ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আস্থাহীন বৈবাহিক সম্পর্ক সন্তানের জীবনের ঝুঁকি বাড়ায়

প্রকাশিত: ০৭:২৩ এএম, ১০ মার্চ ২০১৬

গণমাধ্যমে এ সময়ের আলোচিত খবর ঢাকার বনশ্রী এলাকায় এক মা গলা টিপে হত্যা করেছেন নিজ সন্তানদের। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও জানা গেছে শ্বাসরোধ করেই শিশু দু’টিকে হত্যা করা হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সন্তানদের লেখাপড়ার দুশ্চিন্তায় শিশুদের নিজ হাতে খুন করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনি। তাই যদি হয়, তাহলে বলা যায় যে লেখাপড়ার চিন্তাতো একজন মায়ের তখনই হয় যখন সন্তানের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ একসাথে কাজ করে। তাহলে কি তিনি স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন? তাছাড়া সন্তান লালন পালন করার দায়তো তার একারও নয়। লেখাপড়ার চিন্তাতো একই সাথে পিতার উপরেও বর্তায়। উপযুক্ত তদন্ত আর দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে বলে আমরা আশা করি। তার আগে তিনিই হত্যা করেছেন বা করেননি এমন বক্তব্য দেয়া যথার্থ নয়। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে তার কাছে সকল তথ্য আছে।

ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। পারিবারিক সহিংসতা,দাম্পত্য জীবনে বোঝাপড়ার অভাব, কলহ, দমন একে অপরের উপর শ্রদ্ধাহীনতা এ সবকিছুই এখন আমাদের জীবনের অংশ। দাম্পত্য কলহের উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে প্রথমেই যেটি বলা যায় তা হলো আস্থাহীন সম্পর্ক। সম্ভবত ২০১০ সালে সামিউল নামের একটি শিশু তার গর্ভধারিণী মায়ের অনৈতিক সম্পর্কের বলি হয়েছিলো। যতদূর মনে পড়ে শিশুটির মাকেই হত্যাকারী হিসেবে প্রথমত দায়ী করা হয়েছিলো, কিন্তু তদন্তে পরবর্তীতে দেখা যায় শিশুটি তার মা ও তার বন্ধুর অনৈতিক সম্পর্কের সাক্ষী হওয়াতে তাকে হত্যা করা হয়। নিরপরাধ শিশুরা যখন আমাদের পাপের বলি হয়, তখন সহজেই অনুমান করা যায় কোনদিকে হাঁটছি আমরা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের নির্মমতার হোতা পুরুষ। তবে অতি সম্প্রতি আশংকাজনকভাবে আমাদের দেশেও হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য অপরাধে নারীরা জড়িয়ে পড়ছেন। আমাদের দেশে বিয়ের আগে নারী পুরুষের ভালোবাসার সংস্কৃতি পিতৃতান্ত্রিকতা মুক্ত নয়। ভালোবাসার প্রলোভনে আত্মনির্ভরশীল নারীকে বিয়ের পর আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে সমাজ। উচ্চশিক্ষিত অনেক নারীই শুধু গৃহকর্ম আর সন্তান লালন পালন করতে গিয়ে হীনমন্য, ঈর্ষাপরায়ণ ও হতাশ হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে তাদের মনে জন্ম নেয় ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক ব্যাধি, যা কেড়ে নেয় তাদের স্বত্বা আর স্বাভাবিক জীবন। অন্যদিকে স্বামীরা বন্ধু না হয়ে স্ত্রীর প্রভু হয়ে থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে সমস্ত পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা নিজ কাঁধে বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে থাকেন স্বামীরা। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিত হলেও সামাজিক প্রথা আর অবকাঠামোর কারণে গৃহবন্দী হয়ে পড়েন স্ত্রী। সংসারের একঘেয়ে কাজের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে অচিরেই তিনি অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ফলে দেখা যায় যে বিবাহ নামক বন্ধনটিতে স্বামী আসলে স্ত্রীর বন্ধু নয়, প্রভু। তাই প্রভু আর দাসের মধ্যে খুব সহজেই দানা বাঁধে সন্দেহ, কলহ, প্রহার এবং অবশেষে হত্যা ।

উন্নত দেশে ডিভোর্স কাম্য না হলেও জীবনের প্রয়োজনে এটি খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। স্বামী স্ত্রীর বোঝাপড়ায় খুব বেশি আস্থা না থাকলে তারা পারস্পরিক শ্রদ্ধা অটুট রেখে যার যার পথ বেছে নেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় তাদের দাম্পত্য জীবন প্রলম্বিত করেন না। শিশুরাও তা খুব সহজে মেনে নেয়। কারণ তারা কখনই চাইবে না পিতামাতা একে অপরের উপর বল প্রয়োগ করুক। তাছাড়া স্ত্রী প্রহারতো দূরের কথা, উচ্চস্বরে কথা বলাও অন্যায়। আর শিশুদের উপর বলপ্রয়োগ করলে করতে হয় নিশ্চিত হাজতবাস। যেহেতু উন্নতদেশে স্বামী স্ত্রী দু`জনেই সমানভাবে উচ্চশিক্ষিত এবং সকল দিক থেকে সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল, তাই আমাদের দেশের মতো স্বামীর হাজারো দোষ মেনে শুধু অর্থনৈতিক কারণে মাটিকামড়ে পড়ে থাকতে হবে এমন সংস্কৃতির মধ্য নারীরা আবদ্ধ নয়। তাই তাদের দেশের সামাজিক প্রথা ও মূল্যবোধ নারী ও শিশুবান্ধব।

শিক্ষাসূত্রে দু’বছর ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে বসবাস করেছিলাম। আমাদের বাসার মালিক ভদ্রমহিলা তার কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে স্কটল্যান্ড যাবার সময় বিষয়টি আমাকে জানালেন। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি আনন্দ ভ্রমণে যাচ্ছিলেন কিনা। উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে তার সাবেক স্বামী হার্টএটাক করেছেন। তিনি তাকে সেবা করার জন্য যাচ্ছেন । তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মধুর হওয়াতে জানতে চেয়েছিলাম যে তার বর্তমান স্বামী এতে কিছু মনে করবেন কিনা। উত্তরে তিনি বললেন `জীবনের প্রয়োজনে দু’জনের শ্রদ্ধাঅটুট রেখে তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে, এখন তিনি মারা যাচ্ছেন, মানবিক দায়িত্বটাতো থেকেই যায়, তাতো কখনো ডিভোর্স করা যায় না,আর সে আমার সন্তানের পিতা’। আমাদের দেশে ডিভোর্সের পর প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রী শত্রুতে রূপান্তরিত হয়, যার কারণে ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারের সন্তানদের মানস গঠন অন্যান্যদের চাইতে কিছুটা অপরিপক্ক এবং বিপর্যস্ত হয়।

যাহোক, আমরা নিষ্পাপ শিশুর এমন মৃত্যু আর চাইনা। সংসারে আস্থা হারিয়ে গেলে যার যার শ্রদ্ধা অটুট রেখে সবাই সবার পথ বেছে নিক। নারী হোক শিক্ষিত, স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল। যেন অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে নারীরা অতিক্রম করতে পারে দুর্যোগপূর্ণ এই ক্রান্তিকাল। যেনো আর কোনো শিশু বাবা মা কিংবা তৃতীয় ব্যক্তির নির্মমতার শিকার না হয়। নারীর আত্মনির্ভরশীলতাই হোক সন্তানের অন্যতম নিরাপদ অভয়ারণ্য ।

লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স ট্রেনিং সেন্টার, বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স লিমিটেড
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন