আমি কীভাবে মরবো?
একমাত্র একটি বিষয়েই মূর্খ থেকে পণ্ডিত আমরা সকলেই নিশ্চিত যে আমাদের সবাইকে মরতে হবে। কারো জন্য মৃত্যু এগিয়ে আসবে ধীর পায়ে, কারো জন্য আকস্মাৎ। যদি খুব গভীরভাবে ধর্মীয় অনুভূতি সম্পন্ন হই তাহলে একবাক্যে বলে দিতে পারি, মেনে নিতে পারি, জন্ম-মৃত্যু বিধাতার হাতে। কে কখন, কীভাবে জন্মাবে বা মরবে সেটা ঈশ্বরের ঠিক করে দেয়া। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তো আমাদেরকে ভাববার মগজ দিয়েছেন, কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। সেই কারণেই তো আমরা প্রাণিকূলে শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়ে বেঁচে আছি। সভ্যতাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি।
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সভ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে কি তবে স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর এক দাবি কিংবা প্রত্যাশা কী করা যায়? চারপাশের ঘটনা সমূহ দেখে প্রবলভাবেই শঙ্কা জাগছে, আমি কীভাবে মরবো! এই আমার বাংলাদেশে আমি জন্মেছি উত্তাল মার্চে। আমি আমার দেশের স্বাধীনতার বয়সী। আমার জন্মের পরই আমার মা-বাবাকে গ্রামে, অরণ্যে, গর্তে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। সেই সময় আমি বা আমার পিতা-মাতা মারা যেতে পারতেন। সে মৃত্যু গর্বের হতো। আমরা শহীদ হতাম। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চারপাশের অনেক প্রাণ নিয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নানা কৌশলে এবং প্রায়শই জঘন্যভাবে এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে। সেইসব ভয়াবহ মৃত্যু যতো আকস্মিকই হোক তার গৌরব এই যে তারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে।
পরাধীন ও আক্রান্ত দেশের জন্য ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মৃত্যু হলেও সবাই বলতে পারে, বলে, তিনি দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। গানে, কবিতায়, গল্পে তাদের মৃত্যু গাথা লেখা হয়। আজ আমার দেশ স্বাধীন, সার্বভৌম। স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রায় পাঁচ দশকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কি একটি জিনিস আমাদের দিতে পারে না, স্বাভাবিক জন্ম ও মৃত্যু। নবীন ও প্রিয় এই দেশের কাছে এইটুকু সামান্য দাবি কি আমি রাখতে পারি? পথে-ঘাটে, আস্তাঁকুড়ে নয়, আমার দেশের শিশুরা জন্মের সময় পাবে সুন্দর পরিবেশ। নিজের ঘরে কিংবা হাসপাতালে, ক্লিনিকে জন্মাবে একটি শিশু। পৃথিবীতে প্রথম পদাপর্ণের মুহূর্তটি কুৎসিত হবে না। চারপাশের প্রতিটি মানুষ তাকে মায়া ও আদরে বরণ করবে- এইটুকু গৌরবের জন্ম কি একটি শিশুকে আমরা দিতে পারি না!
নবজাতক শিশু বদল হয়ে যাবে, চুরি হবে কিংবা ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হবে সে দৃশ্য স্বাধীন দেশে গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সঠিক, দুর্ঘটনার কোনো হাত পা নেই। সে যে কোনো সময় আসতে পারে আততায়ী হয়ে। তাই বলে কি, আধুনিক বাংলাদেশে দুর্ঘটনার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি থাকবে না। যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে মানুষকে বাধ্য করবো কাজ করতে এবং তাদের মৃত্যু হলে কোনো দায় কি নেবে না আমার দেশমাতা! ভবন চাপা, গাড়ি চাপা পড়ে এদেশে মৃত্যুটা তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এইসব অস্বাভাবিক, অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে আমরা চমকাই না।
সম্প্রতি গাছ চাপা পড়ে মারা গেলেন আমাদের চলচ্চিত্র পরিচালক খালিদ মাহমুদ মিঠু। কিষণ চন্দরের একটা গল্প আছে ‘চাপা পড়া মানুষ’। সেই গল্পে একটি লোক গাছ চাপা পড়ে, এই চাপাপড়া মানুষটি উদ্ধারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক হয়ে উঠে গাছটি কারা সরাবে? মিউনিসিপালিটি, বন বিভাগ ইত্যাদি ইত্যাদি মানে কারা এই গাছের মালিক। মালিক ছাড়া অন্য কেউ তো দায়িত্ব নিতে পারে না! এই সব তর্ক-বিতর্কের ভিড়ে লোকটি মারাই গেলো। মিঠু অবশ্য তর্কের সুযোগ দেননি। সাক্ষাৎ মৃত্যু হলো তার। কিন্তু একজন সভ্য মানুষের সভ্য দেশে গাছ চাপা পড়ে আকস্মিক মৃত্যুর কথা আমার জানা নেই।
আমার বাংলাদেশে মৃত্যু কতো বিচিত্র আর আকস্মিকই না হতে পারে! এই সব দেখে শুনে আমার মনে বারবারই প্রশ্ন জাগে, আমার মৃত্যুটি কেমন হবে? রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে, ভবন ধসে, হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায়, র্যাবের ক্রসফায়ারে, পাইপের নিচে পড়ে গিয়ে, গ্যাসের পাইপ ফেটে? না, যতোবার ভাবতে চাইছি নিজের বাড়িতে প্রিয়জনদের মুখ দেখতে দেখতে মৃত্যু হবে আমার কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসকদের মমতায় মৃত্যু হবে আমার সেই ছবিটা আমার মন মেনে নিতে পারছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, মৃত্যুর গ্যারান্টি আছে আমার, কিন্তু শান্তিতে মরার গ্যারান্টি নেই। প্রিয় পাঠক, আসুন, আজকে আমরা প্রার্থনা করি, আমার আপনার আমাদের সবার একটি স্বাভাবিক মৃত্যু হোক। আমাদের মৃত্যু দেখে কেউ যেনো আঁতকে না ওঠে।
স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আমরা কার কাছে আবেদন করতে পারি? কে আমাদেরকে বলে দেবে, যেভাবে মরো, ভালোভাবে মরবে তুমি। বেঁচে থাকার অনেক মৌলিক অধিকারই আমরা দিতে পারছি না। মৃত্যুর একটি মৌলিক অধিকার আমাদের দেয়া হোক, স্বাভাবিকভাবেই মরতে চাই আমি।
লেখক : চলচ্চিত্র গবেষক, লেখক, প্রকাশক
এইচআর/এমএস