ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পর্যটন বর্ষ ২০১৬, কিছু ভাবনা

প্রকাশিত: ০২:১২ এএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নেপালের লুম্বিনি গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। শুধু জন্মগ্রহণই নয়, বুদ্ধত্ব লাভের পরও সিদ্ধার্থ বুদ্ধ লুম্বিনির বনে এসেছিলেন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো লুম্বিনিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করে। এখানে বর্তমানে রয়েছে বেশ কিছু মন্দির, মঠ ও অশোকস্মারক স্তম্ভ। প্রতিদিন এখানে আসেন হাজারো পর্যটক।

লুম্বিনিতে পর্যটক আসবে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু চিতওয়ান ফরেস্ট-এ বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা দেখে একটু বিস্মিতই হতে হলো। একটা খুব সাধারণ নদী, নাম তার নারায়নী, পাশে খুব সাধারণ একটি বন। নদীতে সেভাবে স্রৌত নেই, নদীর পানিও খুব স্বচ্ছ নয়। অথচ এর তীরে শত শত রেস্টুরেন্ট, হোটেলসহ পর্যটন স্থাপনা এবং নানা ধরনের আনন্দ আয়োজন।

ভূমিকম্প পরবর্তী নেপাল যে আবার জেগে উঠছে তা দেখা গেলো এবার বাংলাদেশের পর্যটন খাতে জড়িতদের ফ্যামিলিয়ারাইজেশন বা ফ্যাম সফরের মাধ্যমে। যারা পর্যটন খাতে বাণিজ্য করেন তারাও অবাক হয়েছেন যে, এটিও হতে পারে একটি প্রোডাক্ট (দর্শনীয় স্থান)। বাস্তবতা হলো তারা সেটি করতে পেরেছে, আমাদের দেশে এর চেয়ে অনেক সুন্দর নদী আছে, নদীর তীর আছে, আছে প্রকৃতি, কিন্তু আমরা সেগুলোকে প্রোডাক্ট হিসেবে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে পারিনি।

সরকার ২০১৬ কে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করেছে। ২০১৪ সালের ০৭ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও পর্যটন সম্মেলনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘোষণা দেন। ২০১৬ সালে ঘোষিত পর্যটন বর্ষ এর কার্যক্রম বর্ধিত থাকবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। এই তিন বছরে মোট ১০ লক্ষ বিদেশি পর্যটকের বাংলাদেশে ভ্রমণকে লক্ষ্য ধরে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও মন্ত্রণালয়। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে, সাথে তিন লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থান এর সুযোগ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  

এসবই শুনতে খুব ভালো মনে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। হঠাৎ করেই হয়েছে এই ঘোষণা, ফলে সেভাবে কোনো প্রস্তুতি আগে থেকে চোখে পড়েনি। তাই ঘোষণার পরও কোনো কার্যক্রম সেভাবে অনুভূত হচ্ছে না। তাই বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বললে শুনতে হয় অর্থের অভাবে ম্লান পর্যটন বর্ষের পরিকল্পনা। এই বর্ষ পালনের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল ২৩২ কোটি টাকার, মিলেছে ৬০ কোটি। তাও পড়েছে ছাড় বিলম্ব জটে। তাই পর্যটন বর্ষের যাবতীয় ঢাক-ঢোল পরিকল্পনা এখন আনেকটাই নিস্তব্ধ।

শুধু পর্যটক বাড়ানো নয়, বাংলাদেশকে অন্যতম সেরা পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বিশ্বে অবস্থান তৈরি করতে চায় সরকার। কিন্তু তার জন্য ক্যাম্পেইন বা প্রচারণা কোথায়? এখনো সম্পৃক্ত হয়নি পর্যটন শিল্পের প্রধান চার স্টেকহোল্ডার ট্রান্সপোর্ট, হোটেল-মোটেল, খাদ্য ও পানীয় এবং ইভেন্ট তথা বিনোদন খাত। ঠিকমতো যুক্ত করা হয়নি বেসরকারি খাত ও গণমাধ্যমকে। ২০১৮ সালে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি পর্যটক দেশে আনার লক্ষ্য নেয়া হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে কি পরিমাণ পর্যটক আসছে তার কোনো পরিসংখ্যান তুলে ধরেনি পর্যটন মন্ত্রণালয় ও খোদ বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড।

বিভিন্ন দেশে পর্যটন বর্ষ পালন করার সিদ্ধান্ত হয় অন্তত তিন বছর আগে। এই তিন বছরে তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করে অতিথিদের আপ্যায়নের। এভাবেই মালয়েশিয়া গত ২০১৪ সালে পর্যটন বর্ষ পালন করেছে। আর ভুটান, মালদ্বীপ ও ভারত গত বছর পর্যটন বর্ষ পালন করেছে। এর আগে বাংলাদেশে ২০১১ সালে একবার তড়িঘড়ি করে পর্যটন বর্ষ পালন করা হয়েছিল। তাতে তেমন কোনো সফলতা আসেনি। এবার আবার আমরা নেমেছি।  

গত ৩১ ডিসেম্বর কক্সবাজারে বিচ কার্নিভালের নামে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে পর্যটন বর্ষ, যাকে বলা হয়েছে সফট লঞ্চ। এখন পর্যন্ত এটুকুই কার্যক্রম। কবে হার্ড লঞ্চ হবে কেউ জানে না। পর্যটকের সংখ্যা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক। পর্যটন হলো ব্যবসা আর ব্যবসায় যদি হিসাব না থাকে তাহলে ব্যবসা কিভাবে চলে? পর্যটক পরিসংখ্যান টিএসএ (ট্যুরিস্ট স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট) সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা আজও হলোনা। এটি না হলে পর্যটক বাড়ছে নাকি কমছে তার নিশানা পাওয়া যাবে কি করে?

পর্যটন বর্ষ পালন কোনো সাধারণ বিষয় নয়। আমরা বলছি বিউটিফুল বাংলাদেশ আমাদের থিম। প্রশ্ন হলো কোন দেশ বলবেনা যে তার দেশ বিউটিফুল? পরিসংখান না থাকা, কোয়ালিটি ট্যুরিজম সার্ভিস (কিউটিসি) নিশ্চিত না করা, পর্যাপ্ত সময় না নিয়ে পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার নির্ধারণ না করা, বরাদ্দ অনিশ্চিত, ভালো কোনো থিম ঠিক না করা, টার্গেট মার্কেট ও পণ্য নির্বাচন না করা, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না করা এবং যথেষ্ট প্রচার-প্রচারণা ছাড়া কতদূর যায় এই বর্ষ পালন তাই এখন দেখার বিষয়।

এখন পর্যন্ত মূল ভিত্তি ধরা হচ্ছে বৌদ্ধ সার্কিটকে ঘিরে। গৌতম বুদ্ধের চুলসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে নানা বৌদ্ধ স্থাপনা ও নিদর্শন ঘিরে আশা যে, এশীয় অঞ্চলের বৌদ্ধ পর্যটকরা নজর দিবে বাংলাদেশের দিকে। সেটিও নির্ভর করছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইচ্ছার ওপর। বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বাংলাদেশে  সম্মেলন হয়েছে। তাই দেশের ভেতরে-বাইরে খুব সযত্নভাবে প্রচার করতে হবে যে বাংলাদেশের সদিচ্ছা আছে এখানকার মানবিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরার। পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে হবে যে, এই দেশ সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহন করে, এই দেশে সব ধর্মের মানুষের অবাধ স্বাধীনতা।

ভারত, ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের সাথে ক্রস বর্ডার ট্যুরিজমের প্রতি কিছুটা পরিকল্পিত নজর দিলেও হয়তো পর্যটক দেখবো আমরা আগামী দিনগুলোতে। নয়তো সন্তুষ্ট থাকতে হবে বিশৃঙ্খলভাবে চলা অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাণিজ্য নিয়েই।  

যদি শেষ পর্যন্ত কিছু নাও হয়, অন্তত আমরা ভবিষ্যতের রোডম্যাপ ঠিক করতে পারি যদি, ঠিক কোন পথে আমরা কাজ করব সেটা নির্ধারণ করতে পারি যদি, সেটাই হবে সাফল্য। তাই ট্যুরিজম বোর্ডের কাজ হবে পথের বাধা, চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা, সেই অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা। অনেক কাজ করার চেয়ে কয়েকটি মৌলিক কাজে নজর দিলেই একদিন বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এ অঞ্চলের একটি অন্যতম ট্যুরিজম হাব। এগুলো হলো  ভ্রমণ সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন এবং সে জন্য বিদেশীদের জন্য বাংলাদেশ সফর অনেক বেশি সহজ করে তোলা, সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি ও সম্পদকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে আসা, প্রচারণায় নজর দেয়া।

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন