ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

চেতনাদীপ্ত মার্চ ও ‘রাজনীতির কবি`র ‘অমর কবিতা’

প্রকাশিত: ০২:০৫ এএম, ১২ মার্চ ২০১৬

চেতনাদীপ্ত মার্চ মাস ঐতিহাসিকভাবে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসেরই ১৭ তারিখ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ২৫ মার্চের কালরাত্রে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু প্রত্যুষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণটি শুধু স্বাধীনতাপ্রত্যাশী বাঙালি জাতির মুক্তির দলিল নয় আজও ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত।
 
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জনগণের নির্বাচিত অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯ মিনিটের যে ভাষণটি প্রদান করেছিলেন সেটি কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় “রাজনীতির কবি”র ‘অমর কবিতা’, রাষ্ট্র রাজনীতি ও ইতিহাসের ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আগাম ঘোষণাপত্র আনুষ্ঠানিক পাঠের আয়োজন। তবে সব কিছুই বঙ্গবন্ধু করেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা ও দূরদর্শিতাকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে, কোনোভাবেই আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে এমন একটি জনসভার আয়োজন তখন যেমন ছিল অপরিহার্য, একই সঙ্গে জনগণকে তার যা বলার দরকার ছিল- তিনি তা বলে গেলেন চমৎকারভাবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথাই যেন একে একে বলে গেলেন, কোথাও যেন কিছু বলার বাকি রাখলেন না।

ভাষণে দু’বার বললেন, “এ বারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। একাত্তরের অগ্নিঝরা সেই মার্চের শুরুতে এর চাইতে স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার কথা আর কোনোভাবে বলার সুযোগ তখন ছিল না। একই সঙ্গে চমৎকারভাবে তিনি কিছু দিক নির্দেশনাও দিলেন, বললেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার এবং স্পষ্ট করে বলে দিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোবাবিলা করতে হবে। তিনি তখন স্পষ্টই যেন দেখতে পাচ্ছিলেন যে, পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার জনগণের আকাক্ষাকে দমন করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং একই সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করা অথবা মেরেও ফেলা হতে পারে, তাতেও যেন কিছু যায় আসে না, শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, স্বাধীনতাকে এভাবেই ছিনিয়ে আনতে হবে- এ কথাই বঙ্গবন্ধু তার অনবদ্য ইঙ্গিতের আশ্রয় নিয়ে ভাষণে একের পর এক বলে গেলেন।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহর-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে বলা কথাই যেন হুবহু মিলে গেল। কিন্তু যেহেতু ৭ তারিখেই নেতা বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি যদি হুকুম দিবার না-ও পারেন- সে কথাই মানুষ ২৬ তারিখ স্মরণ করে পাকিস্তানীদের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে। সশস্ত্র সেই প্রতিরোধই মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হলো। এতে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, নারী, পুরুষ, তরুণ, কিশোর, বাঙালি সেনাসদস্য, পুলিশ, ইপিআর সদস্য নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। যদিও ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত বঙ্গবন্ধুর একটি তারবার্তা চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গায় প্রচারিত হয়েছিল, বিদেশি মিডিয়া এবং চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু সেই ঘোষণা শোনার জন্যে অপেক্ষা করেনি গোটা দেশের মানুষ। চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারের শব্দ গোটা পূর্ববাংলা শোনার মতো অবস্থানে ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি ছিল সরকারি আনুষ্ঠানিকতা। এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি বঙ্গবন্ধুর গোটা ভাষণটি এক কথায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মতোই মনে হয়েছিল। এতে একটি দেশ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট যেমন বর্ণনা করছিলেন, আবার করণীয় সব কিছুই যেন একে একে বলছিলেন। পুরো ভাষণটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে, চিৎকার করে প্রতিটি লাইনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। সব কিছুই তিনি বললেন তৎকালীন বাস্তবতাকে মাথায় রেখে, কৌশলে উপস্থিত শ্রোতারাও বুঝে নিলেন তাদের মতো করে। এখানে কোনো অস্পষ্টতা বা দ্বিধার কিছু থাকে নি। এখানেই ৭ মার্চের ভাষণের অনন্যতা।

যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঈর্ষান্বিত ছিলেন, এখনও আছেন- তারা প্রায়শই বলার চেষ্টা করে থাকেন যে, বঙ্গবন্ধু সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেই ২৬ মার্চ পরবর্তী নয় মাসে যুদ্ধের প্রয়োজন হতো না। এটি রাজনীতির জ্ঞানপাপীদের কথা। বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তান  রাষ্ট্র ব্যবস্থা যতোক্ষণ পর্যন্ত জনগণের ওপর সরাসরি আক্রমণ না করছিল ততোক্ষণ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার বাস্তবতা ছিল না, তিনি যদি ৭ তারিখ ঘোষণা দিতেন, তাহলে তাঁর ঘোষণা বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিদেশে চিহ্নিত হতো। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছানো ১৯৭১ সালে সম্ভব হতো না ভবিষ্যতে সম্ভব হতো কিনা তা কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারে না।

মনে রাখতে হবে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী অপারেশন ‘সার্চ লাইট’ শুরু করা সত্ত্বেও পৃথিবীর অনেক দেশই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, সেক্ষেত্রে  ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করলে তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর তাক করা কামান, বন্দুক ও যুদ্ধজাহাজের মুখে পড়তো লাখো লাখো  নিরস্ত্র মানুষ। সেভাবেই পাকিস্তান বাহিনী প্রস্তুত ছিল, আন্তর্জাতিক মহলও বঙ্গবন্ধুকে দেখতো। তাছাড়া মানুষকে আগে মানসিক ও যুদ্ধের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলকভাবে তৈরি না করে সশস্ত্র যুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার পরিণতির কথাটি যারা বিবেচনায় নিতে পারে না তাদের ৭ মার্চের বাস্তবতা সম্পর্কে বেশি কিছু না বলাই শ্রেয়।

বঙ্গবন্ধু নির্বাচনোত্তর ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সম্যক সচেতন থেকেই ভাষণে কথা বলেছেন, ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই করণীয় নির্দেশনা দিয়ে কথা বলেছেন। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার শুরু থেকেই একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ হয়ে বেড়ে উঠেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক, রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রামের সংগঠকও তিনিই ছিলেন। সুতরাং তিনি সচেতন ছিলেন তার পদক্ষেপ সম্পর্কে, একই সঙ্গে পাকিস্তান সরকার সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী ছিলেন। সে কারণেই ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দ যেমন এক একটি ছিল বুলেটের মতো শক্ত, তেমনি মাপামাপা, তবে তাতে দরদ, ভালোবাসা ও আবেগ এতোটাই মিশ্রিত ছিল যে শুনতে গিয়ে সকলেই অবাক হয়ে শুনেছেন, সমর্থন জানিয়েছেন, স্বপ্ন তৈরি করেছেন। নেতার প্রতিটি শব্দে যেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা প্রতিভাত হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এটিকে না বলে উপায় আছে কি?

সম্মুখে করণীয়  সব নির্দেশনার কথাই তো বলা হলো, কিছুই যেন বাকি থাকে নি, আবার পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীও পারেনি বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে অভিহিত করে তাকে হত্যা করার কোনো উদ্যোগ নিতে। এমন ভাষণ শুনেই মানুষ প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ২৬ মার্চের একাত্তরের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের। সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়লাভও হয়েছে মুক্তি পাগল জনগণের। অবশেষে সত্য হলো ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত কথা- ‘এবারের সংগ্রাম...স্বাধীনতার সংগ্রাম।” স্বাধীনতার ঘোষণা একেই বলে। বঙ্গবন্ধু যেন সেই ঘোষণাপত্রই ৭ মার্চ লাখো জনতার উপস্থিতিতে নিজের কণ্ঠে বলে গেলেন।

বাংলাদেশ যতোদিন টিকে থাকবে, বঙ্গবন্ধুর সুরেলা সেই কণ্ঠের ১৯ মিনিটের ভাষণটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিখুঁত বিবরণ হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আগাম ঘোষণাপত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকবে। ২৬ মার্চে ঘোষণাপত্রের যেন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র ছিল, সেকারণেই ৭ মার্চ ২৬ মার্চের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের সেই বক্তৃতা শুনে নতুন প্রজন্ম অবাক বিস্ময়ে স্বাধীনতা মহান নেতাকে চিনতে পারবে, ভালোবাসবে, সেই গৌরবময় ইতিহাসের একজন হয়ে বেড়ে উঠবে। এই ভাষণ চিরকাল শোনা, বোঝা ও শেখার এক অমর ঐতিহাসিক কণ্ঠ দলিল, স্বাধীনতার অগ্রবর্তী ঘোষণাপত্র হয়ে থাকবে।

patoary

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন