বাংলা আমার তৃষ্ণার জল
‘বড় ভাইসাহেব, দেখেন আপনার মুসলিম লীগের লোকেরা কি করেছে, তারা ছাত্রদেরকে গুলি করে শেষ করে দিচ্ছে আর আপনারা অ্যাসেম্বলি হলে বসে পাকিস্তানের গুণগান গাইছেন।’ এক নাগাড়ে এ কথাগুলো বললেন আব্দুল হাফিয তার বড়ভাই, আব্দুল হামিদ সাহেবকে। আব্দুল হামিদ সাহেব তার ছোট ভাই আব্দুল হাফিযের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলেন তার সারা গায়ে রক্ত মাখা। সময়টা ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল। আব্দুল হাফিয ভাই তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র।
নিজেকে কখনোই ‘ভাষা সৈনিক’ হিসেবে দাবি করেননি হাফিয ভাই। জন্ম ১৯৩০ সালে, ফেব্রুয়ারিতে। ঢাকার মাহুত টুলিতে বড় হয়েছেন। তার নানা ১৮৮০ সালে লখনউ থেকে চলে আসেন ঢাকাতে। নানী ঢাকার মেয়ে। বড় হয়েছেন বাংলা আর উর্দু ভাষা শিখে। দু’ভাষাতেই ছিল সমান দখল। হাসতে হাসতে বলেন `কুট্টি বাংলাতেও` আমি সমান দক্ষ। আরমানিটোলা হাই স্কুলে পড়ার সময়টা ছিল স্বপ্নের সময়। মাহুত টুলি আর বেচারাম দেউড়িতে হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে কি সুন্দর দিন ই না কাটিয়েছেন! শিক্ষকরা শিখাতেন কেবল সহমর্মিতা আর সমতার সমাজ গঠনের পথের ঠিকানা।
সেই সময়েই দেখেছেন ধর্ম আর জাত নিয়ে অনেক বৈষম্য, অনেক রক্তপাত। সেই থেকে রাজনীতিতে তার বিতৃষ্ণা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন রাজনীতি আমাদের বিভক্ত করে, আমাদের মধ্যে হিংস্রতা নিয়ে আসে। সে সময় দেখতেন, রাজনীতি করে অনেক ছাত্র ‘আদুভাই’ হয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতেন মেডিকেল কলেজে। তার সে বিলাসিতার সময় বা সুযোগ ছিল না।
মেডিকেল কলেজে ঢুকে তাই রাজনীতি করেননি। গান গাইতেন, পিয়ানো বাজাতেন। ‘ঢাকা শিল্পী সংঘের’ সদস্য ছিলেন। ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে হরতাল ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছয় নম্বার ব্যারাকে বসে পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করছিলেন কয়েক বন্ধু। ২১ শে ফেব্রুয়ারির মিছিলে যাননি, পরীক্ষার পড়ার জন্য। যখন বন্দুকের গুলির শব্দ শোনা গেলো, ফজলে রাব্বির রুম থেকে সবাই বেরিয়ে বারো নাম্বার ব্যারাকের দিকে দৌড়ে গেলেন। রক্তে মাখামাখি একটি মানুষকে দেখলেন গেটের পাশে পড়ে আছে। কয়েক বন্ধু মিলে তাকে ধরে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলেন। তাকে মৃত ঘোষণা করা হলো। পুরো ঘটনাটাই তাকে থমকে দিল। মুহূর্তেই বদলে গেলো তার দৃষ্টিভঙ্গি। সেই থেকে উর্দু বলা ভুলে গেলো সেই উঠতি বয়সের যুবকটি। আজও সেটি বদলায়নি।
যে কোনদিন রাজনীতির ধার কাছ দিয়েও যাননি, সেদিন রাতে আরও অনেকের সাথে মিলে কার্ফু ভেঙ্গে সারা রাত জেগে বানিয়েছিলেন প্রথম শহীদ মিনার। সেদিন সেটির ছবি তুললেন হাফিয ভাই। শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। হাফিয ভাইয়ের সে ছবিটি বাঙ্গালীর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেলো।
হাফিয ভাই বললেন, ‘যদিও মুসলিম লীগ জন্মেছিল এই ঢাকাতে ১৯০৬ সালে, ২১ শে ফেব্রুয়ারির পর আমি দেখেছি তাদের আসল চেহারা। ওদের কোন দিন সমর্থন করিনি।` আমেরিকাতে চলে এলেন ১৯৫৭ সালে। এদেশেও কোন রাজনীতির ধারে কাছে যাননি। রাজনৈতিক দলে বিশ্বাস করেন না। যাকে ভাল লাগে, যার দ্বারা মানুষের ভাল হবে মনে করেন তাকেই সমর্থন করেন।
প্রায় এক যুগেরও বেশি হলো অবসর নিয়েছেন ডাক্তারি পেশা থেকে। ফ্লোরিডার চমৎকার পরিবেশে থাকেন। বাংলাদেশের মতো সবুজ চারদিকে। দেশের সব ফলমূল লাগিয়েছেন বাড়ির আশেপাশে। ঘরে ঢুকতেই গন্ধ পান রজনীগন্ধার। বাংলা গান শোনেন। বাংলা বই পড়েন। আকাশের দিকে তাকালেই দেখেন সাদা মেঘের ভেলা। হাফিয ভাই আমাকে হাসতে হাসতে বললেন, জীবনের শেষ কটা দিন এখানেই কাটবে, আমিতো আমার সোনার বাংলাতেই আছি। আশে পাশের সব কিছু আমাকে কেবল আমার প্রানের বাংলাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।"
এই ফেব্রুয়ারিতেই তার জন্ম, ফেব্রুয়ারি তাকে করেছে বাঙালি, ফেব্রুয়ারি তার চেতনা। গত ফেব্রুয়ারিতে হারিয়েছেন তার প্রিয় জীবন সঙ্গিনী, ডাঃ রউনক কে। এই একলা জীবনে পূর্ণতা এনে দেয় তার বাঙ্গালিত্ত।
প্রায় এক যুগ আগে আমি তাকে মঞ্চে ডেকেছিলাম একুশের স্মৃতিচারণ করবার জন্য। মঞ্চে দাঁড়িয়ে দরাজ গলায় গান গেয়েছিলেন তিনি সেদিন, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল নোনা জল...
“বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক।
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।’’
লেখক : ডা. বিএম আতিকুজ্জামান, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি।
এআরএস/আরআইপি