ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দেশে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং চালুর সময় এখনও আসেনি

নিরঞ্জন রায় | প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ২৮ জুলাই ২০২৩

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ডিজিটাল ব্যাংকিং সংক্রান্ত গাইডলাইন চূড়ান্ত করেছে এবং খুব সহসাই হয়তো দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং একটি পৃথক ব্যাংকিংসেবা হিসেবে চালু হবে বলে আশা করা যায়। খবুই স্বাভাবিক। কেননা দেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের পথে। সুতরাং দেশের ব্যাংকিং খাত এক সময় পরিপূর্ণ ডিজিটাল হবে এমনটাই প্রত্যাশিত। সেই প্রেক্ষাপটে দেশে এক সময় ডিজিটাল কারেন্সি হবে, ডিজিটাল ব্যাংকিং হবে এবং ভার্চুয়াল ব্যাংকিংসেবাও চালু হবে।

সেদিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। তবে দেশের ব্যাকিং খাতে ডিজিটালাইজেশন করতে হবে সময় নিয়ে সবদিক বিচার বিশ্লেষণ করে এবং পর্যায়ক্রমে। নচেৎ ডিজিটালাইজেশনের নামে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যা অত্যাবশ্যিক আর্থিক খাতের জন্য মোটেই কাম্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রণীত ডিজিটাল ব্যাংকিং গাইডলাইন নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে সেভাবে বিস্তারিত কিছু আসেনি।

শুধু ১২৫ কোট কোর ক্যাপিটালের বাধ্যবাধকতা উল্লেখ করে ডিজিটাল ব্যাংকের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সব ব্যাংকই পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল ব্যাংকে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাহলে নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংকের গাইডলাইন প্রয়োজন হলো কেন। আমার ধারণা বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক নয়, বরং ভার্চুয়াল ব্যাংক চালু করার উদ্দেশ্যে গাইডলাইন তৈরি করেছে। প্রসঙ্গত, যে ডিজিটাল ব্যাংক এবং ভার্চুয়াল ব্যাংকের মধ্যে সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য আছে।

গতানুগতিক ব্যাংকিং কার্যক্রম যখন প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা হয় তখন তা ডিজিটাল ব্যাংকিং হয়ে যায়। বর্তমানে যে ব্যাংক ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু আছে সেটিকে যখন সম্পূর্ণ কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা হবে তখন তাকে ডিজিটাল ব্যাংকিং বলে হবে। ডিজিটাল ব্যাংকে প্রধান শাখা যেমন থাকবে, তেমনি ব্যবসায়িক কৌশল অনুযায়ী থাকবে ব্যাংকের অনেক শাখা।

ব্যাংক তাদের শাখার মাধ্যমে এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করে। ডিজিটাল ব্যাংকিং হলেও ব্যাংক সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করবে, অর্থ জমা নেবে এবং অর্থ উত্তোলন, ঋণদান, অর্থ স্থানান্তরসহ সব প্রকার ব্যাংকিংসেবা সরাসরি গ্রাহকদের প্রদান করতে পারবে। সেই হিসেবে আমাদের দেশের প্রচলিত সব ব্যাংকেই ডিজিটাল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

যদিও শতভাগ ডিজিটালাইজেশন এখনও কোনো ব্যাংকেই সেভাবে হয়নি, কিন্তু প্রক্রিয়াটি চলমান। পক্ষান্তরে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির এবং খুবই অল্প পরিসরের এক অত্যাধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ভার্চুয়াল ব্যাংকের দৃশ্যত কোনো অবস্থান থাকে না। কেননা নামকাওয়াস্তে একটি প্রধান কার্যালয় থাকলেও এ ব্যাংকের কোনো শাখা বা অবস্থান কোথায়ও থাকে না।

ওয়েবসাইট সর্বস্ব একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিয়েই পরিচালিত হয়। গ্রাহক জানতেও পারে না কোথায় এই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের বিশেষ বিশেষ কিছু সেবা দেওয়ার জন্য এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়াল ব্যাংক সরাসরি গ্রাহকদের সেবা দিতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদের অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের মাধ্যমে এ সেবা প্রদান করে।

যাই হোক, গাইডলাইনটি ডিজিটাল ব্যাংকিং গাইডলাইন, নাকি ভার্চুয়াল ব্যাংকিং গাইডলাইন তা বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই পরিষ্কার করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং চালুর সময় এসেছে কি না। এক কথায় উত্তর, না। ভার্চুয়াল ব্যাংকিং হচ্ছে ব্যাংকিংসেবার সর্বোচ্চ মানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি ব্যাংকিংসেবা। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং হচ্ছে তৃতীয় পর্যায়ের বিশেষ ব্যাংকিংসেবা, যা গড়ে তোলা হয় অন্যান্য দুই পর্যায়ের ব্যাংকিংসেবার ওপর ভিত্তি করে। প্রথম পর্যায়ে গতানুগতিক ব্যাংকিং এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ডিজিটাল ব্যাংকিং। যে দেশের ব্যাংকিং খাত এই দুটো পর্যায় সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, তারাই ভার্চুয়াল ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ নিতে পারে। আমাদের দেশের কনভেনশনাল বা গতানুগতিক ধারার ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকলেও এখানে বেশ কিছু সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। তাছাড়া আমাদের দেশে ডিজিটাল ব্যাংকং বলতে যা বোঝায় তা সেভাবে চালুই হয়নি। একেক ব্যাংক একেক রকম করে কিছু বিভাগ প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলেছে মাত্র। এখনও ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস চালু হয়নি। ব্যাংকে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে, ঋণ আবেদন, ঋণ মঞ্জুর, ডকুমেন্টেশন, ঋণ বিতরণ, ঋণ আদায় এবং রিকনসিলিয়েশন পর্যন্ত যাবতীয় কাজ প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হওয়ার ব্যবস্থা থেকে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত এখনও অনেক দূরে। অথচ এসবই একটি মানসম্পন্ন ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান শর্ত। এরকম একটি অবস্থায় প্রযুক্তিনির্ভর চূড়ান্ত পর্যায়ের ব্যাংকিংসেবা, ভার্চুয়াল ব্যাংকিং, চালু করা মোটেই শুভবুদ্ধির লক্ষণ নয়।

 

ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মপরিকল্পনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে দেশের ব্যাংকিং খাতকেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে। তবে অবশ্যই সেটা করতে হবে পর্যায়ক্রমে এবং একেক ধাপে। সেটা না করে, দ্রুত এবং শর্টকাট পদ্ধতি অবলম্বন করে সবকিছু ডিজিটালাইজেশন করতে গেলে এক ধরনের লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য।

 

দেশে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং হয়তো একসময় চালু করতে হবে। কিন্তু তার আগে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে যে সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান করে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এ খাতকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে সবার আগে। তারপর দেশের ব্যাংকিং খাতে পরিপূর্ণ ডিজিটালাইজেশন সম্পন্ন করতে হবে। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পরেই দেশে ভার্চুয়াল ব্যাংক চালুর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও নতুন কোনো ব্যাংকের অনুমোদন না দিয়ে বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর মধ্যে থেকে যেসব ব্যাংক ভালো করবে তাদের সাবসিডিয়ারি স্থাপনের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ব্যাংক চালু করা যেতে পারে। এমনিতেই আমাদের দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। তার ওপর ভার্চুয়াল ব্যাংকের নামে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলে সার্বিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য আরও খারাপই হবে।

উল্লেখ্য, আমেরিকা কানাডার মতো দেশেও ভার্চুয়াল ব্যাংকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। আরও একটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য তা হচ্ছে, বর্তমানে চালু আর্থিক সেবাপ্রদানকারী কোনো প্রতিষ্ঠানকে ভার্চুয়াল ব্যাংক চালু করার অনুমোদন দেওয়ার আগে তাদের পূর্বের কার্যক্রমের বিস্তৃত নিরীক্ষা (কম্প্রিহেনসিভ অডিট) করে একটি ক্লিন রিপোর্ট নিতে হবে দেশের খ্যাতনামা অডিট ফার্মের মাধ্যমে। পূর্বের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কোনো পুঞ্জীভূত সমস্যা যেন ভার্চুয়াল ব্যাংক চালুর মাধ্যমে আড়াল করার সুযোগ না থাকে।

ভার্চুয়াল ব্যাংকের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে সব ধরেনের গ্রাহকের সব ধরনের ব্যাংকিংসেবা প্রদান করা সম্ভব হয় না। সাধারণত বিশেষ শ্রেণির গ্রাহক, যাদের প্রতি ব্যাংকের আস্থা অনেক বেশি, তাদেরই ভার্চুয়াল ব্যাংকিংসেবা প্রদান করা হয়। তাছাড়া ভার্চুয়াল ব্যাংকের সেবার ধরনও খুবই সীমিত। সাধারণত ক্রেডিট কার্ড, ব্যক্তিগত ঋণ, বন্ধকি ঋণ, কনজিউমার প্রডাক্ট ঋণসহ রিটেইল ব্যাংকিংসেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং কার্যক্রম। কোনো অবস্থায়ই ব্যবসায়িক বা করপোরেট ঋণ দেওয়ার সুযোগ ভার্চুয়াল ব্যাংকে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়গুলো সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে হবে। ভার্চুয়াল ব্যাংক চালুর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির আগে এই অত্যাধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য প্রযোজ্য কন্ট্রোল প্যারামিটার নিশ্চিত না করে যেনতেনভাবে ভার্চুয়াল ব্যাংক চালুর অনুমতি দেওয়ার অর্থই হবে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনা।

ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মপরিকল্পনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে দেশের ব্যাংকিং খাতকেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে। তবে অবশ্যই সেটা করতে হবে পর্যায়ক্রমে এবং একেক ধাপে। সেটা না করে, দ্রুত এবং শর্টকাট পদ্ধতি অবলম্বন করে সবকিছু ডিজিটালাইজেশন করতে গেলে এক ধরনের লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য।

যে কোনো পদ্ধতির বা ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে সর্বোচ্চ মাত্রার একটি অত্যাধুনিক ব্যবস্থা যদি সেটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে না পারলে এ ব্যবস্থা যে কি মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে তা অনেকে কল্পনাও করতে পারবে না। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ২০৪১ এবং সেই বিবেচনায় এই মুহূর্তেই ব্যাংকিংসেবার সর্বোচ্চ মাত্রার প্রযুক্তিনির্ভর ভার্চুয়াল ব্যাংকিং চালু করা সেরকমই একটি তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়। কেননা আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে ভার্চুয়াল ব্যাংকিং চালু করার সময় এখনও আসেনি।

লেখক: সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার টরনটো, কানাডা।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন