। দেশ বিদেশের লোকজন বলাবলি করছে ৮শ কোটি টাকা চুরি হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী চোখের পানি ফেলতে পারেন, একজন গভর্নরের পদত্যাগে কেন তিনি চোখের পানি ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে এ ধরনের কথা বলা অনুচিত। ড. আতিউর এ ধরনের কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ও সুনাম ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন।
জাগো নিউজ : অতীতে আমরা দেখেছি শেয়ারবাজার লুট, বেসিক ব্যাংক, হলমার্কের ঋণ জালিয়াতি, ডেসটিনিসহ নানাবিধ বড় বড় অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি। কিন্তু কোনোটার জন্যই কাউকে তেমন কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটলো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
মুসা সাদিক : দেখুন এক সময় বৃটিশের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না। অর্ধেক পৃথিবী তারা শাসন করতো। তাদের প্রশাসনিক মূলমন্ত্র ছিল ‘রিএ্যাওয়ার্ড এন্ড পানিশনেমন্ট’(Reward and Punishment)। অর্থাৎ ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার। এই মৌলিক শিক্ষা তারা লাভ করেছিল যুগে যুগে বিভিন্ন শাসক ও ধর্মীয় গুরুদের শাসনের আদর্শ থেকে। এটা আমি দেখেছিলাম ১৯৭৭ সালে পেন্টাগণে আমার প্রশাসনিক প্রশিক্ষণকালে। সেখানে ‘রিএ্যাওয়ার্ড এন্ড পানিশনেমন্ট’ (Reward and Punishment) এর ওপর আমাদের এক সপ্তাহের ক্লাশ ছিল। সেখানে জনকল্যাণকর শাসকদের ‘রিএ্যাওয়ার্ড এন্ড পানিশনেমন্ট’(Reward and Punishment) নিয়ে আলোচনা চলছিল। হঠাৎ দেখি স্ক্রিনে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এর উদাহরণ এসে গেল। তখন খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন প্রধান সেনাপতি। তার নেতৃত্বে বড় বড় যুদ্ধ জয় হচ্ছিল। এরফলে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করতে লাগলো দ্রুত। সেজন্য তাকে ‘সাইফুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারি উপাধি দেওয়া হল। ‘যে যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ যায় সে যুদ্ধে জয় অনিবার্য’- তার এরকম একটি কথা প্রকাশ পাওয়ায় তার মধ্যে যেন অহঙ্কার কাজ না করে সেজন্য তাকে প্রধান সেনাপতি পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তাকে সাধারণ সৈনিক করে তাদের সাথেই জীবনযাপন করতে বলা হয়। এ থেকেও আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনায় জড়িতদের ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন।
মুসা সাদিক : বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনার দায় তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান কিছুতেই এড়াতে পারেন না। তাকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ফিরে গেছেন অন্য কোনো দেশ হলে পথটা এতো মসৃণ হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন জব্দ করতে হবে। সমস্ত ডকুমেন্ট সিজ করতে হবে।
জাতির সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের কোনো ক্ষমা নেই। চীনে এবং ইরানে সরকারি অর্থ চুরি করলে সেই অফিসের সামনেই অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যাতে এ ধরনের অপরাধে জড়াতে আর কেউ সাহসী না হয়।
একই সাথে ম্যানিলায় রিজাল ব্যাংকের ম্যানেজার দেগুইতিকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের জন্য চাপ দিতে হবে। অতীতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ শাসনামলে আমাদের দেশের সন্দেহভাজন নাগরিকদের আমরা এফবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছি। সুতরাং ম্যানিলা দিগুইতিকে আমাদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য। এ জন্য বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সাথে আমাদের গোয়েন্দা প্রধানের কথা বলা উচিত।
জাগো নিউজ : নতুন গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
মুসা সাদিক : দেখুন নতুন গভর্নর আমার মতোই একজন আমলা। তিনি হয়তো আমলা হিসেবে ভালো কিন্তু একজন গভর্নর হিসেবে তার অবদান রাখার সুযোগ খুবই কম। কারণ তিনি এ সেক্টরের মানুষ নন। অভিজ্ঞদের নিয়োগ না দিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার জন্য আমাদের হয়তো এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে।
জাগো নিউজ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মুসা সাদিক : আপনাকেও ধন্যবাদ।
এইচআর/এমএস