বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও আ’লীগ প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন জিল্লুর রহমান
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য জিল্লুর রহমানকে চাচা বলে সম্বোধন করতেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগে তার অবস্থান ছিল অভিভাবকের মতোই। শুধু দলেই নয় রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সততা ও দূরদর্শিতার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন মাটি ও মানুষের নেতা, বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান।
দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন জিল্লুর রহমান। নিজের দুঃসময় উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এদেশের মাটি ও মানুষের জন্য।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, দুই দশক পর সেই একই ব্যক্তির ওপর আস্থা, অভিভাবকত্ব ও নির্ভরতা খুঁজে নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার আগে শেখ হাসিনা দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে যান জিল্লুর রহমানকেই। বাবার অবর্তমানে মেয়েকে আগলে রাখার সব ধরনের দায়িত্ব পালন করেছেন জিল্লুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকন্যার চাচা সম্বোধনের ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত রেখে শেখ হাসিনার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলননে সাহসী ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে।
তাই তো জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যার চোখে মুখে ফুটে ওঠেছিল অভিভাবক হারানোর শূন্যতা। শোক বাণীতেও শেখ হাসিনা সেই অবদান স্মরণ করে বলেন, ‘এক/এগারোর চরম দুঃসময়ে জিল্লুর রহমান দলের হাল ধরেছিলেন, তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ আমাকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে এনেছিল।’
রাজনীতিতে আমরা জীবিত ও ক্ষমতাধরদের বন্দনা করি। আর যারা হারিয়ে যায় আমরাও মন থেকে মুছে ফেলি তাদের নাম। ভুলে যাই তাদের অবদানের কথা। মানসিকতার এই দৈন্যতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে প্রয়াত রাজনীতিবিদদের দেশ ও জাতি গঠনে তাদের অসামান্য অবদানের চিত্র । আগামী প্রজন্মের নেতৃত্ব বিকাশে প্রয়াত জিল্লুর রহমানদের দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতাকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।
১৯২৯ সালের ৯ মার্চ কিশোরগঞ্জের ভৈরবে জন্মগ্রহণ করেন জিল্লুর রহমান। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ওই এলাকা থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর সব সময় ওই আসন থেকেই জাতীয় সংসদে নির্বাচন করে আসছিলেন তিনি।
ভৈরব থেকে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জিল্লুর রহমান। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ওই আসনে এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন ছেলে নাজমুল হাসান পাপন।
জিল্লুর রহমানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রজীবনেই। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এমএ ও এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫৪ সালে আইন পেশায় যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নেন জিল্লুর রহমান। তার পিতা মেহের আলী মিঞাও ছিলেন আইনজীবী। তবে আইনজীবী হওয়ার চেয়ে রাজনীতিতেই ঝোঁক বেশি ছিল জিল্লুর রহমানের। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
ষাটের দশকে ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জিল্লুর রহমান। আন্দোলন সংগ্রামের ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। আইন অঙ্গন নয় রাজপথই হয়ে ওঠে তার ঠিকানা।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মামলার শুনানিতে অংশ নেন জিল্লুর রহমান। তবে ২০০৭ সালের শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করতে দীর্ঘদিন পর মুজিব কোট কিংবা পাঞ্জাবির বদলে গাউন পরে সংসদ ভবনের বিশেষ আদালতে সক্রিয় দেখা গিয়েছিল তাকে।
১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের অবদানের স্বীকৃতি মেলে ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে।
এরপর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জিল্লুর রহমানও যোগ দেন স্বাধীনতার সংগ্রামে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনায় যুক্ত ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলনে অনেক নেতাকে ছাপিয়ে জিল্লুর রহমানই নির্বাচিত হন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
এরপর বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯২ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন জিল্লুর রহমান। দুই দফা এই দায়িত্ব পালনের পর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন অনেক দিন।
জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলে পাল্টে যেতে থাকে দেশের ইতিহাস। ’৭৫ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘ ২১ বছর নির্যাতন নীপিড়নের শিকার হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে তার মন্ত্রিসভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে নবম জাতীয় সংসদেও সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জিল্লুর রহমান। আপাদমস্তক রাজনীতিক জিল্লুর রহমানের বিয়েতেও ছিল রাজনীতির ছোঁয়া। অভিজাত পরিবারের সন্তান আইভী রহমানের সঙ্গে দল করার সূত্রে পরিচয়, এরপর পরিণয়। তবে তাদের দুজনকে এক করতে এবং দুই পরিবারকে রাজি করাতে উদ্যোগ নিতে হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ।
সক্রিয় রাজনীতিক আইভী রহমান ছিলেন নিজের পরিচয়েই পরিচিত। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রীও ছিলেন তিনি। মহিলা আওয়ামী লীগকে সারাদেশে সুসংগঠিত করতে তার অবদান ছিল অপরিসীম। রাজনীতিতে একে অপরের প্রেরণা জোগাতেন তারা।
২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আইভী, রেখে যান স্বামী জিল্লুর, ছেলে নাজমুল হাসান পাপন এবং দুই মেয়ে তনিমা বখত ও তানিয়া রহমানকে।
স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে অনেকটাই ভেঙে পড়েন জিল্লুর রহমান। তবুও রাজনীতিতে সক্রিয়তা নষ্ট হয়নি তার। বরং ২০০৬ এর শেষ দিকে রাজনৈতিক সংকট এবং জরুরি অবস্থার সময় আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা নিজেকে বাঁচাতে কৌশলের আশ্রয় নিলেও অবস্থান বদল করেননি তিনি। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন জিল্লুর রহমান।
এরপর ২০০৭ সালে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হলে টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে উপমহাদেশের এই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি। আওয়ামী লীগের অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হয় অশীতিপর এই নেতাকে।
সব ভয়ভীতি ও প্রলোভন উপেক্ষা করে সেই ঝড় তিনি ঠিকভাবেই সামাল দিতে পেরেছিলেন বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর তাই তিনি শোকবার্তায় বলেছিলেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসে জিল্লুর রহমান অবিনশ্বর হয়ে থাকবেন।
২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মারা যান মাটি ও মানুষের এই নিরহংকারী নেতা। তার রেখে যাওয়া সততা, দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা শত সংকট ও দুঃসময়ে প্রেরণা জোগাবে মুজিবার্দশের সৈনিকদের। দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে অতল শ্রদ্ধা কিংবদন্তি এই রাজনীতিবিদের স্মৃতির প্রতি।
লেখক: সহ-সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য।
এইচআর/জিকেএস/ফারুক