দ্বৈতনীতি পরিহার করতে হবে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপি নিজেদের মিত্র বাড়াতে তৎপর। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের অভাব নেই আর জনসমর্থন বা সাংগঠনিক শক্তি থাকুক আর না থাকুক, সব দলই বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য ব্যস্ত। বড় দলগুলোর সঙ্গে থেকে নামসর্বস্ব দলও ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার স্বপ্ন দেখছে। ব্যাপারটা হাস্যকর কিনা জানি না, তবে আমার কাছে জোটভুক্ত কোনো কোনো দলের কর্মকাণ্ড তামাশা বলেই মনে হচ্ছে।
রাজনীতি কোনো সহজ কাজ নয়। এমনকি ভীরুর জন্যও রাজনীতি নয়। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা মনে করেন- শক্তি থাকুক আর না থাকুক, জোট করে হয় ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলবে, নতুবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থেকে ভাগ্য বদলের সুযোগ করে নেবে। যাদের এক শতাংশ ভোট নেই, যারা নির্বাচনে দাঁড়ালে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়, যারা প্রেস কনফারেন্স ছাড়া খোলা আকাশের নিচে জনসভা করার লোক জোগাড় করতে পারে না, তাদের জোটে শামিল হওয়ার তৎপরতা দেখে মানুষ কৌতুক অনুভব করে।
শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করলে যোগফল শুধু শূন্যই হয়, কখনো তা পূর্ণ সংখ্যায় রূপ নেয় না। যেসব দলের কোনো আসন পাওয়ার যোগ্যতা নেই, যেসব দলের কোনো ভোট ব্যাংক বা কর্মীও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, তারা যদি নির্বাচনকালীন জোটের জন্য লম্ফঝম্প করেন- তাহলে তাদের কর্মকাণ্ড ‘সিজনাল উপদ্রব’ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
জোট কিংবা রাজনীতির নতুন মেরুকরণ নিয়ে আমি আজ কথা বলতে চাই না; কথা বলতে চাই আগামী দিনে বিএনপির আন্দোলন পরিকল্পনা নিয়ে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ঈদের পর বিএনপি আন্দোলনের গতি বাড়াবে। অবশ্য এরকম কথা বিএনপি নতুন বলছে না। বহু ঈদ চলে গেলেও বিএনপির ‘ঈদের পর’ আর আসেনি, আন্দোলনও হয়নি। আইন-আদালত করে নয়, গণআন্দোলন করেই বিএনপির নেতাকর্মীরা দলীয় চেয়ারপারসনকে জেল থেকে মুক্ত করে আনবে বলেও হুংকার দিয়েছিল। কিন্তু কী ফল হয়েছে?
বক্তৃতায় সরকারের বৈধতা নিয়ে যতই কথা বলুক না কেন, এই সরকারের কাছে দরখাস্ত দিয়েই খালেদা জিয়াকে জেলের বাইরে নিষ্ক্রিয় জীবন কাটাতে হচ্ছে। বিএনপি এ পর্যন্ত বহু হুঙ্কার দিয়েছে, বহুভাবে সরকারকে হটাতে চেয়েছে, কিন্তু সরকার হটানো দূরের কথা, নিজেরাই এখন হটতে হটতে ছোট ছোট দলের শরণাপন্ন হচ্ছে।
বিএনপি জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত এককভাবে কোনো আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেনি। তারা বড়জোর ‘যুগপৎ’ আন্দোলন করতে পারে, অন্যের ঘাড়ে চড়ে আন্দোলনের সুফল ভোগ করতে পারে; কিন্তু নিজেরা কখনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, ভবিষ্যতে পারবে- তারও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
যে দল সাধারণ মানুষের স্বার্থে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে নেই, জনগণের কল্যাণে মোটেই মনোযোগী নয়, বরং জঙ্গিবাদ, ষড়যন্ত্র আর বিদ্বিষ্ট রাজনীতিই যাদের লক্ষ্য, সে দলের পক্ষে গণআন্দোলন গড়ে তোলা আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কী হতে পারে?
বিএনপির আন্দোলন মানেই তো আগুন সন্ত্রাস, বিদেশি নাগরিক হত্যা, বিদেশি শক্তির যোগসাজশে ষড়যন্ত্র করে গণতান্ত্রিক ধারা থেকে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী ধারায় নিয়ে যাওয়া। এই রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ কোন দুঃখে সম্পৃক্ত হবে? এমনকি বিএনপি সমর্থক জনগোষ্ঠীও এই দলের আন্দোলনের সঙ্গে থাকে না।
জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে নিজ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য ক্যান্টনমেন্টে থেকে জন্ম দিয়েছিলেন বিএনপি নামের দলটি। ক্যান্টনমেন্ট ছিল এই দলের শক্তির প্রধান উৎস। জিয়ার মৃত্যুর পরও খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছাড়েননি। আইনি প্রক্রিয়ায় ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এটাও ঠিক, ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে থাকতে খালেদা জিয়া নিজেকে যতটা ‘শক্ত’ ভাবতেন- ওই বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হওয়ার পর আর তিনি সে ‘শক্তি’ ফিরে পাননি।
বিএনপি যেভাবেই জন্ম নিক না কেন, দলটি অনেক বছর দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এর ফলে দলটি জনগণের একাংশের মাইন্ডসেট পরিবর্তন করে পাকিস্তানি ভাবধারায় প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। দলটি বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বোঝেনি। দলটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার উপায় খোঁজা ছাড়া উত্তরণের কোনো পথ কি সত্যি সত্যি দেখাতে পেরেছে?
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ভেবেছিল নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মেরে, ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে, জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বোমাবাজি করিয়ে নির্বাচিত সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে। কিন্তু তাদের এ অপকৌশল বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও কেন তারা আন্দোলনের স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। নানা উছিলায় নির্বাচনী রাজনীতির ধারার বাইরেই থাকতে চায় বিএনপি।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকেই আমরা বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের শত্রুদের বীভৎস চেহারা দেখে আসছি। শত্রুদের বৈরিতা অব্যাহত আছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও নানা সময়ে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছে একাধিকবার। এসব হত্যা-চেষ্টার সঙ্গে জড়িতরা কোনো না কোনোভাবে বিএনপির মদদ পেয়েছে। তবে বারবার বাংলাদেশ ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয়েছে, বারবারই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
আজ বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর চোখে শুধু উন্নয়নের মডেল নয়; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদাও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা বিশ্ববাসীর কাছ থেকে সব সময় এমন মর্যাদাই প্রত্যাশা করি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির ঊর্ধ্বমুখী সূচক ধরে। দেশের এ অগ্রগতিকে বাধা না দিয়ে এর সহযাত্রী হওয়াই সবার কর্তব্য। কিন্তু বিএনপি আছে সেই পুরনো ধারার বিরোধিতার রাজনীতিতেই। সরকারের গণবিরোধী কাজের বিরোধিতা অবশ্যই করতে হবে। একই সঙ্গে ভালো কাজের প্রশংসাও করতে হবে।
বিএনপির রাজনীতির ধারা দেখে প্রশ্ন আসে, দলটি কি সত্যি আন্দোলন করতে চায়, নাকি বাংলাদেশের উন্নয়নকে বিঘ্নিত করতে চায়? ক্ষমতায় গেলে বিএনপি আবার সেই পুরনো পথে দেশ চালাবে না- এ প্রতিশ্রুতি কি একবারও দিয়েছে? অনেকের শঙ্কা, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আবার জন্ম দেবে নতুন নতুন হাওয়া ভবন, বাংলা ভাই ও জঙ্গিবাদ। বিএনপির শাসনামলে আমরা একযোগে বাংলাদেশের সব জেলায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি।
এই বোমাবাজির ধারাবাহিকতায় ঘটেছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। ভাগ্যের জোরে শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ ২২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বিএনপি মন্ত্রী-এমপিদের যোগসাজশে দশ ট্রাক অবৈধ অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার কথা আমরা ভুলে যাইনি। বর্তমানে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আসাই কি বিএনপির গাত্রদাহের কারণ?
ক্ষমতাসীন সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের বিচার করে যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। সেই শাস্তি ভোগ করছে জামায়াত ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বিএনপি ও বিএনপির জোটভুক্ত দলগুলো জানে, এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে তারা কোনো জঙ্গি তৎপরতা চালাতে পারবে না, উন্নয়নের চাকা পেছনে ফেরাতেও পারবে না। তাই এমন কোনো কৌশল নেই তারা প্রয়োগ না করছেন সরকারের পতন ঘটানোর জন্য।
দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি নেই, তা নয়। আবার সরকারের কিছু কাজ নিয়েও মানুষের মধ্যে অসন্তোষ আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো শাসন উপহার দিতে পারবে? ঘুষ-দুর্নীতি কি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বন্ধ হবে? পুঁজি পাচার হবে না? এসব নিয়ে বিএনপি কি দেশবাসীর কাছে কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে? শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো বিকল্প নেতা-নেত্রীই বা কোথায়? জনগণের সমর্থন পেতে হলে এখন জনগণের ‘সেন্টিমেন্ট’কে মূল্য দিতে হবে।
যারা জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে সম্মান করবে না, জনগণের সুখ-শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাবে, জনগণ কখনোই তাদের সমর্থন জানাবে না। আজ যারা ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করছে, তাদের মনে রাখা দরকার, দেশের চরিত্র হনন করলে প্রকারান্তরে দেশের মানুষকেই অমর্যাদা করা হয়, ছোট করা হয়। দেশের বাইরে গিয়ে যারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে কিংবা দেশে থেকেও যারা জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের উস্কানি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাদের হাতে তো দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়।
আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করলে, জ্বালাও-পোড়াও করলে সঙ্গত কারণেই সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করবে। দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে সরকারকে শক্ত অবস্থানে যেতেই হবে। আন্দোলনের নামে বিএনপি মানুষ পুড়িয়ে মারবে, জামায়াতের মতো অপশক্তির সঙ্গে আঁতাত করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করবে, এটা সরকার চেয়ে চেয়ে দেখবে- এমনটি কখনো হতে পারে না।
সরকার পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক পথ নির্বাচন। তাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা, আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করুক। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বিএনপি নেতারা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং অহিংস রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পক্ষেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।
নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, মানুষ যাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে- তার জন্য বিএনপি জনমত তৈরি করুক। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার অবস্থান থেকে বিএনপি সরে আসুক। দেশ শাসন করবে দলীয় সরকার আর নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্দলীয় সরকার- এ দ্বৈতনীতি সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/জিকেএস