বায়ান্নর একুশ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে যে ৬ জন তরুণ শহীদ হলেন, যারা আহত হলেন-তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গোটা পূর্ব বাংলা যেন তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির এমন মর্মন্তুদ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি প্রতীকী শহীদ মিনার তৈরি করা হলো, সাড়া জাগানো বেশ কটি কবিতা, নাটক ও গান রচনা করা হলো যা প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষ দিনটিকে কতোটা গভীর দুঃখ, শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে নিয়েছে।
সেই থেকে যতই বছর পার হয়েছে ততই বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম, শহরের শিক্ষিত, তরুণ, নারী-পুরুষ, চাকুরীজীবী, কর্মজীবী বাঙালি পুলিশ ও সামরিক সদস্যদের মধ্যেও দিনটি হয়ে উঠতে থাকে জাতীয় শোক দিবসে। ঐ দিনের ঘটনাবলি এবং হত্যাকাণ্ড এভাবে অন্তহীন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, মানুষের মনে গভীর রেখাপাত ঘটাবে, সুদূরপ্রসারি প্রভাব বিস্তার করবে-তা সেই সময় অনেকে এতোটা বুঝতে পারে নি। পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং সরকার পরবর্তীকালেও বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করে বুঝতে চেষ্টা করেছে- এমনটি কখনও মনে হয় নি। অনেকের ধারণা ছিল এ সব হত্যাকাণ্ডের কথা মানুষ কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো অন্যান্য ঘটনার মতো ভুলে যাবে। ইতিহাসে এ ধরনের নজির তো কম নেই। এটিও হয়তো কালক্রমে সেভাবেই গুরুত্বহীন হয়ে যাবে, ছোট হয়ে আসবে এমনটিই শাসক গোষ্ঠীর ধারণা ছিল। কিন্তু ইতিহাসের বিস্ময় যে কী হতে পারে তা অনেকেই আগে থেকে বুঝতে পারে না।
যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন এর উত্তেজনাকে অনেকেই সাময়িক মনে করে থাকতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোনো কোনো ঘটনা যত দিন এবং বছর অতিক্রান্ত হতে থাকে তত মানুষ ঐ ঘটনাকে আঁকড়ে ধরতে থাকে, মানুষ আরও বেশি বেশি দিনটির ইতিহাসের মর্মবাণীকেন্দ্রিক সমবেত হতে থাকে। তখন ঘটনাটি নতুন আলোয় নতুনভাবে উদ্ভাসিত হতে থাকে। নতুন প্রজন্মকে দিবসটির ইতিহাস আপন করে নিয়ে থাকে। এভাবে নেওয়ার এর মূলে থাকে ঘটনার পেছনে মানুষের চেতনাকে নাড়া দেওয়ার মতো নানা উপাদানের উপস্থিতি যা আগে হয়তো স্পষ্ট থাকে না, পরবর্তী সময়ে জাতীয়ভাবে ক্রমেই ধরা দেয়। ১৯৫২ সালের ২১ তে ফেব্রুয়ারি কোনো মামুলি বিষয়কে নিয়ে সংঘটিত ঘটনা নয়, এখানকার তরুণরা শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে হরতাল পালন করার জেদাজেদি করেনি। বরং এটি গোটা জাতির অস্তিত্বকে চিরকাল নাড়া দেওয়ার মতো গভীর বিষয়কে কেন্দ্র করে সংঘটিত একটি বিষয় ছিল সেটি তারা অনেকটাই উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
এসব তরুণ ভাষা ও সংস্কৃতির মূল বিষয়কে রক্ষা করার জন্যেই সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেছিল। এর পরিণতি তাদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মারাত্মক হবে এমন আশঙ্কা থাকার পরও তারা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিল। তারপরই অতর্কিত আক্রমণ এবং হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় সরকারের দিক থেকে। পূর্ব বাংলার তরুণদের এমন একটি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পেছনে ছিল কয়েক বছরের মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন। সেটিকে ক্রমাগতভাবে দমন করার চেষ্টা করেছে, পাকিস্তান সরকার দাবিটিকে উপেক্ষা করেছেন। তারা বাঙালি তরুণ নেতৃত্বের ওপর জেল-জুলুম ও নির্যাতন চালিয়েছে। অথচ পূর্ববাংলার নেতৃবন্দ ১৯৪৮ সাল থেকেই যুক্তিসঙ্গতভাবেই দাবি করেছে যে, বাংলা পূর্ব বাংলার জনগণের মাতৃভাষা হিসেবে পাকিস্তানের অন্যতম ভাষার স্বীকৃতি পাক, কোনো অবস্থাতেই অন্য জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে কিছু করা নয়। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা ক্রমাগতভাবে দিয়েই এসেছে, আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্ভট তত্ত্ব প্রদান করেছে। ফলে বিষয়টি মানুষকে পাকিস্তানের প্রতি ক্ষুব্ধ করতে থাকে। অথচ ১৯৪৭-এর আগে পাকিস্তান আন্দোলন এবং প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল।
আন্দোলনের সময় পাকিস্তানকে অন্য সাধারণ রাষ্ট্র চোখে দেখার পর্যায়ে বাঙালি মুসলমানগণ ছিল না। তারা বরং দেশটিকে অধিকতর ধর্মীয় আবেগ ও অন্ধ বিশ্বাসে দেখেছে। এক কথায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলমানদের অবদান পশ্চিম পাকিস্তানিদের চাইতে অনেক বেশি সর্বাত্মক ছিল। সেই পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে থেকেই একটি মহল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে অনাকাঙ্খিত কিছু বিতর্ক তৈরি করতে থাকে। প্রথম প্রথম পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সময় মানুষ ক্রমাগতভাবে পাকিস্তানের বাঙালিবিরোধী অবস্থান ও আচরণ দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছে। ১৯৫০-এর দিকে পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করে। পাটের দাম কমে যায়, লবণের মূল্য বেড়ে যায়। পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসে একের পর এক আঘাত লাগতে থাকে। এই অবস্থায় মাতৃভাষা বাংলার বিলুপ্তি ঘটলে বাঙালি জাতি এই অঞ্চলে অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়বে, মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটায় সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে পড়বে। এমন একটি বাস্তবতা, মনোভাব ও চেতনাবোধ ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকে। এর ওপর মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে যখন সরকারের অবস্থান আরো নির্মম হয়ে ওঠে তখন রুখে দাঁড়ানোর সাহস বাড়তে থাকে, অন্ধ বিশ্বাসকে ঝেড়ে ফেলে দাঁড়ানোর অবস্থা তৈরি হতে থাকে। এবং ২১ ফেব্রুয়ারি যখন সত্যিসত্যিই হরতাল পালনে বাধা দেওয়ার লক্ষ্য হিসেবে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় তখন এটি ভাঙ্গার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় তরুণদের পক্ষ থেকে।
যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে গুলি ছোড়া হয়, মানুষ মারা যায় তখন বাঙালি নারী-পুরুষ, কিশোর ও বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেই অতি দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। এখানেই একুশের অনন্যতা, অসাধারণত্ব। মানুষ তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার মধ্য দিয়েই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কথা উপলব্ধি করতে মোটেও বিলম্ব করেনি। এটি ক্রমেই রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রোপলব্ধিরও বিষয় হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসকেও ছুঁড়ে ফেলার অভিঘাত সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র যে পূর্ব বাংলার মুসলমানের স্বার্থ রক্ষাকারী নয় সেই উপলব্ধি তখন মানুষের ঘরে ঘরে যেন বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে পৌঁছে গেছে মানুষের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারির এপিঠ ওপিঠের খবর, বার্তা এবং উপলব্ধির বিষয়। ঢাকা থেকে সুদূর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ কোথায় নয়। গ্রামে গ্রামেও পৌঁছে গেছে শহীদদের নাম। ঢাকায় একটি প্রতীকী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার কথা জানা হয়ে গেল, সেটি পাকিস্তানিদের দ্বারা ভেঙ্গে দেওয়ার কথাও অজানা থাকেনি। অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া কিছু কবিতা ও গানের বাণীর কথা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এমন ঘটনা ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া হয় না কিছুতেই।
আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি সেভাবেই নতুন নতুন ফাগুনে কৃষ্ণচুড়ার রঙে চারদিক যেন রাঙিয়েছে। এর পর প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এসেছে বাঙালির আবেগ অনুভূতিকে আরো বেশি বেশি করে নাড়া দিতে। মাতৃভাষা বাংলাকে কেড়ে নেওয়ার আর সুযোগ পাকিস্তানের হাতে থাকে নি। ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে মোড় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ১৯৫৩-তে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে, ২১ দফা আদায়ের প্লাটফর্ম তৈরি করেছে। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে গণরায়ও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪- অল্প এই ক’বছরে পাকিস্তানের রাজনীতির চেহারাই পূর্ব বাংলায় ঘুরে যায়, দাঁড়িয়ে যায় পূর্ব বাংলার নিজস্ব রাজনীতির বাতাবরণ। বায়ান্নের একুশ কেবল আর শহীদ দিবসে আবদ্ধ থাকেনি, বাঙালির মুক্তির আকাক্ষা ক্রমশ দিবসটিকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ঊনসত্তরে এসে একুশ গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে গোটা জাতিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ করেছে। বাঙালি এবং পূর্ব বাংলার জনগণ বিজয় লাভ করেছে। চেতনা ও প্রেরণার মূল ভিত্তি ছিল বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, শহীদ দিবসের চেতনা।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয়তাবাদ আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলনীতিতে পরিণত হয়। বর্বর শাসক গোষ্ঠী-এর মমার্থ বুঝতে পারে নি। পাকিস্তান দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করতে চেয়েছিল। অথচ বাঙালি নেতৃবৃন্দ তখনও বলেছিল পাকিস্তানের ছোট বড় সকল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রতি রাষ্ট্রের সমান দৃষ্টি দিতে হবে, মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। বাঙালির এমন উদার দৃষ্টি ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় সমৃদ্ধ হয়েছে, দৃষ্টি কেড়েছে বাইরের দেশেও। জতিসংঘ সারা পৃথিবীর জন্যে একুশের মাতৃভাষা রক্ষার আবেদনকে অপরিহার্য মনে করেছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে সকলের মাতৃভাষা রক্ষা ও মর্যাদার দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাঙালির একা নয়, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকাসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন তাই বিশ্ব পরিসরে পরিচিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ আমাদের অহংকার, গর্ব।
লেখক : কলামিস্ট, অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/পিআর