ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

টম অ্যান্ড জেরি সড়ক

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলাদেশের কোটির বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস করেন। এদের বেশিরভাগই যান জীবিকার সন্ধানে, ভাগ্য বদলাতে। যারা ভাগ্য বদলাতে যান, তারা সেখানে আয় করে দেশে টাকা পাঠান। নির্ধারিত সময় শেষে ফিরেও আসেন। তবে অনেকেই যান উন্নত জীবনের সন্ধানে। তারা আর ফিরে আসেন না।

দেশে টাকা তো পাঠানই না। উল্টো দেশের জমিজমা, বাড়িঘর বিক্রি করে নতুন দেশ সম্পদ গড়েন। যারা উন্নত জীবনের সন্ধানে যান তারা কখনো নিরাপত্তা, কখনো রাজনীতিকে অজুহাত করেন। তখন আর তাদের বাংলাদেশকে বাসযোগ্য মনে হয় না। তবে বাংলাদেশের বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার হাজারটা কারণ আছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদীদূষণ- দূষণের যত মাত্রা আছে, সবগুলো সর্বোচ্চ মাত্রায় পাওয়া যাবে বাংলাদেশে। নিরাপত্তার সংকট তো আছেই।

তবুও এই বাংলাদেশ আমাদের প্রিয়। এত শঠতা, এত যে ব্যথা; তবু যেন তা মধুতে মাখা। শত সমস্যা মেনেই আমরা এই বাংলাদেশে আছি। তবে ঢাকায় থাকার একটা সমস্যা মাঝে মধ্যে জীবন আটকে দেয়। বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশে আসেন, তারাও বাংলাদেশের এক নাম্বার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন যানজটকে। মানুষের জীবনের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় রাস্তায়। মানুষ বেশি, গাড়ি বেশি, রাস্তা কম; যানজট তো হবেই।

তবুও এই রাস্তাকেই আরও বেশি চলমান রাখা সম্ভব হতো, যদি আমরা নিয়ম মেনে চলতাম। রাস্তায় নামলে আমরা সবাই রাজা বনে যাই। যার যত ক্ষমতা, যার গায়ে জোর বেশি, যার গাড়ির দাম যত বেশি; তিনি নিয়ম মানেন তত কম। রাস্তায় ট্র্যাফিক পুলিশকে অসহায় মনে হয়। কোনো গাড়ি আটকালেই প্রথমে হুমকি, পরে ফোন। তাৎক্ষণিক বদলির ভয়ে তারা হাত তোলা আর নামানো ছাড়া কোনো দিকে তাকানোর সাহস পান না।

উল্টোদিকে চলতে দেখলেই বুঝে নেবেন, হোমড়া-চোমড়া কেউ। উল্টো দিকে দোতলা বাস চলতে দেখলে বুঝবেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস। বাসস্ট্যান্ডে এক বাসের সাথে আরেক বাসের পাল্লা দেওয়ার প্রবণতা তো আছেই। অথচ আমরা যে নিয়ম মানতে জানি, সেনানিবাসে ঢুকলেই সেটা টের পাই।

যানজটে বিরক্ত হয়ে আপনি যে হেঁটে গন্তব্যে যাবেন, সে উপায়ও নাই। বেশিরভাগ ফুটপাতই দখল হয়ে যায়। ইস্টার্ন প্লাজার সামনের সড়কের ফুটপাত পুরোটাই যেন টাইলসের শোরুম। বাংলামোটর থেকে মগাবাজারের রাস্তার পুরোটাই যেন ওয়ার্কশপ। ইন্দিরা রোডের পুরোটাই যেন বাজার।

এমন হাজারটা উদাহরণ আপনারাও যুক্ত করতে পারবেন। কারওয়ান বাজারে জনতা টাওয়ার থেকে পেট্রোবাংলা পর্যন্ত রাস্তায় দিনভর জ্যাম লেগে থাকে। দুটি রিকশা পাশাপাশি গেলেও লেগে যায়। অথচ এই রাস্তাটি প্রায় নজরুল ইসলাম এভিনিউর মতো চওড়া। মূল রাস্তার এক-দশমাংশ গাড়ি চলার জন্য পাওয়া যায়। বাকিটা হয় বাজার, নয় পার্কিং। মতিঝিলের পুরোটাই যেন পার্কিং এরিয়া।

ঢাকার রাস্তার এই অব্যবস্থাপনার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ সাতরাস্তা থেকে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজারের সংযোগ সড়কটি। আদর করে এটির নাম রাখা হয়েছে মেয়র আনিসুল হক সড়ক। দীর্ঘদিন আমার অফিস কারওয়ান বাজারে। তাই বিভিন্ন সময় বাধ্য হয়ে এই রাস্তাটি ব্যবহার করতে হয়। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক। সাতরাস্তাকে কেন্দ্র করে কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, তেজতুরি বাজার, তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী, গুলশান, নিকেতন, হাতিরঝিল ও রামপুরার সংযোগ সড়ক এটি।

এই রাস্তাটির দুই পাশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গণমাধ্যমের অফিস রয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই সংযোগ সড়কটিকে রাস্তা না বলে বর্ধিত ট্রাকস্ট্যান্ড বলাই ভালো। দিনভর সেখানে যানজট লেগেই থাকতো। রাতে তো ভয়েই কেউ সে এলাকায় যেতো না। অফিসের কাছে হলেও আমরা ভুলেও এই রাস্তায় যেতাম না। অনেক ঘুরেও তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানো যেতো।

আনিসুল হক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার পর চমকে দেওয়ার মতো অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার অকাল মৃত্যু আমাদের দুঃখ তো দিয়েছেই, আফসোসও বাড়িয়েছে। আহা, এমন একজন মেয়র যদি পেলামই, এত অল্প সময়ের জন্য কেন। আনিসুল হক অল্প সময়ে অনেক কিছু করেছেন। তবে তার সবচেয়ে সাহসী কাজ হলো এই রাস্তা ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে আবার রাস্তা বানানো।

২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর যে সাহসিকতায় তিনি রাস্তাটি দখলমুক্ত করেছিলেন তার তুলনা নেই। শ্রমিকদের বাধার মুখেও অনড় থেকে তিনি সফল হয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত আনিসুল হক ছাড়া আর কেউ এটা পারতেন না। দখলমুক্ত করেই আনিসুল হক বসে থাকেননি। রাস্তার দুই পাশের দেওয়ালে চমৎকার দেওয়ালচিত্র এঁকে, একটি আধুনিক পাবলিক টয়লেট বানিয়ে এটিকে ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর রাস্তার একটি বানিয়েছিলেন।

এই সংযোগ সড়কটি দখলমুক্ত হওয়ার সুবিধা পেয়েছিলেন সবাই। আগে ভয়ে যে রাস্তায় যেতাম না, সেটিই হয়ে দাঁড়ালো আমাদের নিত্যদিনের চলাচলের পথ। ২০১৭ সালে আনিসুল হকের অকাল মৃত্যুর পর এই রাস্তাটির নাম দেওয়া হয় ‘মেয়র আনিসুল হক সড়ক’। এর চেয়ে সার্থক নামকরণ আর হতে পারে না। আনিসুল হক বেঁচে থাকবেন তার কাজে।

প্রথম কিছুদিন ভালোই চলছিল। কিন্তু আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে চিত্র। প্রথমে দু-একটা ট্রাক রাখা শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এখন এই সড়কটি আবার ফিরে গেছে একদম আগের অবস্থায়। কারওয়ান বাজার থেকে গেলে রেলগেট পেরিয়ে প্রথমে টেম্পোস্ট্যান্ড। তারপর ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের সারি।

ফুটপাত চলাচলের অযোগ্য। ট্রাকের জন্য দেওয়াল দেখা যায় না। যেটুকু দেখা যায়, সেটুকুও পোস্টারে, বিজ্ঞাপনে ঢাকা, দেওয়ালচিত্র হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে অনেক আগেই। এই রাস্তায় চলাচলের সময় আমার মন খারাপ হয়ে যায়। যতটা না রাস্তার বেহাল দশা দেখে, তারচেয়ে বেশি আনিসুল হকের জন্য। রাস্তাটির এ অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই তার আত্মা কষ্ট পায়।

দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল, রাস্তাটির নাম বদলে দেওয়া উচিত। এভাবে রাস্তাকে ট্রাক বানিয়ে ফেলে তার নাম ‘আনিসুল হক সড়ক’ রাখলে আনিসুল হকের অপমান হয়। মনে মনে ভাবছিলাম বিকল্প কী নাম দেওয়া যায়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম সে সমস্যার দারুণ সমাধান দিলেন। রাস্তাটির নতুন নাম হতে পারে ‘টম অ্যান্ড জেরি সড়ক’।

আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচিত হন আতিকুল ইসলাম। আনিসুল হকের মতো তিনিও গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ছিলেন। মেয়র হিসেবে আতিকুল ইসলামও অনেক কিছু করার চেষ্টা করছেন। তবে আনিসুল হক একজনই ছিলেন। তার মতো আর কেউ কখনো আসবেন না। আনিসুল হক সড়কটিকে দখলমুক্ত রাখতে আতিকুল ইসলামের চেষ্টারও কমতি নেই। কিন্তু চেষ্টা করলে তো লাভ নেই। দখলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে সফল বলা যাবে না।

সম্প্রতি আতিকুল ইসলাম সড়কটি পরিদর্শনে এসেছিলেন। সেখানে তার কণ্ঠে অসহায়ত্ব, ‘রেললাইনের পরপরই লেগুনার স্টেশন করা হয়েছে। আমি আসার কারণে ট্রাকগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলেছে। যদিও অনেকে রাস্তার ওপর ট্রাক রেখে দিব্বি চলে গেছে। সত্যি কথা বলতে হয়, এ সড়কটি নিয়ে টম অ্যান্ড জেরি খেলা হচ্ছে। জাস্ট টম অ্যান্ড জেরি। আমি আসলে চলে যাচ্ছে, পুলিশ আসলে চলে যাচ্ছে; পরে আবারও এসে রাস্তা দখল করছে, আবার চলে আসছে। এটা বাস্তব সত্য চিত্র।’

সড়কটি দখলমুক্ত করতে প্রায়ই অভিযান চালানো হয় জানিয়ে মেয়র বলেন, ‘এখানে আমরা প্রায়ই অভিযান চালাই। কিন্তু তার দুদিন পরই দখল হয়ে যায়। ট্রাকের মালিকরা বলছেন, জায়গা দেই না কেন? আমি বলেছি, আমি যেটা চাই, আগে সেটা করবেন। আমি চাই জনগণের যেন কোনো ভোগান্তি না থাকে। এ জন্য রাস্তার দুই পাশে কোনো ধরনের ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।’

মেয়র আতিকুল ইসলামের বক্তব্য থেকেই আমি রাস্তাটির নতুন নাম পেয়েছি ‘টম অ্যান্ড জেরি সড়ক’। ট্রাক মালিক, চালকদের দাবিও অন্যায্য সেটা বলছি না। তারা একটি স্থায়ী ট্রাকস্ট্যান্ড চান। সেটা সরকার করে দিক। কিন্তু তাই বলে ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দখল করে তো আর ট্রাকস্ট্যান্ড হতে পারে না। বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলামের কাছেও আমাদের অনেক প্রত্যাশা। আনিসুল হকের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার করে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন স্বপ্ন দেখানোর দরকার নেই। আনিসুল হক যা করে গেছেন, তা ধরে তো রাখতে হবে।

মেয়র আতিকুল ইসলামের কাছেও আমি আনিসুল হকের মতো সাহস চাইবো। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা বন্ধ করুন, স্থায়ী পুলিশ টহলের ব্যবস্থা করুন। নইলে রাস্তাটির নাম বদলে ‘টম অ্যান্ড জেরি সড়ক’ রাখুন। অস্থায়ী ট্রাকস্ট্যান্ডের নাম ‘আনিসুল হক সড়ক’ রেখে তাকে আর অপমান করবেন না প্লিজ।

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন