ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচনের আগেই জয়ের আশা

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:৩৪ এএম, ২৪ জুলাই ২০২৩

নির্বাচনের আগে আমরা অনেকগুলো শব্দ ব্যবহার করি- অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য। সবাই আন্তরিক হলে এর সবগুলোই করা সম্ভব, শুধু গ্রহণযোগ্য ছাড়া। একটি নির্বাচন যতই অংশগ্রহণমূলক হোক; অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হোক; গ্রহণযোগ্য কখনোই হবে না।

পরাজয় মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে নেই। হারলেই আমরা কারচুপি, সূক্ষ্ম কারচুপি, চুরি, ডাকাতি, রাতে ভোট- নানান বাহানা তৈরি করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান। পরাজয় মেনে নেওয়াকে আমরা আরেক দফা পরাজয় মনে করি। মেনে নেওয়া মানেই যেন ডাবল পরাজয়। কিন্তু কখনোই আপনি সবসময় জিতবেন না। জীবনে, ক্যারিয়ারে, খেলায়, রাজনীতিতে, নির্বাচনে আপনি কখনো সফল হবেন, কখনো ব্যর্থ; কখনো জিতবেন, কখনো হারবেন।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে- ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস। কিন্তু সেই পিলার নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনা নেই। পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে যে আমরা ভবিষ্যৎ জয়ের প্রস্তুতি নেবো, সেটা আমাদের মনোজগতেই নেই। আমরা যে কোনো ভাবে জিততে চাই; কৌশলে, কূটকৌশলে, গায়ের জোরে, প্রশাসনের জোরে; যে কোনো মূল্যে।

এটা ঠিক গণতন্ত্রে দ্বিতীয় বা রানার্সআপ বলে কোনো কথা নেই। উইনার্স টেকস অল। এক ভোটে জিতলেও আপনি জয়ী, এক লাখ ভোটে জিতলেও আপনি জয়ী। এটাকে আপনি গণতন্ত্রের অসুবিধাও বলতে পারেন, সুবিধাও বলতে পারেন। নির্বাচনে যাই হোক, কে আপনাকে ভোট দিলো, কে দিলো না; সেটা বিবেচ্য নয়; জয়ের পর আপনি সবার প্রতিনিধি।

সর্বশেষ ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোট ভোটারের মাত্র ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তিনি কিন্তু এখন সবার প্রতিনিধি। জাতীয় নির্বাচনেও আপনি কম মানুষের ভোট পেয়েও পাঁচ বছরের জন্য দেশ শাসনের দায়িত্ব পেতে পারেন। উদাহরণের জন্য বলি- ১৯৯১ সালে কাস্টিং ভোটের ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করেছিল বিএনপি। তার মানে যারা ভোট দিতে এসেছিলেন, তাদের ৭০ ভাগের ভোট না পেয়েও বিএনপি পাঁচ বছর দেশ চালিয়েছে।

আবার ১৯৯৬ সালে কাস্টিং ভোটের ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করার অধিকার পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। তার মানে কাস্টিং ভোটের ৬২ শতাংশের ভোট না পেলেও দেশ চালানোর অধিকার ছিল আওয়ামী লীগের। গণতন্ত্রে এমন অনেক শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোট কম পেলেও তাতে আসনের ব্যবধান ছিল ৫২। ভোটকেন্দ্রে যাওয়া যেমন ভোটারদের অধিকার, না যাওয়ার অধিকারও সবার আছে। গত কয়েক বছরে নির্বাচন নিয়ে, গণতন্ত্র নিয়ে, ভোটাধিকার নিয়ে মানুষের আগ্রহ তলানিতে নেমে এসেছে।

ঢাকা-১৭ আসনে ভোট দিতে এসেছিলেন মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ। ২০১৪ সালে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। গণতন্ত্রে কিন্তু তাতে কোনো বাধা নেই। কয়েকবছর আগে চট্টগ্রামে এক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। কিন্তু তারপরও সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছিলেন। জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া প্রার্থীরও জয়ী হওয়া সম্ভব বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। এত যে শুভঙ্করের ফাঁকি তারপরও গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই। সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও অন্য যে কোনো ব্যবস্থার চেয়ে ভালো।

 

রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে জনগণের কথা বললেও কাজে তারা জনগণকে গোনায়ই ধরে না। দুই দল একই দিনে সমাবেশ করলে জনগণের ভোগান্তি হবে, এটা জেনেও সবাই তাই করে। যে দল জনগণকে বেশি ভোগাতে পারবে, তাদের কর্মসূচি যেন তত সফল।

 

বলছিলাম জয়ের কথা। সবাই জয়ী হতে চায়। গত শনিবার এডিটর্স গিল্ড আয়োজিত এক আলোচনায় সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেছেন, ‘নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করবেন, তারা আগেই শতভাগ জয়ের নিশ্চয়তা চান। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিলে হারজিত মেনে নিতে হয়।’ একই অনুষ্ঠানে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে ১১টি নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে আমরা কখনো দুটি নির্বাচনের পরিবেশ একই রকম থাকতে দেখিনি। আস্থার সংকট আমাদের নির্বাচনী পরিবেশকে সব সময়ই নষ্ট করেছে। এক দল অন্য দলের প্রতি, সরকারের প্রতি জনগণের, নির্বাচনী সংস্থাগুলোর প্রতি রাজনীতিকদের আস্থা নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রমনা হতে হবে।’

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মূল সমস্যা হলো, নির্বাচনের আগেই জয়ের নিশ্চয়তা চাওয়া এবং পারস্পরিক অনাস্থা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। পরাজিত দল জয়ী দলকে অভিনন্দন জানায়। আমরা যাদের হাতে পাঁচ বছেরর দেশের ভার দিতে প্রস্তুত, তাদের হাতে তিন মাসের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দিতে রাজি নই।

১৯৯৬ সালে হেরে যাওয়ার শঙ্কায় আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই ক্ষমতায় গিয়েছিল। সেই আওয়ামী লীগ আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে। ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সময় তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পাগল আর শিশু ছাড়া আর কেউ নিরপেক্ষ নেই।’ কালের বিবর্তনে সেই বিএনপি আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যেতে অনড়। নির্বাচনের আগেই জয়ের নিশ্চয়তা ছাড়া কেউ নির্বাচনে যেতে চাইবে না।

নির্বাচন সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দল এখন মাঠ দখলে রাখতে মরিয়া। বিএনপি সমাবেশ ডাকলে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ ডাকে। বিএনপি পদযাত্রা ডাকলে আওয়ামী লীগ শান্তি শোভাযাত্রা ডাকে। কিন্তু শোভাযাত্রা সবসময় শান্তিপূর্ণ থাকে না। একসাথে মাঠে থাকলে সংঘাতের আশঙ্কা থাকেই, সংঘর্ষ হয়ও। কিন্তু তাও কেউ মাঠ ছাড়তে রাজি নয়। নির্বাচনের আগে জয় নিশ্চিত করতে মাঠের দখল রাখাটাও জরুরি।

সমাবেশ যত বড়ই হোক, তাতে হয়তো ভোটারদের অতি ক্ষুদ্র অংশের উপস্থিতি থাকে। তাও সমাবেশের বড়ত্ব দিয়ে আমরা রাজনীতির জয়-পরাজয় মাপতে চাই। যেন মাঠ ছেড়ে দিলে বা সমাবেশ ছোট হলেই নির্বাচনে পরাজয় হয়ে যাবে। মাঠের উপস্থিতি দিয়ে, শক্তির মহড়া দিয়ে আমরা একটা ধারণা তৈরি করতে চাই। সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করে যেন ভোটাররা ভোট দিতে আসে।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ সামান্যই। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে জনগণের কথা বললেও কাজে তারা জনগণকে গোনায়ই ধরে না। দুই দল একই দিনে সমাবেশ করলে জনগণের ভোগান্তি হবে, এটা জেনেও সবাই তাই করে। যে দল জনগণকে বেশি ভোগাতে পারবে, তাদের কর্মসূচি যেন তত সফল।

আমরা যদি সত্যি গণতান্ত্রিক হই, তাহলে জয়-পরাজয় নয়, সবার আগে ভাবতে হবে জনগণের কথা। পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। আর থাকতে হবে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, মর্যাদাবোধ। তাহলেই নির্বাচনে জনগণের জয় হবে, গণতন্ত্রের জয় হবে।

২৩ জুলাই, ২০২৩
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন বাংলা।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন