চিংচ্য
চীনের তৃতীয় সৌরপদ ও সাদা বাঘের কিংবদন্তি
আমি চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে এসেছি সেই ২০১২ সালে। বাংলা হিসেবে এক যুগ আগে। কোনো বছর এমন দেখিনি যে, বেইজিংয়ে কমবেশি তুষারপাত হয়নি। আমি তুষার পছন্দ করি। চীনারাও করে। কিন্তু আমাদের সবাইকে হতাশ করে দিয়ে, এবারের শীতে বেইজিংয়ে তুষার পড়েনি। একেবারেই পড়েনি বললে পুরোপুরি সত্য বলা হবে না, পড়েছে, তবে না-পড়ার মতো। আমার এলাকায় মাত্র একদিন দু-চারটে তুষারের কণা দেখা গেছে ক্ষণিকের জন্য। ওইটুকুই। একে আর যা-ই হোক, তুষারপাত বলে না। জানি না, এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল কি না।
তুষার পড়ার আর কোনো সম্ভাবনাও নেই। কারণ, এখন তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে, শীত বিদায় নিচ্ছে। বেইজিংয়ের সিচিংশান জেলায় আমার বাস। এখানে আজকাল ভোরের দিকে তামপাত্রা থাকে চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সঙ্গে হালকা বাতাস। ফলে মোটামুটি শীত অনুভূত হয়।
শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে পোকামাকড়
খুব সকালে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সময় অথবা অফিসে আসার পথে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও হালকা জ্যাকেট গায়ে চড়াই। ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ বললাম, কারণ দুপুর নাগাদই এই জ্যাকেট গা থেকে নেমে হাতের বোঝা হয়। তখন তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, ৬ মার্চ সিচিংশানের সর্বোচ্চ তামপাত্রা হবে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ৫ ডিগ্রি)। সূর্যের আলো গায়ে পড়লে এই ১৭/১৮ ডিগ্রিকেই ২৫/২৬ ডিগ্রি মনে হয়। অন্যদের কথা জানি না, আমি এই সময়টায় বাসার বাইরে বের হওয়ার সময় পোশাক বাছাই করতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি।
অনেকেই ইতোমধ্যে জেনে গেছেন যে, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য।
প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেও আন্দাজ করা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। এখন চলছে সৌরপদ চিংচ্য। চীনা ভাষায় ‘চিং’ মানে ‘আকস্মিকতা’, ‘শুরু’, ‘সংকেত’ ইত্যাদি হতে পারে।
চিংচ্য ও বজ্রপাত
আর ‘চ্য’ মানে হচ্ছে ‘শীতনিদ্রা’। দুটি শব্দকে এক করলে আসলে এর অর্থ দাঁড়ায়: শীতনিদ্রা থেকে পোকামাকড়ের জেগে ওঠার শুরু। ইংরেজিতে ‘চিংচ্য’কে বলা হয় Waking of Insects। বাংলায় বলা যেতে পারে ‘পোকামাকড়ের জাগরণ’। এটি চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার তৃতীয় সৌরপদ। এ বছর এই সৌরপদের ব্যাপ্তি ৬ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত।
তৃতীয় সৌরপদে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়বে এবং কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাতও হবে। অভিজ্ঞতা এমনটাই বলে। তাপমাত্রা যে বাড়ছে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। সামনে বৃষ্টিপাতও হবে। চীনের কোনো কোনো জায়গায় হয়তো বৃষ্টিপাত হয়েছেও। চীন বিশাল দেশ। এখানে অঞ্চলভেদে আবহাওয়ার ভিন্নতা স্বাভাবিক।
যাই হোক, বসন্তের এই সময়টা বসন্তকালীন কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সৌরপদের নাম থেকেই বোঝা যায়, এ সময় শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে বিভিন্ন প্রাণী। প্রাচীন কাল থেকেই এটা বিশ্বাস করা হয় যে, বসন্তকালীন বজ্রপাতের শব্দে বিভিন্ন পোকামাকড় ও প্রাণী শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে।
বসন্তকালীন চাষবাসের উপযুক্ত সময়
চীনের বিভিন্ন জায়গায় তৃতীয় সৌরপদ চলাকালে বসন্তের বজ্রপাত হতে দেখা যায়। চীনা প্রাচীন বচনে বলা হয়েছে: ‘যদি চিংচ্য সৌরপদ শুরুর আগেই বসন্তের বজ্রপাত হয়, তবে সে বছর অস্বাভাবিক আবহাওয়া দেখা যাবে।‘চীনের কোথাও ৬ মার্চের আগে বজ্রপাত হয়েছে বলে শুনিনি। আশা করা যায়, এ বছর চীনের আবহাওয়ায় কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা যাবে না।
চিংচ্য সৌরপদে বায়ুর গতিপ্রকৃতি দেখে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া যায়; প্রাচীনকালে তাই দেওয়া হতো। আর আধুনিক আবহাওয়া-বিজ্ঞান অনুসারেও, চিংচ্যতে পৃথিবীর আর্দ্রতা বাড়ে এবং ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি গরম বায়ুর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এসময় উত্তর থেকে প্রবাহিত গরম ও আর্দ্র বায়ু ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ কারণেই তখন বসন্তের বজ্রপাত হয়। তবে, যেমনটি আগেই বলেছি, বিশাল দেশ হওয়ার কারণে, চীনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় বসন্তের প্রথম বজ্রপাত হতে দেখা যায়।
প্রাচীনকাল থেকেই চীনা কৃষকরা চিংচ্য সৌরপদকে খুব গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। বলা চলে, সারা বছরের কৃষিকাজের আরম্ভবিন্দু হচ্ছে এই সৌরপদ। এসময় চীনের অধিকাংশ এলাকায় তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকে; গড় তাপমাত্রা দাঁড়ায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। সূর্যালোকও পাওয়া যায় পর্যাপ্ত। সবমিলিয়ে কৃষিকাজের জন্য চমৎকার পরিবেশ। প্রাচীন চীনা বচনে বলা হয়েছে: ‘যখন চিংচ্য আসে, তখন থেকে বসন্তকালীন কৃষিকাজে কোনো বিশ্রাম নেই।’
চিংচ্য মাছ শিকারের স্বর্ণসময়
কৃষিকাজের পাশাপাশি, এসময়টা মাছ ধরার জন্যও উপযুক্ত। এসময় পোকামাকড় যেমন শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে, তেমনি মৎস্যকূলেও চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। খাদ্যের সন্ধানে তারা গভীর পানি থেকে অগভীর পানিতে ছুটে আসে। মৎস্যকূলের জন্য প্রজনন-সময়ও এটি। ফলে, মৎস্য-শিকারিদের জন্য সৃষ্টি হয় ভালো সুযোগ।
যারা শহরে বাস করেন এবং মৎস্য-শিকারের ওপর যাদের জীবিকা নির্ভর করে না, তাদেরও কেউ কেউ, শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে, এসময় মাছ-শিকারে বের হয়ে পড়েন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে অনেকেই শহর থেকে বিভিন্ন হ্রদে চলে যান স্বজনদের নিয়ে; মাছ ধরার পাশাপাশি উপভোগ করেন হ্রদের পানিতে সাঁতার ও সূর্যালোক।
চীনের চান্দ্রপঞ্জিকার প্রতিটি সৌরপদের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এক বা একাধিক প্রাচীন আচার, যেগুলোকে কেউ কেউ কুসংস্কার বলেন। তৃতীয় সৌরপদও এর ব্যতিক্রম নয়। চীনের প্রাচীন রূপকথা অনুসারে: একটি সাদা বাঘ মানুষে মানুষে ঝগড়া-ফাসাদ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
শিল্পীর তুলিতে সাদা বাঘ
তাছাড়া এ বাঘ চিংচ্য সৌরপদে শিকারে বের হয় এবং কখনও কখনও মানুষের ওপর হামলা করে। আর যদি কেউ এই বাঘের হামলার শিকার হয়, তবে সে জীবনে অনেক বাধা-বিপত্তি ও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। তাই, প্রাচীনকালে চীনারা এসময় সাদা বাঘের পূজা করতেন।
আজও চীনের কোনো কোনো স্থানে এই রীতি চালু আছে। চিংচ্য এলেই লোকেরা কাগজে সাদা বাঘের ছবি আঁকেন এবং বাঘের মুখে প্রাণীর রক্ত ও মাংস রাখেন। তারা বিশ্বাস করেন, এতে সাদা বাঘের ক্ষুধা দূর হবে এবং সে আর মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনবে না, মানুষের ওপর হামলা চালাবে না।
দুরাত্মাকে প্রহার করা একটি প্রাচীন রীতি
তৃতীয় সৌরপদের আরেকটি প্রাচীন রীতি হচ্ছে দুরাত্মা বা দুর্জনকে প্রহার করা। এই প্রথার শুরু থাং রাজবংশ আমলে (৬১৮-৯০৭)। এই প্রথা এখনও চীনের কুয়াংতুং ও হংকংয়ে জনপ্রিয়। প্রথা অনুসারে, একজন বয়স্ক নারীকে দুরাত্মা প্রহারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ওই নারী কাগজ কেটে একটি মানুষের মূর্তি ফুটিয়ে তোলেন এবং সেই মূর্তিকে জুতো ও লাঠি দিয়ে প্রহার করেন। লোকেরা বিশ্বাস করে যে, এতে দুর্ভাগ্য তাদের কাছ থেকে দূরে থাকবে এবং সৌভাগ্য কাছে আসবে। হংকংয়ের ওয়ান ছাই (Wan Chai) জেলার কজওয়ে বে (Causeway Bay) এলাকার একটি সেতু দুরাত্মা প্রহারের স্থান হিসেবে আজও খুবই জনপ্রিয়।
চিংচ্য সৌরপদে প্রচুর নাশপাতি খেতে হয়
আগেই বলেছি, ভিন্ন ভিন্ন সৌরপদে চীনারা ভিন্ন ভিন্ন খাবারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। চিংচ্য সৌরপদে তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায় নাশপাতি। আমি চীনে আসার পর এখানকার মুরুব্বিরা আমাকে যে ফলটি সবসময় খেতে উৎসাহিত করেছেন, সেটি নাশপাতি। মোটামুটি সারাবছরই এখানে বিভিন্ন ধরনের নাশপাতি পাওয়া যায়। খেতেও মজা।
তৃতীয় সৌরপদে আবহাওয়া গরম হতে থাকে, বাতাস হয়ে ওঠে তুলনামূলকভাবে বেশি শুষ্ক। এসময় তাই নাশপাতি খুবই কার্যকর, বিশেষ করে সর্দি-কাশির বিরুদ্ধে। চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, চিংচ্য সৌরপদে প্রচুর নাশপাতি খাওয়া উচিত; চীনারা তা খায়ও বটে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জিকেএস