তোমায় ভালোবাসি
আপনি আপনার স্ত্রীকে কতোটুকু ভালোবাসেন? প্রশ্নটি শুনেই যেন একটু হকচকিয়ে গেল রাতুল। নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে বললো, “আমার বিরুদ্ধে নীরার কোনো অভাব অভিযোগ আছে নাকি! আমি ওর সব প্রয়োজন মেটানোরই যথাসাধ্য চেষ্টা করি।" কাউন্সিলর আবারো বলেন, “এটাতো আপনার কর্তব্য, আমি জানতে চাইছি আপনি স্ত্রীকে কতোখানি ভালোবাসেন?” রাতুল একটু নড়েচড়ে বসে বলে, “আমি খুবই কেয়ারিং হাসবেন্ড। সন্তানদের দেখাশোনার ক্ষেত্রেও আমি নীরাকে সাহায্য করার চেষ্টা করি।" কাউন্সিলর আবারো বলেন, “এও তো আপনার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ছে। আমার প্রশ্নটি খুব সাদামাটা, আমি জানতে চাইছি আপনি স্ত্রীকে কতোটুকু ভালোবাসেন। মনে হচ্ছে আপনি প্রশ্নটিই ধরতে পারছেন না।"
এবার বোকার হাসি হেসে রাতুল বললো, এতো কোনো সাদামাটা প্রশ্ন নয়, বরং ভীষণ জটিল প্রশ্ন। এভাবেতো আসলে কখনোই ভেবে দেখিনি। কাউন্সিলর মুচকি হেসে বললেন “কী ভালোবাসেন যে বুঝতেই পারেন না। আর এ বুঝতে না পারাটাই সব সমস্যার মূল।"
অধিকাংশ দম্পতির প্রায় পুরো জীবনই কেটে যায় এ প্রশ্নের উত্তর না জেনে বা না খুঁজে। অথচ দিব্যি চলছে সংসার। দুটো মানুষ পাশাপাশি হেঁটে চলছে জীবনের দীর্ঘ পথ। কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশের অভাবে হয়তো নিজের অজান্তেই সমান্তরাল পথের পথিক হয়ে কেটে যায় সারাবেলা। এক জীবনের হয়তো বহু কিছুই ভাগাভাগি করে নিয়েছে স্বামী স্ত্রী। কিন্তু তা যতো না ভালোবেসে তারচেয়ে অনেক বেশি অভ্যাসের বশে। অধিকাংশের হয়তো জানাই হয় না ভালোবাসার স্বাদ, রং গন্ধ। হয়তো ভালোবেসেও জানা হয় না ভালোবাসা আছে।
রাতুল নীরা একে অপরকে স্পর্শ করে প্রয়োজনে অভ্যাসে। কিন্তু অপ্রয়োজনের স্পর্শেই হয়তো লুকিয়ে আছে ভালোবাসা। এমনকি প্রচণ্ড ভালোবাসা স্বত্ত্বেও শুধু প্রকাশের অভাবে অজানা থেকে যায় জীবনের এক কাঙ্খিত অধ্যায়। তাই প্রতিটি দম্পতির সম্পর্ককে পরিচর্যা করা দরকার। পরিচর্যা আর চর্চাতে সাধারণ সম্পর্ক হয়ে উঠতে পারে অসাধারণ, পরিস্থিতির পাঁকে গড়ে ওঠা সম্পর্ক হতে পারে অপার ভালোবাসার পরিভাষা। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, তুচ্ছ আচরণ পারে জীবনের সহযাত্রীকে ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করাতে। তবে এরজন্য চাই সচেতন প্রচেষ্টা আর সাধ্যের মাঝে অনুভূতি ব্যক্ত করার প্রয়াস।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হতে হবে সতেজ সাবলীল। যেখানে বিশুদ্ধ হাওয়া খেলে যাবে অবিরত। এজন্য পারস্পরিক শেয়ারিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরের কাছে মন খুলে কথা বলার আবহ তৈরি করতে হবে সম্পর্কের মাঝে। পাশাপাশি সঙ্গীর কথা শোনার মতো মানসিকতা থাকতে হবে অপর সঙ্গীর। শুধু খোলামেলা আলাপ আলোচনার বদৌলতে একই অপরের খুব ভালো বন্ধুতে পরিণত হতে পারে, তেমনি এক ধরনের নির্ভরতা তৈরির কারণে বিশ্বাস আস্থার বন্ধনটিও হয়ে উঠতে পারে অনেক গাঢ়। মাঝে মাঝে সঙ্গীর প্রশংসা করুন। শুধু দেখতে সুন্দর লাগছে বলে ক্ষান্ত দিলে চলবে না। বরং ব্যক্তির কাজের প্রশংসা করুন। এতে করে যেমন আপনার সঙ্গীটি অনুপ্রাণিত হবে বহুগুণ অন্যদিকে আপনার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য নিজেকে আরো বেশি পারফেক্ট করতে উদ্যত হবে প্রতিনিয়ত। কারণ আপনার প্রশংসাই আপনার সঙ্গীর সাফল্যের পাথেয় হতে পারে সবচেয়ে বেশি।
দাম্পত্য জীবনের বয়স যতোই হোক না কেন প্রতিদিন নিজেদের জন্য একান্ত সময়, হোক তা কয়েক মুহূর্ত, খুঁজে নিন। আপনার একান্ত একটি মুহূর্তও সারাদিনের সব ক্লান্তিকে করে দিতে পারে ম্লান। দাম্পত্যের বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেকেই মনে করেন জীবন আটপৌঢ়ে ঢঙে কেটে যাবে। একান্ত মুহূর্ত প্রত্যাশা যেন এ বয়সে আদিখ্যেতা। অথচ সময়ের সাথে এই একান্তের রুপ ধরন বদলালেও আবেগ বদলায় না।
সঙ্গীকে স্পর্শ করুন বারবার। স্পর্শমাত্রই যৌনতা, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং স্পর্শই পারে ব্যক্তির দৈহিক অনুরণনের মাত্রার সাথে অপরের অনুরণনের মাত্রার ছন্দ তৈরি করতে। আর এই ছন্দই ব্যক্তির দাম্পত্য জীবনের কমফোর্ট জোন তৈরি করতে সাহায্য করে।
একে অপরের পছন্দ অপছন্দকে মনে রাখুন এবং প্রাধান্য দিন। ৩৬৫ দিন থেকে মাত্র দু’একটি দিন সম্পূর্ণ রুপে সঙ্গীর ভালোলাগার জন্য উৎসর্গ করুন। বিশেষ বিশেষ দিন দিবসে খুব সামান্য হলেও অসামান্য ভালোবাসা নিয়ে কিছু উপহার দিন। উপহার যে মূল্যবান হতে হবে একেবারেই তা নয়। অর্থ নয় আবেগ দিয়ে উপহার মূল্যায়ন করুন। সঙ্গীর পছন্দের প্রাধান্য দিয়ে কোনো আয়োজন করুন।
জীবনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও একটু সময় বের করে বেড়াতে চলে যান। সামর্থ্য অনুযায়ী দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ান বছরে অন্তত দুবার। খরচের বিষয়টি চাপ সৃষ্টি করলে গ্রামের বাড়িতেই কাটিয়ে আসুন দু’চারটা দিন। প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ততা একঘেয়ে জীবন থেকে ছুটি নিন। আর নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় সময় কাটান সঙ্গীর সাথে।
এমন বহু ছোট ছোট ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি নিজেকে প্রশ্ন করুন, সঙ্গীকে কতোটুকু ভালোবাসেন। নিজের মনে বোঝাপড়া সেরে নিন এবং যৌক্তিক উত্তরের খোঁজ করুন। উত্তর যদি ইতিবাচক নাও হয় তাহলেও নিজেকে তৈরি করার পরিকল্পনা নিন। মনে রাখবেন দায়িত্ব কর্তব্য করণীয়র ভীড়ে ভালোবাসার অনুভূতি যেন গুলিয়ে না যায়। আর সর্বোপরি বারবার বলুন, “তোমায় ভালোবাসি”। এ বাক্যটি যেমন আপনার সঙ্গীকে সুখী করবে তেমনি বারবার বলার কারণে ভালোবাসা জন্মাবে, বাড়বে বারবার। দাম্পত্য সুখ স্বস্তি তৃপ্ত করবে আপনার মন।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/পিআর