কুইজে পশুর হাসি ও বাম কান নড়ানো
শীতের ঠান্ডা আমেজের সাথে দুপুরের রোদটা বেশ মিষ্টি অনুভূত হয়। তাই নিয়মিত বাগান তদারককারীদের কাজে সহায়তা করতে শুরু করলাম। কাজের ফাঁকে ওরা গল্প করতে ভালোবাসে। ওদের কারও কারও সমসাময়িক ঘটনার জ্ঞান আমার থেকে অনেকগুণ বেশি। সেটা আগে থেকেই আমি জানি। কাজের দিকে মনোযোগ দিয়েও একজন হঠাৎ কথার আসর জমিয়ে ফেললো।
তার প্রশ্ন ছিল- একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে। ছোট ছেলের সেই এমসিকিউ পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে- শুধু একটি পশু হাসতে জানে। সেটি কোনটি? চারটি প্রাণীর নাম লেখা আছে। একটিতে টিক চিহ্ন দিতে হবে। ছেলে ভুল হবে বলে কোনোটিতেই টিক চিহ্ন না দিয়ে বাসায় এসেছে।
সেখানে গরু, ঘোড়া, হায়েনা ও বানরের নাম দেওয়া ছিল। সে দাদাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গরু, মহিষ দেখেছে। চিড়িয়াখানায় হায়েনা ও অনেকগুলো বানরের লাফালাফি এবং ঝগড়া দেখেছে। কোনোটিকেই হাসতে দেখেনি। কিন্তু সেদিন টিভিতে খবরে শুনেছে- একটি রাজনৈতিক দলের ২৭ দফায় রাষ্ট্র মেরামত কর্মসূচির ঘোষণা শুনে গাধাও হাসে। সে ছোট্ট মানুষ, তাই ভেবেছিল গাধা আসলেই হাসতে পারে। প্রশ্নে চারটি অপশনের মধ্যে গাধা নামক পশুর নাম ছিল না। তাই সে উত্তর দেয়নি।
প্রাথমিপড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মনে টিভির সংবাদ এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা শুনে ওর বাবা তো অবাক! আমার কাছে সে জানতে চাইলো, এর সঠিক সমাধান কি হতে পারে স্যার?
আমিও ওর ছেলের কাণ্ড শুনে এই প্রশ্নের তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দিতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এমন জটিল প্রশ্নে উত্তর দিতে না পেরে শখের কাজ ফেলে বাসায় চলে এলাম। প্রাণিবিদ এক বন্ধুকে ফোন করলাম। তিনি জানালেন আজকাল কিছু গাইড বইয়ে অনেক আজগুবি তথ্য দেওয়া থাকে। সেগুলো দেখে কুইজ এসব কুইজ টাইপ প্রশ্ন তৈরি করা হয়। আপনি ইন্টারনেট খুঁজলে পেতে পারেন।
কোন প্রাণী হাসতে পারে তা কোন বইয়ে লেখা আছে বা আমি কোথাও এমন কিছু পড়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। ছাত্রজীবনের সাধারণ জ্ঞানের সব বই অন্যদের দিয়ে দিয়েছি। অগত্যা গুগল খুঁজতে হলো। হ্যাঁ, সেখানে পাওয়া গেলো। সেটাও একটি চাকরির পরীক্ষার কুইজ।
বলা হয়েছে, শুধু ‘হায়েনারা’ হাসতে জানে। তবে তাদের হাসির ভিডিও দেখে মনে হলো ওরা হো হো করে হাসতে জানে না। বরং শিকারকে ধরা বা ঝগড়া করা ও প্রজননের সিজনে নিজের ঘাড়ের লোম ও লেজ ফুলিয়ে শত্রুর দিকে তেড়ে আসে। এরপর বিশ্রী শব্দ করে দাঁত বের করে চোখে এক ধরনের জ্বলজ্বলে ভাব ফুটিয়ে তোলে। যেটাকে অনেকে সহজাত, হিংসা ও বিদ্রূপের হাসির সাথে তুলনা করেছেন মাত্র।
আমরা জানি ঘোড়া ডিম পাড়ে না। গাধারাও হাসতে জানে না। এগুলো প্রবাদ-প্রবচন। এসব প্রবাদ-প্রবচন দিয়ে অনেক শিক্ষামূলক ঘটনাকে বোঝানো হয়। আবার অনেক প্রবাদ-প্রবচন আছে যেগুলো মানুষ বানিয়ে বানিয়ে ভিন্নভাবে বলে। যেগুলোর মাধ্যমে অন্যকে তিরস্কার করা হয়, অনেকে আঘাত পান, কষ্ট পেয়ে থাকেন।
যতদূর জানা গেছে তাতে বলা যায়, রক্ত-মাংসের প্রাণিকূলের মধ্যে শুধু মানুষ হাসতে জানে। শিম্পাঞ্জি, বানর, ওরাংওটাং হাসির মতো করে ভেংচি কাটে। ঘোড়া, গাধা, জেব্রা ইত্যাদি হা করে সব দাঁত বের করতে পারে। কোনো কিছু শুঁকে ঘ্রাণ নিয়ে দাঁত উচিয়ে নিজেদের মতো শব্দ করে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে।
ছড়া-কবিতায় ‘খোলসে মাছের হাসি দেখে হাসেন পাঁতিহাস’ ও বালু সম্বলিত পরিষ্কার অল্প পানিতে পুঁটি মাছের ঝিলিক দিয়ে চলাফেরাকে অনেকে হাসির সাথে তুলনা করেছেন। কানি ও সাদা বকেরা তখন সেসব পুঁটি মাছকে হাসিখুশি মনে ঠোঁট দিয়ে পটাপট শিকার করে গিলে ফেলে উদর পূর্তি করে। আদতে সেগুলো কোনো হাসি নয়।
ঘণ্টাখানেক বাসায় কাটিয়ে আবার নিচে নেমে বাগানে ওদের কাছে গেলাম। আমি কিছু বলার আগে সে আবার প্রশ্ন করলো, স্যার, ‘গাধা হাসে, কিন্তু গাধা কি কখনো কাঁন্দে না?’
ওর জটিল প্রশ্ন শুনে আবার বিপদের আঁচ করলাম। এবার মনে করলাম গাধারা হাসতে পারে না। কিন্তু কাঁদতে পারে। গাধা বিপদের সময় কখনও কাঁদে। মনিবের পিটুনি খেয়ে কেঁদে দু’চোখে পানি গড়িয়ে মুখে কালো দাগ করে ফেলে। অভিমান করে, রাগ করে, গোস্বা করে, ফুপিয়ে চিঁহিঁ-হিঁ করে চিৎকার করে মালিক বা মনিবের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
ভালো খাবার বিশেষ করে গাজর-মুলো তাদের প্রিয় খাবার। সামনে একটি মুলো ঝুলিয়ে দিয়ে গাধাকে যে সামনের দিকে চালিত করা যায়। পেছনে মুলো ঝুলিয়ে দিয়ে গাধাকে সামনে চলতে বললে সে সামনে যায় না-বরং পেছনের পা দিয়ে পেছাতে থাকে। এজন্য বলা হয় গাধারা লোভী ও স্বার্থপর। শুধু নিজের পেটের চিন্তা করে।
তবে গাধা প্রাকৃতিকভাবে কিছু গুণ ধারণ করে থাকে। বিশেষ করে ভারবাহী গাধারা সন্মুখের বিপদ আঁচ করতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পথের মধ্যিখানে নিজের বিপদ ঘটতে পারে এমন কিছু আঁচ করতে পারলে গাধারা শুয়ে পড়ে। তখন গরুর মতো নাকে পানি ঢাললেও তারা উঠতে চায় না।
সুদূর অতীতকাল থেকে বেদুইনরা ভারবাহী উট, ঘোড়া ইত্যাদি দিয়ে পণ্য পরিবহন বা মরুপথে চলার সময় সঙ্গে গাধা রাখতো। অতীতে হজ কাফেলার সময় গাধাকে সঙ্গী করা হতো। গাধা যে মরুপথে চলতে চাইতো না সে পথকে পরিহার করে সম্ভাব্য বিপদ এড়ানো হতো।
গাধা খুব পরিশ্রমী প্রাণী। অনেক ভারী বোঝা পিঠে নিয়ে দূর-দূরান্তের বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য গাধার সুখ্যাতি রয়েছে। এজন্য তারা নিজের পিঠের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করে না। এতকিছু শুনে সে বললো- স্যার গাধার এত গুণ। জানতাম না। আমি বাড়িতে ক’টি ছাগল পুষি।
তবে এত এত গুণের সাথে যদি হাসতে জানে এমন একটি গাধা পেতাম সেটাকেও পুষতাম। তাহলে আমার বাড়িতে সেই হাসি জানা গাধাকে অনেকে দেখতে আসতো। তখন একটি মিনি চিড়িয়াখানা খুলে দর্শনীর বিনিময়ে মানুষকে সেই হাসি জানা গাধাকে দেখার সুব্যবস্থা করতাম। এই দুর্মূল্যের বাজারে আমার কিছু বাড়তি আয় হলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসারটা একটু ভালোভাবে চালাতে পারতাম। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠাতে পারতাম।
ওর চমৎকার ভাবনার কথা শুনে বললাম, বাস্তবে সেই হাসি জানা গাধা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া গেলে তো! মনে মনে ভাবলাম আরা অনেকেই ঘোড়ার পিএচডি-র জন্য আবেদনের গল্প বলে মজার কৌতুক করে থাকি। ওকে একটা কৌতুক শোনালে কেমন হয়?
বললাম, তাহলে একটি কৌতুক শোনো।
‘এক রাজা যাবেন শিকারে। তিনি প্রিয় উজিরকে জিজ্ঞাসিলেন, আজকের আবহাওয়ার খবর কি? শিকারে গিয়ে ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়ব না তো? উজির শুধালেন, আজ আবহাওয়া চমৎকার। ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
কিছু দূর যাওয়ার পর পথিমধ্যে এক ধোপার দেখা হলো। ধোপা বলল, মহারাজ, শিকারে তো চললেন, কিন্তু সামনে যে বড় ঝড়-বৃষ্টি অপেক্ষা করছে! রাজা আর কিছুদূর যেতেই প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়লেন। তখন তিনি ওই উজিরকে বরখাস্ত করে সেই পদে বসালেন ধোপাকে।
রাজা ধোপাকে বললেন, তুমি কি করে ঝড়ের কথা আগেই জান? ধোপা বলল, মহারাজ, যখন ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে তখন আমার পোষা গাধাটি সামনে চলতে চায় না, ও গোঁ ধরে, আর তার বাম কান নড়ে। আমার গাধার বাম কান নড়া দেখে আমি বুঝেছি আজ ঝড়-বৃষ্টি হবে।
রাজামশাই তাৎক্ষণিক ধোপাকে বরখাস্ত করে গাধাটাকে উজির বানালেন।
সে কৌতুকটা শুনে খুব খুশি হলো বলে মনে হলো। আর কোন প্রশ্ন করলো না।
গাধারা বাস্তবে হাসতে না জানলেও আমাদের চারদিকে মানুষরূপী গাধায় ভরপুর। তারা শুধু হাসেই না। বরং কপট হাসি দেয়। ঈর্ষা ও শয়তানির হাসি দিয়ে অট্টহাসি করে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট শুনে তারা জোর করে হাসার চেষ্টা করে তিরস্কৃত হয়। চেহারায় ভয়, উষ্মা ফুটে উঠলেও সে সময় জোর করে মুচকি হেসে ফটোসেশন করে। মুখটা হাসি হাসি করে কি আর হাসি হয়?
মানুষ মিনি পর্দায় কপটতাপূর্ণ সেসব দৃশ্য অবলোকন করে কষ্ট পায়, কেউ কেউ অভিশাপ দেয়। এরাই সেসব গাধা যারা নানা চরিত্রে হাসতে জানে। মানুষরূপী গাধাদের এসব ভণ্ড হাসির ফলে সুনাগরিক তস্করপদি চোর-ডাকাত, বদমাশ, ঘুসখোররা আরও বেশি বেশি অন্যায় করার আস্কারা পায়। এসব গাধা তাদের পোষা অনুচরদের নিয়ে সাময়িক হাসাহাসি করে, তাচ্ছিল্য করে।
আর এসব পোষা অনুচররা সামনে কোনো বিপদ দেখলে মনিবের নিরাপত্তার জন্য বাম কান নাড়িয়ে সংকেত না দিয়ে আগে নিজেরাই সটকে পড়ে। এজন্য মনিবকে একদিন তার হীন কৃতকর্মের জন্য একাই পস্তাতে হয়। কাঁদতে হয় জন্ম-জন্মান্তরে। তাই তো এসব ছোট কানওয়ালা মানুষরূপী গাধার চেয়ে লম্বা কানওয়ালা আসল গাধারাই মনিবের বিপদের বন্ধু হিসেবে প্রমাণিত।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জিকেএস