ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শোকাবহ আগস্ট এবং জনকল্যাণের রাজনীতি

ড. হারুন রশীদ | প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ০১ আগস্ট ২০২৩

শুরু হলো বাঙালি জাতির জন্য নিষ্ঠুরতম মাস আগস্ট। আগস্ট কান্নার মাস। বেদনার মাস। শোকাবহ আগস্টে বাঙালি জাতি হারিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার অঙুলির নির্দেশে গোটা বাঙালি জাতি একাত্তরে ‘যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। সেই তাঁকেই কি না জীবন দিতে হলো এ দেশেরই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে, যা ছিল কল্পনারও অতীত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছিল ঘাতকচক্র। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে তারা ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি ভাবধারায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যাতে হতে না পারে সেজন্য খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন খুনিদের রক্ষায়।

জিয়া সেই অধ্যাদেশ আইনে পরিণত করেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গিয়ে এ কালো আইনটি বাতিল করে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। যদিও দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন রয়ে গেছে দেশের বাইরে।

সত্যি বলতে কী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাজনীতির বিপথগামিতার শুরু হয়। পঁচাত্তর পরবর্তী নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে টানতে না পেরে দলছুটদের নিয়ে দল গঠন করলেন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য। হালুয়া-রুটির আশায় অনেকেই ভিড়লেন সে দলে। দলছুটদের পেয়ে তাঁর মনে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। জিয়া নিজেই ঘোষণা করলেন, রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করার কথা।

যে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন করলেন, ছয় দফাকে জনপ্রিয় করলেন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করলেন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করলেন—সেই ছাত্ররাজনীতির উর্বর ভূমিতে রোপণ করা হলো স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতালিপ্সার বিষবৃক্ষ। অস্ত্র, টাকা, আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ছাত্রদের একটি অংশকে দলে টানতে সক্ষম হলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান।

আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। বিষবৃক্ষে জল ঢাললেন। অনেক ছাত্রনেতা ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা পেয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেন। এর মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে কলুষতার ষোলোকলা পূর্ণ হলো।

ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকলেন ছাত্রনেতারা। অনেকেই এমপি, মন্ত্রী পর্যন্ত হলেন। অস্ত্র, টাকা হাতে পেয়ে অরাজকতায় লিপ্ত হলো ওই সব ছাত্র। ছাত্ররাজনীতি থেকে আদর্শ নামক বস্তুটি হারিয়ে যেতে থাকল। সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি থেকেও। কেননা সামরিক শাসন আমলে একটি নব্য ধনিক শ্রেণির সৃষ্টি হওয়ায় তারা ক্ষমতার অংশীদার হতে চাইলেন।

সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠলো। এমনকি তারা ক্ষমতার অংশীদার পর্যন্ত হলো। শুধু রাজনীতি নয়, ধর্মকে পুঁজি করে তারা ব্যাংক-বিমাসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাজনীতিতে ‘মৌলবাদের অর্থনীতি’ এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিল। রাজনীতিতে জায়গা করে নিল সাম্প্রদায়িকতা।

 

দুঃখজনক হচ্ছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়েছে। পুলিশি অ্যাকশনও থেমে নেই। সবপক্ষই একটি অনড় অবস্থানে যে যার জায়গা থেকে। মানুষ চায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন যেখানে তারা অবাধে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। তবে রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং সেটা প্রতিহত করার নামে জনদুর্ভোগ হোক, জানমালের ক্ষতি হোক সেটি তারা চায় না। জনকল্যাণই প্রাধান্য পাক সরকারি ও বিরোধী পক্ষের রাজনীতিকদের কাছে এটিই মানুষ প্রত্যাশা করে।

 

স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ায় একটি সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হলো। সামরিক শাসকদের সৃষ্টি করা দলগুলো এই বিভাজনকে আরও প্রকট করে তুলল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে এভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রাখা হলো। এভাবে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কার্যত সামরিক শাসকের উত্তরসূরিরাই ক্ষমতায় থেকে গেলো। ফলে গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারল না। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয়।

নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতুতে এখন যানবাহন চলছে। বঙ্গবন্ধূ স্যাটেলাইট আকাশে পৌঁছেছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধূ টানেল উদ্বোধনের অপেক্ষায়। করোনা, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের সংকটের মধ্যেও এগিয়ে চলেছে উন্নয়শীল বাংলাদেশ।

আর্থ-সামাজিক নানা দিক থেকেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, রাজনৈতিক নানা বিরোধ এখনো রয়েই গেছে। ক্ষমতায় থাকা না থাকার ইস্যুগুলোই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। সমঝোতার পরিবর্তে বৈরিতাই স্থান করে নিচ্ছে রাজনীতিতে। এ অবস্থা দেশকে এক সংকটজনক অবস্থায় নিপতিত করছে। কিন্তু এ অবস্থা তো কারও কাম্য হতে পারে না। তাই জনকল্যাণের রাজনীতিই সবার প্রত্যাশা।

এবার আগস্ট এসেছে এমন এক সময়ে যখন জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। যথাসময়ে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হবে। রোববার (৩০ জুলাই) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে তিনি এসব কথা বলেন।

এদিকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন আমলে নিয়ে এই জোট নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করে তুলছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানে এর বিধান নেই। নির্বাচন হবে সংবিধান মেনেই। বড়জোর নির্বাচনীকালীন সরকার হতে পারে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলো নিয়ে। যেমনটি এর আগেও হয়েছে।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী রূপরেখা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান মতপার্থক্য ও জটিলতা নিরসনে বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নতুন করে আর কোনো সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবেই সমাধানের কথা বলছে নির্বাচন কমিশন।

দুঃখজনক হচ্ছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়েছে। পুলিশি অ্যাকশনও থেমে নেই। সবপক্ষই একটি অনড় অবস্থানে যে যার জায়গা থেকে। মানুষ চায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন যেখানে তারা অবাধে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। তবে রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং সেটা প্রতিহত করার নামে জনদুর্ভোগ হোক, জানমালের ক্ষতি হোক সেটি তারা চায় না। জনকল্যাণই প্রাধান্য পাক সরকারি ও বিরোধী পক্ষের রাজনীতিকদের কাছে এটিই মানুষ প্রত্যাশা করে। রাজনৈতিক সংহতি ও ঐক্য বজায় রেখেই সমস্যা সমাধান করা উত্তম।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জনকল্যাণই ছিল মুখ্য বিষয়। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় শোকের মাস আগস্টে নতুন করে শপথ নিতে হবে, যাতে জনকল্যাণই মুখ্য বিষয় হয় রাজনীতির।

অনিশ্চিত অন্ধকারের পথে আর এক মুহূর্ত নয়। হীনস্বার্থ নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের একটি সুখী সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শুধু বঙ্গবন্ধুসহ সব শহীদের রক্তঋণ শোধ করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতেই হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর (জাগো নিউজ)।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন