শিশুদের মানসিক বিকাশে ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা
শিশুদের মানসিক, সামাজিক, আর নৈতিক বিকাশে ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুরা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। ব্যস্ততার অজুহাতে সেই চাহিদা পূরণ করতে চান না অনেক অভিভাবক। ভ্রমণ শিশুর বিকাশে সহায়তা করে। শিশুরা পরিবেশ থেকে শেখে। তারা নতুন নতুন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যত জীবনকে সুন্দর করে। ভ্রমণ শিশুর শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে। এর মাধ্যমে শিশুরা খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশতে পারে। ভ্রমণ শিশুর স্মৃতিতে সুন্দর সময় ও সুখস্মৃতি তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে অনুপ্রেরণা যোগায়। প্রত্যেক শিশুকে নিয়ে খোলামেলা পরিবেশে ঘুরতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আজকাল আমাদের শিশুরা তাদের অবসর সময়ে হয় মোবাইল, ল্যাপটপ নিয়ে বসে। একটু ছোট শিশুরাও টিভি না হয় মোবাইল নিয়ে তাদের অবসর সময় কাটায়। মা বাবারা প্রায়ই ওদের সাথে রাগারাগি করে থাকে, এমনকি মারও দিয়ে থাকে।
কিন্তু একবারও ভেবে দেখেনি যে ওরা সময় পেলেই যে টিভি, মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে বসে যাচ্ছে, সেখানে ওদের দায় কতটা আর বাবা মায়েদের দায়-ই বা কতটা। কারন, বাবা মার চাওয়া থাকে, তারা যেভাবে বড় হয়েছে, বেড়ে উঠেছে, ওরাও সেভাবেই বেড়ে উঠবে, বড় হবে। সেটা সম্ভব নয় একেবারেই। তারা যখন বড় হয়েছে, বেড়ে উঠেছে, তখন এসব আধুনিক ডিভাইস তো নয়ই, সবার ঘরে, গ্রামে টিভি পর্যন্ত ছিলনা। তাই এসময় বড় হওয়া, বেড়ে ওঠা নিয়ে তাদের মা বাবাদের দুশ্চিন্তা করতে হয়নি।
এসব ডিভাইসের পরিবর্তে তাদের আশেপাশে ছিল নানা রকম খেলা, প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর পরিবর্তনের আনন্দ, সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ। দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি,খুব বেশি হলে হয়তো কোন সমুদ্র তীরে। মূল ভ্রমণ হত, দাদা, নানা, চাচা, চাচি বা মামা বা ফুপু বাড়ি, কোন গ্রামে, বা শহরের আদলে গড়ে ওঠা কোন মফস্বলে, বছরে মাত্র একবার। আর সেই ভ্রমণের আগে এবং পরের সময়, নানা রকম জল্পনা, কল্পনা, স্মৃতি রোমন্থন করেই কেটে যেত দিন, মাস আর বছর। পরের আর একটা ভ্রমণের প্রত্যাশায়।
ভ্রমণ যে কোন শিশুর মানসিক বিকাশে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। ভ্রমণহীন শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। করোনাকালীন সময়ে ভ্রমণহীন শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ সময়ে তার মানসিক বিকাশ তো হয়নি বরং আগে তারমধ্যে যেসব মানবিক, সামাজিক গুণাবলী ছিল, ধীরে ধীরে সেগুলো কমে যেতে শুরু করেছে, নানা অসাভাবিক আচার আচরণ করছে, যা আগে কখনও করতো না।
আগে বেড়ানোর নানা রকম জল্পনা, কল্পনা, বাজেট, স্বপ্ন, কেনাকাটার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা নিয়েই শিশুদের সবটুকু অবসর কেটে যেত। টাকা নষ্ট করতে চাইতোনা, কিছু খেতে চাইতোনা, কিছু কিনতে চাইতোনা, সেই টাকা জমিয়ে রাখতো ও নিজে হিসেব রাখতো। সেই জমানো টাকা দিয়ে এয়ার টিকেট কাটবে, না কেএফসিতে খাবে, বা একদিন ভালো কোন হোটেলে থাকবে বা এসি ট্রেনে ভ্রমণ করবে,তা নিয়ে কেটে যেত অবসর সময়। সব ভ্রমণের আগে পরে সে নিজে নিজেই গুগল সার্চ করে, বিভিন্ন স্পট খুঁজে বের করতো, বাবা মাকে দেখাতো, নিজে নিজে শর্ট লিস্ট করে রাখতো। যাওয়ার আগে আর ফিরে এসে গন্তব্যের নানা রকম ছবি দেখতো, আলাপ আলোচনা করতো। ভ্রমণ শুরুর আগে ও পরে এসব নিয়েই নানা রকম গল্প চলতো।
প্রকৃতি থেকে শিক্ষা অর্জন করে নিত শিশুরা এবং মানবিক আর সামাজিক গুণাবলী রপ্ত করে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেত। নদীর উৎপত্তি কোথা থেকে আর কিভাবে হয়, ঝর্ণা ধারার উৎস কোথায়, আমাদের জীবনে পাহাড় না নদী কতটা উপকারী, ভ্রমণে কখনো কোথাও কোন ময়লা না ফেলা, নোংরা না করা, সাতারের গুরুত্ব, হাটা, ট্রেকিং বা হাইকিং স্বাস্থের জন্য কতটা উপকারী, ভ্রমণ থেকে শিশুরা জীবনমুখী যে শিক্ষাটা রপ্ত করে, সেটা হল যে কোন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার মানসিকতা গড়ে উঠে খুব ভালো ভাবে। শুধু ভ্রমণ করে, ভ্রমণ নিয়ে ভেবে, ব্যস্ত থেকেছে শিশুরা। এসময় সে টিভি, মুভি, কার্টুন দেখতে ও অপছন্দ করতো!মোবাইল বা ল্যাপটপ, ইউটিউব, গেম বা ইন্টারনেট তো ভাবনার বাইরে ছিল। কোনদিন মার, বকাঝকাও দিতে হয়নি। জীবন ছিল ব্যস্ত, গোছানো আর নিয়মের মধ্যে। খারাপ মানসিকতা তৈরি হবার সময় পায়নি।
ভ্রমণে শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে, এসময় শিশুর প্রয়োজনীয় জিনিসের একটি তালিকা করে ফেলতে হবে। সেই তালিকা ধরে জিনিস ব্যাগে নিতে বলতে হবে শিশুটিকে। এতে প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিস বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। বাবা মাকে শিশুকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে যেন,রাতে বা মাঝরাতে ছাড়বে এমন বিমান বা বাসের টিকিট না কাটাই ভালো। সারা রাত ঘুম না হলে শিশুরা সারাদিন স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবে না। শিশুর জন্য বাড়তি ও শুকনা খাবার রাখতে হবে হাতের কাছে। কোনও কারণে লঞ্চ,ট্রেন বা বিমান দেরি করে পৌঁছলে শিশুর যেন কোনও সমস্যা না হয়। শিশুর প্রয়োজনীয় ঔষধ অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। শিশু যদি বেশি ছোট হয় ও বাইরের খাবারে অভ্যস্ত না হয়, তার বেবস্থা রাখতে হবে। হোটেল থেকে ঘুরতে বের হওয়ার সময় শুকনো ফল,পানির বোতল, বিস্কুট বা সেদ্ধ ডিম নেয়া যেতে পারে। বাড়তি দুই সেট কাপড় সঙ্গে নিয়ে নেয়া ভালো।
ভ্রমণ আগেও ছিল, এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে। শুধু সময়ের সাথে সাথে তার নাম, রূপ আর ধরন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই বড় হয়েছে, বেড়ে উঠেছে, মানসিক বিকাশ হয়েছে আজকের শিশুদের বাবা মাদের। মানবিক এবং সুস্থ জীবন যাপন করেছেন তারা। ভ্রমণ মানুষের মানসিক বিকাশে অন্যতম গুরুত্বূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তখন। যা শিশুদের ক্ষেত্রে আরও অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন এখন।
লেখক: কনসালটেন্ট: নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এন্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ: ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল।
এইচআর/জিকেএস