ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রতি বছরে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক?

সম্পাদকীয় | প্রকাশিত: ০২:০৪ এএম, ১৪ মার্চ ২০১৬

দেড় কোটি মানুষের এই রাজধানী ঢাকা শহরসহ সারাদেশে বাড়ি ভাড়া দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তদারকির কেউ নেই। ফলে আয়ের অধিকাংশই যাচ্ছে বাড়ি ভাড়ায়। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। ডিসিসির তালিকাও মানছে না কেউ। ভাড়াটিয়ার সঙ্গে চুক্তির নিয়ম ও দু’বছরের মধ্যে ভাড়া বাড়ানোর নিয়ম না থাকলেও হরহামেশাই তা হচ্ছে। ৮০ শতাংশ বাড়িওয়ালারা বাড়ি ভাড়ার আয় দিয়ে চলেন। কোনো কিছুর দাম বাড়লেই ভাড়া বাড়ান বাড়ির মালিকেরা।

একদিকে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন গতি। এর সঙ্গে যাতায়াত, লেখাপড়া ও চিকিৎসা খরচ- সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা সাধারণ মানুষের। যে হারে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে তাতে আয়ের ৮০ শতাংশ চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে।

লাগামহীন এ বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে হতাশ তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প-কারখানার শ্রমিক, নগরের নিম্নবিত্ত মানুষ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

বাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে বেশির ভাগ বাড়িওয়ালার একই কথা- নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া, গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, দফায় দফায় বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এসব কারণেই বাড়িভাড়া বাড়াতে হচ্ছে।

রাজধানীসহ সারা দেশের কোটি নগরবাসীর ভাড়িভাড়া নিয়ে একটা প্রশ্ন। বাড়িভাড়া বৃদ্ধি কবে শেষ হবে? একটি বাসায় পাঁচ বছর, ১০ বছর থাকলেও বাড়িভাড়া বৃদ্ধি বন্ধ হয় না। ২০ বছর থাকলেও কি বাড়তেই থাকবে ভাড়া? তাহলে ভাড়া শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

প্রতি মাসের শেষে এবং শুরুতে রাজধানীসহ সারা দেশের শহরগুলোতে চোখে পড়ে বাড়ি বদলের দৃশ্য। অনেকেরই বাসা বদলের পেছনে অন্যতম কারণ হলো বাড়া বৃদ্ধি। ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে নতুন বাসায় ওঠেও কি কারোর স্বস্তি আছে?

যখন কেউ একটা নতুন বাসায় উঠে তখন মনে মনে ঠিক করে আর বাসা পাল্টাবে না। কিন্তু দেখা যায় বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার সেই একই বিড়ম্বনা। এমনভাবে ভাড়া বাড়ায় যে, আর মানিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। এভাবে চলছে বছরের পর বছর। এক বাসা থেকে আরেক বাসায় জীবনটা যেন যাযাবরের মতো।

নতুন বাসা খোঁজা, বাসাবদল করার মতো ঝামেলা এবং কষ্টের কাজ আর হয় না। টাকা যেমন খরচ হয় তেমনি টানাটানিতে নষ্ট হয় জিনিসপত্রও। কিন্তু তারপরও পাল্টাতে হয়।

বাড়িভাড়া বৃদ্ধির নতুন চাপ নিয়ে নতুন বছর শুরু করতে হয় নগরবাসীকে। এবার সে চাপ আরো বেশি। কারণ নতুন জাতীয় পে-স্কেল ইতিপূর্বে বাস্তবায়ন হয়েছে। অনেকে নতুন জাতীয় পে-স্কেলে বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু একটা স্বস্তিতে নেই রাজধানীর প্রায় দেড় কোটি ভাড়াটিয়া।

সরকারি খাতে বেতন বাড়ানোর ফলে বেসরকারি খাতেও বেতন বাড়ানোর প্রত্যাশা তৈরি হবে। তবে বেতন বাড়ানোর মতো পরিস্থিতি এখন সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান চাইলেই বেতন বাড়াতে পারবে না। তবে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের যে হারে বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সে পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি হতে কয়েক বছর লাগতে পারে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন বৃদ্ধি না হলেও প্রতি বছর বাড়িভাড়া বৃদ্ধি থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না কেউ।

একই অবস্থা রাজধানীর বাইরে অন্যান্য শহরের ভাড়াটিয়াদের। ডিসেম্বর মাস এলেই বাড়িভাড়া বৃদ্ধির মানসিক চাপে ভুগতে থাকেন। জানুয়ারিতেই বাড়তি ভাড়ার নোটিশ জানিয়ে দেন বাড়ির মালিকেরা। ভাড়া বৃদ্ধির কোনো প্রতিবাদ চলে না।

বাড়িওয়ালার সাফ জবাব, পোষাইলে থাকেন, না পোষাইলে চলে যান। বাসায় মেহমান এলে অনেক বাড়িওয়ালা সহজভাবে নিতে চান না। কখনো কখনো মেহমান বেশি দিন অবস্থান করলে আকারে ইঙ্গিতে অপমানজনক কথা বলেন বাড়িওয়ালা।

ভাড়াটিয়া জীবনের বিড়ম্বনা এবং হয়রানির যেন কোনো শেষ নেই। ভাড়াটিয়া জীবনে বাড়িওয়ালার সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়িয়ে চলতে পেরেছেন এরকম সৌভাগ্যবানের সংখ্যা খুব কমই আছে। বাড়িওয়ালা কর্তৃক হয়রানি এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেক ভাড়াটিয়ার।  

একধাপে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করা সত্ত্বেও বাড়ি ছেড়ে দিতে পারেন না অনেক ভাড়াটিয়া। তাদের বাচ্চারা এলাকার স্কুলে পড়ে। অনেক সময় তাদের পরীক্ষা থাকে। বাচ্চার বাবা এলাকায় চাকরি করে। এসব কারণে চাইলেই হঠাৎ করে বাসা বদলানো যায় না। বাসা খোঁজা এবং বাসা বদল করতে পরিবারের সবাইকে হাড়ভাঙা খাটুনির শিকার হতে হয়। এসব কারণে অনেকে বাসা বদল করতে চান না । আর এ সুযোগ নেন অনেক বাড়িওয়ালা।

ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ করলে বাড়িওয়ালা সামন্ততান্ত্রিক আচরণ করেন ভাড়াটিয়াদের সাথে। ভাড়াটিয়াদের তারা কোনো মানুষ মনে করেন না। মালিক ভাড়াটিয়াদের সাথে কথা বলেন না। বাড়ি ছাড়ার সময় দারোয়ানকে দিয়ে বলায় বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা। কেন বাড়ি ছাড়তে হবে এর কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া যায় না।

এলাকাভেদে প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভাড়া বেড়েছে ৫০০ টাকা থেকে ৬,০০০ টাকা পর্যন্ত। তবে অভিজাত এলাকার কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি বেড়েছে। বাড়ি ভাড়ার আইন ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত বাড়ি ভাড়ার রেট না মেনেই ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়।

বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির মালিকরা এলাকাভিত্তিক মোটামুটি একজোট হয়েই ভাড়া বৃদ্ধি নির্ধারণ করেন। কোনো বাড়িওয়ালা ভাড়া না বাড়ালে তাকে অন্য বাড়িওয়ালাদের চাপে পড়তে হয়।

দেশে বাড়ি ভাড়ার আইন থাকা সত্ত্বেও বাড়ির মালিকরা তা মানছেন না। এ ছাড়া তোয়াক্কা করছে না ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্ধারণ করা বাড়ি ভাড়ার রেট। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে দিন দিন বাড়ছে বাড়িওয়ালাদের এ স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ। আর রাজধানীতে আবাসন সমস্যা তীব্র হওয়ায় এসব আচরণ সহ্য করতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। অযৌক্তিক এ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। এতে যে হারে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে তাতে মোট আয়ের ৮০ শতাংশ চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া দিতে। ফলে একরকম মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের।

ঢাকা শহরে মোট হোল্ডিংয়ের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। অথচ গত ২৬ বছরেও বাড়ানো হয়নি হোল্ডিং ট্যাক্স। ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে। গৃহহীন মানুষের তুলনায় বাড়ির সংখ্যা কম হওয়ায় বাড়ির মালিকরা ইচ্ছামতো বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আর এ নৈরাজ্য দূর করতে ডিসিসি ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ঢাকা শহরকে ১০টি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে আলাদা আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়।

ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিসিসি আবাসিক এলাকাকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে। মেইন রোডের পাশে হলে একরকম ভাড়া, গলির ৩০০ ফুটের মধ্যে হলে একরকম ভাড়া আর গলির ৩০০ ফুটের বাইরে হলে আরেক রকম ভাড়া।

আবার আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প- এ তিন ক্যাটাগরিতেও ভাগ করা হয়েছে। এ ছাড়া হোল্ডিং নম্বর, নির্মাণের সময়কাল, কাঠামো, নির্মাণশৈলী, অবস্থান ও পজেশন হস্তান্তরের শর্তের ওপর ভিত্তি করে ভাড়ার তারতম্য হতে পারে বলে ডিসিসি বিধান করেছে। তবে বিধান থাকলেও ডিসিসি নির্ধারিত ভাড়া মানা হচ্ছে না।

ঢাকার মোট অধিবাসীর ৯০ শতাংশই ভাড়াটে। কিন্তু সরকার ভাড়াটেদের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। বাড়িভাড়া নিয়ে নামমাত্র যে আইন আছে, সেটি বাস্তবায়িত হয় না। কোন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে, সে ব্যাপারে আইনে কিছু বলা নেই। এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের করার কথা। আর ঢাকা সিটি করপোরেশন সব বাড়ির হোল্ডিং কর নির্ধারণ করে দেয়। কাজেই তাদেরই উচিত প্রতিটি বাড়ির ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া। সিটি করপোরেশনের এমন একটি তালিকাও আছে, কিন্তু সেটিও মানা হয় না। অনেকে জানেনও না।

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সরকারই উদ্যোগ নেয়নি। জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইনেও বাড়িভাড়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ফলে বাড়িমালিকেরা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন, বছর বছর ভাড়া বাড়াচ্ছেন। কোনো কোনো বাড়ির মালিক বছরে দুইবার ভাড়া বৃদ্ধি করেন-জানুয়ারি এবং জুন মাসে।

আইনে বাড়ির ভাড়া মানসম্মতভাবে নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। মানসম্মত ভাড়া সম্পর্কে এই আইনের ১৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবে না। বাড়ির বাজার মূল্য নির্ধারণ করার পদ্ধতিও বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪ তে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে। এ ভাড়া বাড়ির মালিক ও ভাড়াটের মধ্যে আপসে নির্ধারিত হতে পারে। আবার ভাড়ানিয়ন্ত্রকও নির্ধারণ করতে পারেন। এটাকে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে ঢাকা সিটি করপোরেশান ঢাকা মহানগরীকে দশটি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে ক্যাটাগরি ভিত্তিক সম্ভাব্য বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে।

দুই বছরের আগে বাড়ির ভাড়া বাড়ানো যাবে না। কোনো বিরোধ দেখা দিলে বাড়ির মালিক বা ভাড়াটের দরখাস্তের ভিত্তিতে দুই বছর পর পর নিয়ন্ত্রক মানসম্মত ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে পারবেন। বাড়িওয়ালা যদি মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া ভাড়াটের কাছ থেকে আদায় করেন, তাহলে প্রথমবার অপরাধের জন্য মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরবর্তী প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

১৮নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ১৮৮২ সনের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না কেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়ি ভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না।

এমনকি ১৮(২) ধারা মতে বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলেও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। চুক্তিপত্র না থাকলে যদি কোনো ভাড়াটে প্রতি মাসের ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করেন, তাহলেও ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।

যুক্তিসংগত কারণে ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করতে চাইলে যদি মাসিক ভাড়ায় কেউ থাকে, সে ক্ষেত্রে ১৫ দিন আগে নোটিশ দিতে হবে। চুক্তি যদি বার্ষিক ইজারা হয় বা শিল্পকারখানা হয়, তবে ছয় মাস আগে নোটিশ দিতে হবে।

১৯৯১-এর ১০ ও ২৩ ধারা মোতাবেক বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বাড়ি মালিক তার ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ এক মাসের বাড়ি ভাড়ার অধিক কোনো প্রকার ভাড়া, জামানত, প্রিমিয়াম বা সেলামি গ্রহণ করতে পারবেন না। তা হলে দণ্ডবিধি ২৩ ধারা মোতাবেক তিনি দণ্ডিত হবেন।

এই আইনে বাড়ির মালিককে ভাড়ার রসিদ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এ রসিদ সম্পন্ন করার দায়দায়িত্ব বাড়িওয়ালার। রসিদ প্রদানে ব্যর্থ হলে ভাড়াটের অভিযোগের ভিত্তিতে বাড়িওয়ালা আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আইনে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর, ভাড়া আদায়ের রসিদ দেওয়া, এক মাসের বেশি অগ্রিম না নেওয়া, হঠাৎ করে বাসা ভাড়া না বাড়ানো এবং বাড়ি ছাড়ার আগে নোটিশ দেওয়ার বিধান রয়েছে।

কিন্তু বিধান থাকলেও মানছেন না কেউ। এতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত বাড়ি ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। আর এভাবেই গত ২৬ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ ভাগ।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকায় গত ২৬ বছরে (১৯৯০-২০১৫) বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৩৮৮ শতাংশ।  ১৯৯০ সালে ভাড়া বেড়েছে ২৫.৭৯%। ১৯৯১ সালে ২১.৭৫%, ১৯৯২ সালে ১৩.৪৩%, ১৯৯৩ সালে ১২.১৬%, ১৯৯৪ সালে ১৬.৪৪%, ১৯৯৫ সালে ২২.৬১%, ১৯৯৬ সালে ১৭.৮৬%, ১৯৯৭ সালে ১৫.০৩%, ১৯৯৮ সালে ১৪.০৯%, ১৯৯৯ সালে ১৮.২৪%, ২০০০ সালে ১৫.০৮%, ২০০১ সালে ১৭.০৪%, ২০০২ সালে ১৩.৪৯%, ২০০৩ সালে ৮.০৪%, ২০০৪ সালে ৯.৯৬%, ২০০৫ সালে ৭.৮৯%, ২০০৬ সালে ১৪.১৪% এবং ২০০৭ সালে ২১.৪৮% ভাগ। জরিপে আরো দেখানো হয়, ১৯৯১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ১১৬.৯৬%। এই সময়ে বাড়িভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, অর্থাৎ ২৫৯.৪৫%। সর্বশেষ ২০১২ সালে ৯.৭৩, ২০১৩ সালে ১০.৯১, ২০১৪ সালে ৯.৭৬ ও ২০১৫ সালে ৬.৩৩ শতাংশ হারে ভাড়া বেড়েছে। ক্যাবের হিসাবে, এখন ঢাকায় দুই কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিতে খরচ হয় গড়ে ১৮,১৫০ টাকা, যা ২০১০ সালেও ১১,৩০০ টাকা ছিল।

পাকা ঘর কিন্তু ওপরে টিনের শেড এমন ঘরের ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে এমন ঘরে যেখানে ভাড়াটেরা থাকতে পারতেন ৯,২৭০ টাকায়, গত বছর তাদের থাকতে হয়েছে ৯,৭৩৫ টাকায়। আট শয্যাবিশিষ্ট মেস বাড়ির ভাড়াও বেড়েছে গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে এমন বাসার ভাড়া ছিল ১৫,৭৮৫ টাকা, গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬,৫০০ টাকায়।

তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বস্তি বাসার ভাড়া। প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১৩ সালে দুই কক্ষের বস্তি বাসার ভাড়া ছিল যেখানে ৬,০০০ টাকা, গত বছর ভাড়া দিতে হয়েছে ৭,০০০ টাকা।

অথচ ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য সেই পাকিস্তান আমলেও আইন ছিল, এখনো আছে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশ প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৯১ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন হয়। কিন্তু এ আইনের কোনো সুফল কখনো আবাসিক ভাড়াটিয়ারা পায়নি। কারণ আইনটি কার্যকর করতে কোনো সংস্থা কাজ করেনি।

বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিরোধের কারণ চিহ্নিত করতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।

ছয়মাসের মধ্যে সাত সদস্যের এই কমিশন গঠন করতে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কমিশনের প্রধান হবেন একজন আইনজ্ঞ। সর্বশ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া বিরোধের কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উপায় সুপারিশ করবে কমিশন।

এই কমিশন বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মতামত নিয়ে, প্রয়োজনে গণশুনানি করে এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করবে।

সরকারের আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে বাড়িভাড়া বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রত্যেক ওয়ার্ডে একজন নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ নিয়ন্ত্রক নিয়োগে সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।

২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ রিট আবেদনটি করে। ২০১৩ সালে রুলের শুনানি শেষ হওয়ার পর এই রায় দেয়। কিন্তু সেই রায়টি কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে?

সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ জীবনযাপনের মৌলিক প্রতিটি অধিকার নিয়েই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকে দেশের মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাসস্থানের সমস্যা। বাড়ি ভাড়া এখন যন্ত্রণার আরেক নাম।

এদিকে বাড়ি ভাড়া আইন-১৯৯১ এর ৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না।

আইনের ১৩ (১) ধারা মোতাবেক বাড়ি ভাড়ার রসিদ ভাড়াটিয়াকে দিতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা ভাড়া নিয়ে রসিদ দেন না। আইনের ১৫ ধারা অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্ব বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের। তবে সরকারের কোনো সংস্থা এ নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দেবে সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই।

ফলে ঢাকা জেলা প্রশাসন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ডিসিসি বা সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা এ আইন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। আর এভাবেই গত ২৬ বছর ধরে অকার্যকর রয়েছে আইনটি।

একদিকে আইনটি উপযোগিতা হারিয়েছে, অন্যদিকে এর কোনো প্রয়োগও নেই। ভাড়াটেদের অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কয়েকটি সংগঠন আন্দোলনও করে। কিন্তু তা কতটা কার্যকর হয়? কার্যকর না হওয়ার কারণে প্রতিবছেরে ভাড়া বৃদ্ধি পেতে থেকে। এভাবে প্রতি বছর বাড়িভাড়া বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক? এটাই এখন দেশবাসীর প্রশ্ন।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। পরের বছর বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়, যা দেশ স্বাধীনের পরও ১৯৮৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

১৯৮৬ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৬৩ সালের অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এর মেয়াদ ছিল ৩ বছর এবং তা ১৯৮৯ সালে শেষ হয়। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ জারি করেন। এ আইনে কোনো মেয়াদের কথা উল্লেখ নেই।

সরকার বাড়িভাড়া আইন সময়োপযোগী করে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং দেশের আবাসন সমস্যা সমাধানে অধিক সক্রিয় হবে; এটিই সকলের প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন