দেশের স্বাধীনতা মানুষের মুক্তি
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও এ যুদ্ধে বিজয় বাঙালি সম্পর্কে প্রচলিত নিন্দার ভালো জবাব হয়েছিল। আমরা বীরত্ব ও ত্যাগের মন্ত্রে সেদিন সত্যিই জেগে উঠেছিলাম। কিন্তু তারপর যেন গোটা জাতিই খেই হারিয়ে ফেললাম। দুটি সামরিক শাসন আমাদের কেবল পিছনের দিকে নিয়ে গেছে। একই ধারা বজায় রাখলেন বেগম জিয়া। বাঙালি হয়ত ফিরল না পুরোনো অভ্যাসে, কিন্তু ব্যাপক মানুষের ইতিহাস জ্ঞান, জাতীয় চেতনার গোলমাল হয়ে গেল। আমরা হয়ে পড়লাম বিভ্রান্ত দিগভ্রান্ত জাতি।
আমরা জানি, বাঙালি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল জাতটা হুজুগে, আবেগপ্রবণ এবং কোমল স্বভাবের। এছাড়াও তার অনেক নিন্দা আছে, তা রবীন্দ্রনাথ সবিস্তারে বলেছেন বিদ্যাসাগর চরিত্রের বিপরীতে বাঙালির বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে। তাঁর মতে বাঙালি প্রচুর কথা বলে কিন্তু সে তুলনায় কাজ করে না, পরের নিন্দায় তুখোড় কিন্তু নিজের ভুল দেখতে পায় না, কোনো কাজ সাড়ম্বরে শুরু করলেও শেষ করে না। অর্থাৎ বাঙালি বাগাড়ম্বরপ্রিয়, অলস, পরশ্রীকাতর, অধৈর্য। প্রথম যে তিনটি ধারণার কথা বলা হল তার শেষেরটি অর্থাৎ কোমল স্বভাব এখন বোধহয় বাঙালিতে দুর্লভ। এমনকি বাঙালি মা সম্পর্কেও এ বিশেষণ প্রয়োগ করতে আজ কুণ্ঠা হবে।
শেষের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সবই রয়েছে কেবল আলস্য কেটেছে বলে মনে হয়। কিন্তু ধৈর্যহীন আবেগপ্রবণ মানুষ গুছিয়ে পরিকল্পনা করে কি কাজ করছে? বরং বাঙালির মধ্যে ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটানোর আবেগে বাঁধভাঙা জোয়ার আসায় সমাজজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তার বহর ও গভীরতা কতটা তা বোঝার জন্যে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। প্রথমত মায়ের হাতে আপন সন্তান খুন হওয়া। আবার সন্তানের হাতে আপন বাবা-মা খুন হওয়া। এমন ঘটনা কিন্তু আগেও হয়েছিল পরকীয়ায় মত্ত মা ও তার প্রেমিকার হাতে কিংবা নেশাগ্রস্ত ছেলের হাতে। এসব দেখে শুনেও আমরা সময় মতো গা করি নি, ঠিক মতো ব্যবস্থা নিই নি। দ্বিতীয়ত, একটি কোম্পানি কর্তৃক ( অর্থাৎ তিন/চারজন মিলে) একটি ব্যাংকের একটি শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দেওয়ার ঘটনা। দিনের পর দিন এরকম পুকুর চুরি চালিয়ে যাওয়া- এই দক্ষতা এবং সাহসের সত্যিই তুলনা হয় না।
আজ তুচ্ছ কারণে, প্রায় অকারণে, খুনোখুনির ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব মারাত্মক অপরাধ জঙ্গিরা ঘটাচ্ছে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেশাগ্রস্তরাও নয়। ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্ষা এবং ইন্দ্রিয়জ কামনা চরিতার্থ করার লোভ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। ছোটবেলায় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের একটি লেখা আমাদের পাঠ্য ছিল তাতে আছে মানুষের ভিতরের সু ও কু প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বের কথা। কোন প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হব তা বিচার করার ক্ষমতা মানুষকে অর্জন করতে হয়। কেননা মানুষমাত্রেরই লোভ, হিংসা, কাম, ক্রোধ এমন সব নেতিবাচক প্রবণতা থাকে। তাকে শিক্ষার মাধ্যমে, চর্চার ভিতর দিয়ে প্রশমিত রাখতে হয়, যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, অন্যের ক্ষতির কারণ না হই আমরা। কিন্তু আজকের পরীক্ষানির্ভর মুখস্থবিদ্যার শিক্ষায় চর্চার সুযোগ কোথায়, প্রয়োজনই বা বোঝে কে? জীবনের শুরুতে চরিত্র গঠনের সময়ে যদি চারিত্রিক গুণের বীজ না পড়ে তা হলে সে গুণগুলো কী করে একজন মানুষের মধ্যে বিকশিত হবে?
তাই আমরা একদিকে ফলাফলের ভিত্তিতে মেধায় ও উচ্চশিক্ষায় সফল মানুষে দেশ ছেয়ে যেতে দেখছি আর অন্যদিকে সেই সাথে নৈতিক বলে উন্নত চরিত্রের মানুষের আকালও দেখছি সর্বত্র। ঘুষের প্রলোভন জয় করা, অবৈধ উপার্জনের লোভ সামলানো, ফটকা বাজারে মুনাফা করে লাল হওয়ার খায়েশ রোধ করার ইচ্ছা এবং সাধ্য কারুর নেই। ফলে এ সমাজ নৈতিকতার কোনো ভিৎ দাঁড় করাতে পারছে না। ক্রমেই পরিস্থিতি এমন হচ্ছে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, একটা অবিশ্বাস ও ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে। নারীর পক্ষে পুরুষকে, শিশুর পক্ষে বড়দের, সংখ্যালঘুর পক্ষে সংখ্যাগুরুর, সাধারণের পক্ষে পুলিশকে, রোগির পক্ষে ডাক্তারকে এবং সর্বশেষ সন্তানের পক্ষে আপন মাকে, মা-বাবার পক্ষে আপন সন্তানকে বিশ্বাস করার মত বাস্তবতা থাকছে না। একি ভাবা যায়?
আমরা সব ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটাতে চাই। উদাহরণ টানি উন্নত দেশের। আমি কেবল অপরাধের কথা বলছি না। মানসিকতার সংকটের কথা বলছি। পরিবারের অভ্যন্তরে পারস্পরিক বিশ্বাসের সংকট থেকে সৃষ্ট দু’তিনটি ঘটনাকে সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলব না। কিন্তু সন্তানের সাথে বাবা-মার সম্পর্ক কি চর্চার মাধ্যমে গভীরতা পাচ্ছে, অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছে? নিতান্ত শিশুবয়সে কিছু সময় দিলেও, একটু বড় হওয়ার পর তো কেউ আর সন্তানকে সময় দিতে চান না। অসহায় গিনিপিগ শিশুরা কেবল স্কুল-কোচিং, পড়া-পরীক্ষার বৃত্তের মধ্যে জীবন কাটাতে থাকে। তা বলে অধিকাংশ খুনি হবে না নিশ্চয়, কিন্তু অধিকাংশের শৈশবকে খুন করা হচ্ছে বলে কেউই সুস্থ স্বাভাবিক মানবিক সত্তা নিয়ে বিকশিত হতে পারবে না। এ পরিণতির অনেকটা দায় বাবা-মা এড়াতে পারবেন না।
বড়দের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক না হওয়ায় বয়ঃসন্ধিকালে শিশুরা যেসব সমস্যায় ভোগে এবং যেসব আকাক্ষা তার মধ্যে জাগে সেসবের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা কিংবা সমাধান তাদের জানা হয় না। এ সময় তারা থাকে খুবই নাজুক, তাদের মনোজগৎ যথার্থ যত্ন ও সময়োচিত সাহচর্যের, পরামর্শ-উপদেশের অভাবে ভেঙে পড়তে পারে, আর নয়তো তারা মেজাজী, অসহিষ্ণু অধৈর্য এবং মারমুখী হয়ে উঠতে পারে। এরই প্রতিফলন দেখি বড় হওয়ার পরে তাদের জীবনে, নিত্যদিনের সামাজিক অভিজ্ঞতায়। এমন সমাজে যারা দুর্বল তারা সকলের হাতে অত্যাচারিত হয়। আর সবল অর্থাৎ ক্ষমতাবান উত্তরোত্তর তার প্রতিপত্তি একচেটিয়া করে নিতে থাকে। এভাবে সমাজে অপরাধ বাড়তে থাকে।
আমাদের সমাজ নারীবান্ধব নয়, শিশুবান্ধব নয়, সংখ্যালঘুদের প্রতি সদয় নয়, এমনকি নয় পরিবেশবান্ধব। সমাজে ভোগ ও দখলদারির মনোবৃত্তি বেড়েই চলেছে। সম্পত্তি দখল ও ভোগে মানুষের বাসনা কোনো বাঁধ মানছে না। আমরা লক্ষ্য করি বেপরোয়া এই মনোভাব বাড়বাড়ন্ত বলে ক্ষমতাবানের বা ক্ষমতাসীন পরিচয়ে অত্যাচারের মাত্রা সমাজের সহ্য করার বা শুষে নেওয়ার ক্ষমতা অতিক্রম করে গেছে। সমাজ নিজেও নানান অন্যায় ও অপরাধের সাথে আপোস করে এর প্রতিকারে আর সক্ষম নয়। তাই মোটামুটি দুদকসহ সকল প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ একযোগে পতনের গভীর খাদের দিকে চলেছে। ব্যক্তির বিবেক বা নীতিবোধ খড়কুটোর মত উড়ে যাচ্ছে সম্মিলিত অপরাধশক্তির কাছে।
উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে মানুষ ও সমাজের এই ডুবে মরার বাস্তবতা যদি দেখতে না পাই আমরা তাহলে সে হবে মস্ত আফসোসের ব্যাপার। কারণ এমন বাস্তবতায় কোনোভাবেই আমরা আর টিকতে পারব না। বরং এই বাস্তবতায় নতুন নতুন ঝকঝকে ফ্লাইওভার, সেতু-সড়ক, ভবনগুলো আমাদের উপহাস করবে। বিজয়ের বাগাড়ম্বর দিয়ে আত্মঘাতী সর্বনাশা পথে চলার পরিণতি ঠেকানো যাবে না। বরং এ অভ্যাস না ছাড়লে দেশের স্বাধীনতা থাকলেও মানুষের মুক্তি অধরাই থেকে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ঘোষণায় তো স্বাধীনতার পাশাপাশি মুক্তির কথাও ছিল। স্বাধীনতার মাসে এ ভাবনা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা এক মর্মান্তিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ
এইচআর/আরআইপি