ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গণতন্ত্র

আন্দোলন কি শুধু ক্ষমতা প্রাপ্তির জন্য?

ইয়াহিয়া নয়ন | প্রকাশিত: ০৮:৫২ এএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দেশের বিরোধীদলগুলো এক যুগের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছে, গণতন্ত্রের জন্য। তারা বলছে, দেশে গণতন্ত্রের লেশ মাত্র নেই। গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এরই মধ্যে বিদেশী স্বনামধন্য এক সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের গণতন্ত্র সূচকে দুই ধাপ এগিয়ে গেছে। কেমন কথা হলো। তাহলে দেশের বিরোধীদলগুলো কোন গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন করছে?

ভাষার মাসের প্রথম দিনে বিশ্বব্যাপী খবর হচ্ছে, গণতন্ত্র সূচকে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এখন এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৩তম। গত বৃহস্পতিবার ( ১ ফেব্রুয়ারি) ‘গণতন্ত্র সূচক ২০২২’ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চল নিয়ে এবারের সূচক তৈরি করা হয়েছে। সূচকে ১০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৯৯।

২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম। স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৯৯। ২০২০ সালের সূচকে একই স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৬তম। সূচকে পাঁচটি মূল বিষয়ের আলোকে বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর গণতন্ত্রের অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক স্বাধীনতা।

সূচকে দেশ ও অঞ্চলগুলোকে চারটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা। এবারের সূচকে পূর্ণ গণতন্ত্র বিভাগে রয়েছে ২৪টি দেশ। ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বিভাগে ৪৮টি দেশ। হাইব্রিড শাসনব্যবস্থায় ৩৬টি দেশ। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় ৫৯টি দেশ।

গত কয়েকবারের মতো এবারও হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বিভাগে রয়েছে বাংলাদেশ। ১০-এর মধ্যে যেসব দেশের স্কোর ৪ থেকে ৬-এর মধ্যে, তারাই এই বিভাগে রয়েছে। এই বিভাগে সবার ওপরে বাংলাদেশ। সবার নিচে মৌরিতানিয়া। সূচকে দেশটির অবস্থান ১০৮তম, স্কোর ৪ দশমিক শূন্য ৩। এই বিভাগের অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভুটান (৮৪তম), ইউক্রেন (৮৭তম), উগান্ডা (৯৯তম), নেপাল (১০১তম), পাকিস্তান (১০৭তম)।

হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বলতে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এমন ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। এ শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দল ও বিরোধী প্রার্থীদের ওপর সরকারের নিয়মিত চাপ থাকে। এই বিভাগে থাকা দেশগুলোর বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয়। সাংবাদিকদের হয়রানি ও চাপ দেওয়া হয়। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, দুর্বল আইনের শাসন, দুর্বল নাগরিক সমাজ এই ধরনের শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য।

এবারের সূচকে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বিভাগে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (৩০তম), মালয়েশিয়া (৪০তম), ভারত (৪৬তম), ইন্দোনেশিয়া (৫৪তম), শ্রীলঙ্কা (৬০তম), সিঙ্গাপুর (৭০তম)। এবারের গণতন্ত্র সূচকে শীর্ষ স্থানে আছে নরওয়ে। পূর্ণ গণতন্ত্র বিভাগের এই দেশের স্কোর ৯ দশমিক ৮১। দ্বিতীয় অবস্থানে নিউজিল্যান্ড, তৃতীয় আইসল্যান্ড। সুইডেন চতুর্থ, ফিনল্যান্ড পঞ্চম।

এবারের গণতন্ত্র সূচকে সবার নিচে রয়েছে আফগানিস্তান (১৬৭তম)। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বিভাগের এই দেশের স্কোর শূন্য দশমিক ৩২। বিভাগটির অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার (১৬৬তম), উত্তর কোরিয়া (১৬৫তম), মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র (১৬৪তম), সিরিয়া (১৬৩তম), চীন (১৫৬তম), ইয়েমেন (১৫৫তম), ইরান (১৫৪তম), সৌদি আরব (১৫০তম), রাশিয়া (১৪৬তম)।

গণতন্ত্র বলতে কোনও জাতিরাষ্ট্রের (অথবা কোনও সংগঠনের) এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে। "গণতন্ত্র" পরিভাষাটি সাধারণভাবে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হলেও অন্যান্য সংস্থা বা সংগঠনের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতে পারে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রমিক ইউনিয়ন, রাষ্ট্র-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

আধুনিক গণতন্ত্রের জনক হলেন জন লক। জন লক একজন ইংরেজ দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, এনলাইটেনমেন্টের সূচনাকালের অন্যতম চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকারও। তিনি ১৬৩২ সালে ২৯ আগস্ট ব্রিস্টলের নিকটবর্তী রিংটনে জন্মগ্রহণ করেন।

জন লক জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় পদ্ধতিগত দিক থেকে নতুনভাবে অভিজ্ঞতাবাদের প্রয়োগ করেছেন এবং দার্শনিক চিন্তাধারাতে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তার রাজনীতি নিয়ে লিখিত বইগুলো আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনের আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। তৎকালীন রাজনৈতিক পালাবদলের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে নাগরিক অধিকার ও বুর্জোয়া শ্রেণীর ক্রমবিকাশে তার প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে।

পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোতে নারীর অবস্থান এবং ভূমিকা বিষয়ে তার মতামত ছিল আধুনিক নারীবাদী চিন্তার কাছাকাছি। অসংখ্য দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদের উপর তার প্রভাব রয়েছে। জন লক এর বাবার নামও ছিল জন লক, যিনি ছিলেন একজন সফল আইনজীবী। ১৬৪৭ সালে লক বিখ্যাত ওয়েস্ট মিনিস্টার স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৬৫২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে ভর্তি হন।

অক্সফোর্ডে দর্শন, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। ১৬৫৯ সালে ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে সিনিয়র স্টুডেন্টশিপ লাভ করেন। পরের বছর গ্রিক ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। পরে অলঙ্কার শাস্ত্রের রিডার ও দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক পদ লাভ করেন।

১৬৬৮ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির সভ্য নির্বাচিত হন। ১৬৭৪ সালে মেডিসিনের উপর স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরের বছর মেডিকেল স্টুডেন্টশিপ হিসেবে নিযুক্ত হন। সব মিলিয়ে পেশাগত জীবনে অধ্যাপনা, চিকিৎসাসহ রাজকীয় কূটনৈতিক ও বাণিজ্য পরিষদের নানা গুরত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত ছিলেন।

এবার আসি গণতন্ত্রের আন্দোলনের কথায়। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক স্বাধীনতা। এইগুলোর বিবেচনায় বাংলাদেশ আগের চেয়ে দুধাপ এগিয়ে গেছে। তাহলে বিরোধীদের আন্দোলন কি শুধু ক্ষমতা প্রাপ্তির জন্য? তারা দেশে আন্দোলন করছে, আবার বিদেশী দূত - প্রতিনিধিদের কাছে গণতন্ত্র নেই
বলে নালিশ করছে। অথচ গণতন্ত্রের এই সূচক বিদেশীরাই করেছে।
সরকারের সমালোচনা, সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, গণমানুষের নানা দাবি নিয়ে সভা-সমাবেশ প্রতিদিনইতো হচ্ছে। লেখার, বলার, প্রকাশের স্বধীনতায় কোনো বাধা কি আছে? তাহলে কোন গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে রাজপথে আন্দোলন হচ্ছে?

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন