স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতেও কেন সুশাসনের ঘাটতি?
স্বতন্ত্র পরিচালক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে থাকলে যেখানে সুশাসন নিশ্চিত হওয়ার কথা সেখানে কেন ব্যাংক, অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানতকারীদের টাকা ঝুঁকিতে পড়ছে, শেয়ারধারী পরিচালকদের ইশারায় তাদের পছন্দের লোকেরা কীভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন? কেন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাধারণ শেয়ারধারীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন যার ফল হিসেবে বাজারে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে? বিষয়গুলো বোঝার জন্যই আমার এই লেখার অবতারণা।
উদ্যোক্তা পরিচালক অথবা প্রভাবশালী শেয়ারধারী পরিচালকরা যেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কোম্পানির কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে পারেন তা নিশ্চিত করতে পারেন কোম্পানির স্বাধীন পরিচালকরা। মূলত তারা উত্তমচর্চাকে মানদণ্ড ধরে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করেন, নিজেদের মতামত ও সিদ্ধান্ত জানান। পরিচালনা পর্ষদ ও এর বিভিন্ন কমিটিতে দায়িত্ব পালনকালে গোপনীয়তা বজায় রাখা, প্রচলিত আইন ও নীতির সঠিক বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখেন স্বাধীন পরিচালকরা।
যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয়ে কয়েক লাখ পাবলিক ও প্রাইভেট কোম্পানি নিবন্ধিত রয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখনো ৪০০ পার হয়নি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে পরিপালনের শর্ত হিসেবে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর বাইরে যে হাজার হাজার কোম্পানি ও ফার্ম রয়েছে, সেগুলোতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির শর্ত অনুসারে অনেক ধরনের কম্লায়েন্সই বাধ্যতামূলক নয়। এগুলো পরিচালিত হয় কোম্পানি আইনসহ দেশে প্রচলিত অন্য আইন ও বিধি অনুযায়ী। তবে তালিকাভুক্তির শর্তপূরণে সক্ষম এমন অনেক দেশি বা বহুজাতিক কোম্পানি আছে যেগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণে বা নতুন বিনিয়োগের জন্য পুঁজির দরকার হলও পুঁজিবাজার এড়িয়ে চলে। এরা প্রয়োজনীয় দীর্ঘমেয়াদি তহবিলের জোগান পায় দেশি-বিদেশি ব্যাংক কিংবা বিকল্প উৎস থেকে। নিজেদের গড়ে তোলা কোম্পানিতে স্বাধীন পরিচালকরা তদারকি করবেন, যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা শেয়ারধারী পরিচালকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় এই পথ এড়িয়ে চলছেন এমন উদ্যোক্তা আছেন অনেক। এই তালিকায় পাওয়া যাবে সরকারি কোম্পানিকেও। অথচ কোম্পানি পরিচালনায় সুশসান চর্চার এই অনাগ্রহ উন্নয়নের লক্ষ অর্জনের অন্তরায়।
পুঁজিবাজার উন্নয়ন ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা এবং সামগ্রিক ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড-২০১৮ জারি করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন। এই কোড অনুযায়ী পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে মোট পরিচালকের পাঁচভাগের একভাগ স্বাধীন পরিচালক নিযুক্ত হবেন যাদের কোম্পানির সঙ্গে কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংযোগ থাকবে না। আর যদি থাকেও তা হবে কোম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধনের এক শতাংশের কম। স্বাধীন পরিচালকরা হবেন, বাণিজ্য বা আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ শিক্ষক, বড় কোনো কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কিংবা পেশাদার আইনজীবী হিসাববিদ বা কোম্পানি সচিব। কোম্পানির মনোনীত তালিকা থেকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে থাকে। কখনো বিশেষ পরিস্থিতিতে যেমন, কোনো কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারধারণ ৩০ শতাংশের কম হলে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সেখানে কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়েই স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ করে থাকে। তাহলে প্রশ্ন হলো, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োজিত থাকার পরও সাধারণ বিনিয়োগকারী বা শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন কেন? আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কেন ঋণের নামে সাধারণ আমানতকারীর জমানো টাকা লোপাট হয়?
আর্থিক খাতে সম্প্রতি বেশকিছু আলোচিত খবরের মধ্যে ছিল শরিয়াহভিত্তিক সবচেয়ে বড় ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির খবর। অভিযোগ উঠেছে, ঋণ পাওয়ার মতো পর্যাপ্ত যোগ্যতা না থাকার পরও ভুয়া ঠিকানার গ্রাহককে কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে যা খেলাপি হয় যাওয়ার আশঙ্কায় আছে। একই ধরনের লোপাটের ঘটনা ঘটেছে আরও কয়েকটি ব্যাংকে। তবে এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর শরিয়াহভিত্তিক সবগুলো ব্যাংকই বেকায়দায় পড়ে। এগুলোতে তৈরি হয় তারল্য সংকট। ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে মানুষের আস্থাও কমে যায়। তারা জমানো টাকা তুলে নিতে শুরু করেন। এরপর বিশেষ ব্যবস্থায় তারল্য সরবরাহ করে ব্যাংকগুলোর তহবিলের জোগান দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মানুষের আস্থার ঘাটতিতে ডিসেম্বর প্রান্তিকে সাড়ে ১১ হাজার আমানত ঘাটতি হয়েছে শুধু ইসলামী ব্যাংকে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়া নজরদারির পাশাপাশি ওই ব্যাংকটিতে তিনজন স্বাধীন পরিচালক আছেন। এর বাইরে মনোনীত অন্য পরিচালকরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য। কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, মনোনীত পরিচালকরদের অন্যদেরও প্রত্যেকের স্বাধীন পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে।
সুনির্দিষ্ট অংক নির্ধারিত না থাকলেও সাধারণত ব্যাংকগুলোতে পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণের অনুমোদন দিতে হলে তা প্রস্তাব আকারে বোর্ড মিটিংয়ে তুলতে হয়। অবশ্য তা নির্বাহী কমিটিতে আগে অনুমোদিত হতে হয়। এরপর পর্যালোচনার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হলেই ঋণ মেলে কোটি টাকার গ্রাহকদের। তাহল প্রশ্ন ওঠে ওই সভায় স্বতন্ত্র পরিচালকের ভূমিকা কী ছিল? সাধারণ বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের স্বার্থকে তারা কতটুকু গুরুত্ব দিলেন? ব্যাংক খাতে ঝুঁকি তৈরি হলে কিন্তু পুরো অর্থনীতিই ঝঁকির মধ্যে পড়ে।
প্রতিটি তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে অডিট কমিটির চেয়ারম্যান হন একজন স্বতন্ত্র পারিচালক, যাকে সহযোগিতা করে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ। অডিট কমিটিতে যাচাই শেষে নিরীক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদন, আর্থিক প্রতিবেদন ও এ সংক্রান্ত আরও সিদ্ধান্ত বোর্ড সভায় তোলা হয়। স্বতন্ত্র পরিচালকদের উপস্থিতিতেই যদি অন্যায্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তার দায় কেন স্বতন্ত্র পরিচালকের ওপরও বর্তাবে না। এ কথা ঠিক যে কোম্পানির সব সিদ্ধান্তের দায় স্বতন্ত্র পরিচালকের ওপর বর্তায় না। ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ হন শেয়ারধারী পরিচালকরা। এজন্য কোম্পানির চেয়ারম্যান, অন্য পরিচালক, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ও কোম্পানি সচিবেরও এখানে ভূমিকা আছে।
অনিয়মের এমন উদাহরণ আরও আছে। পরিবারতন্ত্র কায়েম হওয়ার অভিযোগ আছে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের বিরুদ্ধে। শোনা যায়, ব্যাংটি খেলাপি ঋণের বোঝাতেও বিপর্যস্ত। ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একজন অভিজ্ঞ কেন্দ্রীয় ব্যাংকারকে না দিয়ে অডিট কামিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে যার সরাসরি ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নেই এমন একজন ব্যক্তিকে। প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলেও স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার এমন নজির অনেক শোনা যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান কেন তাদেরই নিয়োগের জন্য অনুমতি দেয়। যাচাই-বাছাই করার দায় কি তাদের একটুও নেই? সঠিক ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে মনোনীত করতে না পারার ফলে সুশাসনের যে ব্যাঘাত ঘটছে তার দায় কেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নেবে না?
অন্যায্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিবাদ হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচালক বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতেই পারেন। আইনে তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বোর্ড মিটিংয়ে হাজির হলে কোম্পানিসচিব তাকে সম্মানির খাম ধরিয়ে দেন। এটা তার প্রাপ্য। এমন শোনা যায়, কিছু কোম্পানিতে অনেক সময় হিসাবের খাতার বাইরেও পরিচালকরা সম্মানি নিয়ে থাকেন। তাহলে কি বলা অবান্তর হবে যে, সম্মানি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় শেয়ারধারী পারিচালকদের প্রভাববলয়ের বাইরে গিয়ে আপত্তি জানাতে পারেন না স্বতন্ত্র পরিচালকরা।
সম্প্রতি একজন ব্যাংক এমডি বলেই ফেলেছেন, ভাই-মামাতো ভাই নয়, দরকার আসল স্বতন্ত্র পরিচালক। এখান থেকে স্পষ্ট হয়- মালিকপক্ষ অনেকসময় তাদের পছন্দের লোককে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে মনোনীত করতে চায়। বিএসইসির সুশাসন কোডে উল্লেখ করা নিয়োগে শর্তের সাথে শতভাগ মিল না থাকলেও স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা মালিকপক্ষের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে এমন কাউকে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কাজের অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তা ছিলেন বা আছেন এমন পরিচয়ের ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র পরিচালক পদে রাখা হচ্ছে তার রেকর্ডও অনেক।
টানা তিন বছরের বেশ সময় ধরে উৎপাদনে নেই এমন কুড়িখানেক কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন চলছে পুঁজিবাজারে। ওয়েবসাইটে নিয়মিত অর্থিক প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে। এগুলোতে পরিচালনা পরিষদে স্বাধীন পরিচালকতো থাকছেনই, তাহলে ওইসব কোম্পানিতে স্বাধীন পরিচালকরা কী ভূমিকা রাখছেন? যদিও করপোরেট খাতের সুশাসন দেখার দায় স্বাধীন পরিচালকের নয় শুধু, তারা সামগ্রিক ব্যবস্থার একটি অংশ মাত্র। এর দায় পরিচালনা পর্ষদ, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এবং দেশের রাজনীতিকেও নিতে হবে।
লেখক, সাংবাদিক ও আইসিএসবির সহযোগী সদস্য
এইচআর/বিএ/জিকেএস