ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানোর চ্যালেঞ্জ

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৮:৫৫ এএম, ০৫ জুন ২০২৩

বাজেট নিয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক সাখাওয়াত আলী খানের একটি গল্প আছে। গল্পটি আমি আগেও লিখেছি। আসলে বাজেট এলেই আমার গল্পটি মনে পড়ে। সাখাওয়াত আলী খান একবার রিকশায় যেতে যেতে বাজেট নিয়ে রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। রিকশাচালক বললেন, এটুকু বুঝি বাজেট দিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। তার কৌতূহল ছিল, যে জিনিস দিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, সে জিনিস না দিলে কী হয়? তবে বাজেট দিলেই দাম বাড়ার সেই দিনও ফুরিয়েছে অনেক আগেই। এখন দাম বাড়ে বছরজুড়েই। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রীর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাই মূল্যস্ফীতির প্রবল চাপ সামলে যুদ্ধের অভিঘাত থেকে বাংলাদেশকে আগলে রাখা, জনগণকে স্বস্তি দেয়া।

বাজেট নিয়ে আমার বোঝাপড়াও সেই রিকশাচালকের মতই। স্বীকার করছি, বাজেট ব্যাপারটা আমি একদমই বুঝি না। অন্য সবার মত কোন জিনিসের দাম বাড়লো আর কোনটার কমলো; এটা মনোযোগ দিয়ে দেখি। আয়কর কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসলো কিনা দেখি। সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করেছেন তা ২৪৮ পৃষ্ঠার। তবে আগের মত এখন আর অর্থমন্ত্রীকে পুরো বক্তৃতা পড়তে হয় না। প্রযুক্তির ছোঁয়া বাঁচিয়ে দিয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা আর বাজেট ডকুমেন্টস হিসেবে সরবরাহ করা মোটা মোটা সব বই নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো ভাবনা নেই। সাধারণ মানুষ একটু স্বস্তি চায়, শান্তি চায়।

বাজেট ভালো বুঝি না। তবে এটুকু বুঝি, একটা সংসারের যেমন সারাবছরের একটা পরিকল্পনা থাকে, আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব থাকে, অনেক উচ্চাকাঙ্খা থাকে, বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকে, চিকিৎসার জন্য খরচ বরাদ্দ থাকে। দেশেরও তেমনি। বাজেট মানে দেশের সারাবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব। এখানে সরকারের প্রায়োরিটি ঠিক করা থাকে। পরিবারের আয়-ব্যয়ের হিসাব করার সময়ও আমরা প্রায়োরিটি ঠিক করি। পারিবারিক হিসাবের সময় আমরা অনেক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা করি, যেমন বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকে হয়তো মালদ্বীপ, শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয় কক্সবাজার। তেমনি দেশের বাজেটেও অনেক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা থাকে, যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় না।

বাজেট প্রস্তাবনার সাথে বাজেট বাস্তবায়নের অনেক ব্যবধান থাকে। সরকার যত দক্ষ, ব্যবধান তত কম। এখানেই মুন্সিয়ানা। এখন আমাদের আয় বেড়েছে, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বেড়েছে। ইতিমধ্যে মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। কর্ণফুলি নদীর নিচে টানেলও তৈরি হয়ে গেছে। তবে খালি আয় বাড়ালেই হবে না। ঠিকমত ব্যয় করতে পারাটাও একটা দক্ষতা। এ ব্যাপারে আমাদের দক্ষতায় এখনও অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের তাড়াহুড়ো দেখেই বোঝা যায় ব্যয় করাটা আমরা এখনও ভালো করে খরচ করা শিখে উঠতে পারিনি।

আগে যেমন বাজেটের আগেই ‘গণমুখী বাজেট’ আর ‘গণবিরোধী বাজেট’ ব্যানার লেখা তৈরি থাকতো। বাজেট প্রস্তাবনার সাথে সাথেই সরকারি ও বিরোধী দল রাজপথে মিছিল বের করতো। সেই দিন অনেক আগেই গত হয়েছে, রাজনীতি এখন রাজপথ থেকে নির্বাসিত। তবে মানতেই হবে, অগ্রগতিটা ইতিবাচক। রাজপথে মুখস্ত মিছিল বাদ দিয়ে এখন বাজেট নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্কের লড়াই হয়। বাজেট পেশের সাথে সাথে রাজনৈতিক নেতা, অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন সংগঠন বাজেট নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বাজেট নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে বাজেটের পরদিন অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির বাজেট প্রতিক্রিয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। মোটা মোটা বই দেখে বাজেট না বোঝা আমার মত বোকা মানুষেরা বাজেট বোঝার চেষ্টা করি এইসব প্রতিক্রিয়া শুনে।

এটা ঠিক এবারের বাজেট সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কোভিডের ধাক্বা সামলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের লড়াই শুরু হতে না হতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব অর্থনীতির জন্যই আরো বড় ধাক্কা হয়ে আসে। গত একবছরে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমেছে। ডলারের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। গতবছরটি আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য দারুণ চ্যালেঞ্জের ছিল। এমনকি সঙ্কট উত্তরণে আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। আইএমএফ আবার ঋণের সাথে জুড়ে দেয় নানান শর্ত।

একদিকে আইএমএফ’এর শর্তের চাপ, অন্যদিকে সামনের নির্বাচন দুয়ে মিলে বাজেট বানানোটা সরকারের জন্য কঠিন ছিল এবার। সরকার মুখে বারবার বলছে, ‘এটা নির্বাচনী বাজেট নয়, আবার আইএমএফ’এর শর্ত মেনেও বানানো হয়নি। অবশ্য সরকারের কথা ভুল প্রমাণ করার মত কোনো দর্শনও নেই বাজেটে। বরং প্রস্তাবিত বাজেট মধ্যবিত্তের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করবে। করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হলেও, রিটার্ন নিতে বাধ্যতামূলক ২ হাজার টাকা করের প্রস্তাব নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। সম্পদশালীদের ওপর করের চাপ বাড়ে তো নাই, বরং কিছুটা ছাড়া পেয়েছেন তারা। সারচার্জের সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি করা হয়েছে।

এবারের বাজেট প্রতিক্রিয়ার বেশিরভাগজুড়েই আছে মূল্যস্ফীতি। বাজারের আকাশ ছোঁয়ার সাধ, সাধারণ মানুষকে পাতালে নামিয়ে দিয়েছে। সীমিত আয়ের মানুষ কোনোভাবেই বাজারদরের সাথে পাল্লা দিয়ে পারছে না। সবকিছুর দামই বাড়তির দিকে। হঠাৎ হঠাৎ কোনো কোনো আইটেম মানুষের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সীমাও ছাড়িয়ে যায়। কখনো পেঁয়াজ, কখনো আদা, কখনো চিনি, কখনো তেল- মানুষের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয়। কিন্তু আমরা এত ধৈর্যশীল সব মুখ বুজে সয়ে যাই। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ ভাগের ওপরে। অর্থমন্ত্রী সেটা ৬ ভাগে নামিয়ে আনার আকাঙ্খার কথা বলেছেন। কিন্তু কীভাবে নামাবেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। বোঝাই যায়, এটা আসলে কথার কথা। আমার প্রত্যাশা ছিল মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে কিছুটা মুক্তি দিতে অর্থমন্ত্রী সৃষ্টিশীল কোনো প্রস্তাবনা নিয়ে আসবেন। সবসময় একই লাইনের বাজেট দিয়ে সঙ্কট সামলানো যায় না। বড় সঙ্কট সমাধানের জন্য চাই আউট অব দ্য বক্স ভাবনা। তেমন কোনো ভাবনা বা সৃষ্টিশীলতার কোনো ছাপই নেই বিশাল বাজেটে। বাজেটের আকার বড় হয়েছে, তবে তা গতানুগতিক ধারায়।

এটা ঠিক বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিটা আমদানিনির্ভরতার কুফল। দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়েই কেবল এই নির্ভরতো কমানো সম্ভব। তবে সেটা তো আর রাতারাতি সম্ভব নয়। আমরা যদি এখন থেকেও দেশীয় উৎপাদনে নজর দেই, দক্ষতার সাথে করলেও সেটার ফল পেতে কয়েকবছর লেগে যাবে। ততদিন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলে কতটা টিকে থাকতে পারবেন, শঙ্কা সেটা নিয়েই।

নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারকে এই মুহূর্তে দুটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। প্রথম হলো বাজারদর, আর দ্বিতীয় হলো বিদ্যুৎ। এই দুটি আবার পরস্পর সংশ্লিষ্ট। ঠিকমত বিদ্যুৎ না পেলে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে। আর উৎপাদনে ঘাটতি হলে বাজারদর বেড়ে যায়। এই চক্র ভেঙ্গে সরকার কীভাবে সাধারণ,মানুষকে একটা স্বস্তিকর জায়গায় নিতে পারবেন, সেটার ওপরই নির্ভর করছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

৪ জুন, ২০২৩

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন