ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

এখনও জীবিত রোকেয়া

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ১০:২১ এএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২২

রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। অথবা শুধু রোকেয়া খাতুন অথবা রোকেয়া বললেই চলে। তার নামের আগে বেগম যুক্ত করে তাকে যেন অনেকটা গণ্ডিবদ্ধ করে দেওয়া হয় বলে আমার কাছে মনে হয়। নারী বিশেষ করে অভিজাত নারী হলেই তার নামের আগে বেগম শব্দটি যুক্ত করে তাকে আটকে ফেলা হবে একটা নির্দিষ্ট ছকে, একটা গৎবাধা সংজ্ঞায়।

রোকেয়াকেও প্রায়শই বাঙালি তার নিজস্ব ক্ষুদ্র মনের মাপে, মননের মাপে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলতে চায়। যেমন- রোকেয়ার শিক্ষা বিস্তারের প্রয়াসকে যতটা প্রকাশ করা হয় ততোটাই চাপা দিয়ে রাখা হয় তার স্বাধীন চিন্তাগুলোকে। কারণ রোকেয়ার লেখাগুলো সেই সময়ের তুলনায় তো বটেই, এখনও এই সময়ের তুলনায়ও ভীষণ সাহসী। তার সাহসের কথায় পরে আসছি, তার আগে একটা অন্য কথা বলি।

তিন-চার বছর আগে অনলাইনে এক হুজুরের ওয়াজের একটা অংশ আমাকে ইনবক্সে পাঠালেন এক বন্ধু। তখন আমি চীনে। প্রবাসে থাকি, বাংলাদেশের সমাজের হাল হকিহত যেন সম্যক বুঝতে পারি সেজন্যই ওই ভিডিও ক্লিপ পাঠানো। ভিডিওটিতে দেখলাম রোকেয়াকে বিশ্রীভাবে গালাগাল করা হচ্ছে। বর্তমানে নারীর যে এত ‘সাহস’ বেড়েছে, নারীরা যে রীতিমতো মাথায় উঠে পড়েছে সেসবের পিছনে নাকি রোকেয়াই দায়ী। 

সেই হুজুর তীব্র আক্রোশে বলতে লাগলেন যে রোকেয়া তো জাহান্নামে যাবেই, তার অনুসরণ করে যেসব বাবা-মা নিজেদের কন্যাকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন বা এখনও পাঠাচ্ছেন এবং চাকরি করার অনুমতি দিচ্ছেন তাদেরও গুষ্ঠীশুদ্ধ জাহান্নামে যেতে হবে। ওই গালিবর্ষণই আমাকে বুঝিয়ে দিলো যে রোকেয়া এখনও জীবন্ত। ভীষণভাবে জীবন্ত। এখনও তিনি দারুণ প্রাসঙ্গিক।  রোকেয়া যদি এখনও জীবিত না হতেন তবে তাকে নিয়ে এই আশংকার কথাগুলো শোনা যেত না।

আচ্ছা কেন রোকেয়া এত বিপজ্জনক? কি বলেছেন তিনি? কি চেয়েছেন? রোকেয়া চেয়েছিলেন নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমাজ। রোকেয়া চেয়েছিলেন নারী স্বাবলম্বী হবে। নিজের ভাত-কাপড়টা নিজেই জোগাবে। শুধু তাই নয়, রোকেয়া চেয়েছিলেন নারীমুক্ত হবে শুধু পুরুষের অধীনতা থেকে নয়, বরং পুরুষতন্ত্রের  চিন্তাগত অধীনতা থেকেও। ১৯০৪ সালে তিনি লিখছেন, পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডিমাজিস্ট্রেট, লেডিব্যারিস্টার, লেডিজজ  সবই হইব!... উপার্জন করিব না কেন?... যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামী’র গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?... আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করি না বলিয়া তাহা হীনতেজ হইয়াছে। এখন অনুশীলন দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিকে সতেজ করিব। যে বাহুলতা পরিশ্রম না করায় হীনবল হইয়াছে, তাহাকে খাটাইয়া সবল করিলে হয় না?   

রোকেয়া তার অবরোধবাসিনী বইতে পর্দাপ্রথার ভয়াবহতা তুলে ধরেছিলেন। সেখানে তিনি বাস্তব কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। কয়েকটি ঘটনা আমার এখনও মনে আছে যদিও বইটি পড়েছিলাম বিশ বছর আগে। সেখানে ছিল আপাদমস্তক বোরকায় আবৃত এক নারী কিভাবে পুরুষ আত্মীয়র পিছু পিছু তার কাপড়ের খুট ধরে রেললাইন পার হতে গিয়ে পড়ে যান। কিন্তু কোন পুরুষ তাকে হাত ধরে উঠানোর অনুমতি পায় না পাছে পর্দার সামান্য বিচ্যূতি ঘটে। শেষ পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়েন সেই নারী। আরেকটি ঘটনায় আছে পালকির ভিতরে পর্দায় আবৃত নারী সারারাত শীতের ভিতরে অতিবাহিত করেন তবু পালকি থেকে নামেন না পাছে কোন পুরুষ তাকে দেখে ফেলে।

অবরোধবাসিনী (১৯৩১) প্রকাশিত হওয়ার পর প্রবল আলোড়ন ওঠে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলার মুসলিম নারীরা অবরোধ ভেঙে অনেকটা বেরও হয়ে আসেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের এই অবরোধ ভাঙার প্রয়াসটা দেখা গিয়েছিল ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতকের শুরুর দিকেই। ষাট ও সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায় সে সময় অবরোধ তারা অনেকটাই ভাঙতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন আবার যেন সেই অবরোধকেই ‘চয়েজ’ বলে চিৎকার করতে করতে পুরুষতন্ত্রের শিখানো বুলি আওড়ে যাচ্ছেন অনেক নারী। গত শতকে রোকেয়া  লিখছেন,

যখনি কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। ... আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্যে পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ইশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। ... এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাঁহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। ... ধর্ম আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।Õ

আমার তো মনে এই সাহসী উচ্চারণ যদি রোকেয়া এই শতকে করতেন তাহলে তাকে টুকরো করে কাটা হতো। রোকেয়া ‘মতিচূর’ বইতে তার স্বাধীন চিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন। সেটি ১৯০৪ সালে প্রকাশিত। সুলতানার স্বপ্ন বইতে তিনি কল্পনার রঙে এমন এক নারীস্থানের কথা লিখেছেন যেখানে পুরুষতন্ত্রের মুখে চপেটাঘাত করা হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে এখনও, এই একশ বছর পরেও অনেক নারী পুরুষের গোলামি করে চলেছেন মানসিকভাবে। তারা স্বাধীন চিন্তা করতে গেলেও ভয়ে শিউরে উঠছেন। রোকেয়া যথার্থই লিখেছিলেন,

 আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসীত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। ক্রমে পুরুষরা আমাদের মনকে পর্য্যন্ত দাস করিয়া ফেলিয়াছে।... তাহারা ভূস্বামী গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে আমাদের "স্বামী" হইয়া উঠিয়াছেন।... আর এই যে আমাদের অলঙ্কারগুলি– এগুলি দাসত্বের নিদর্শন। ... কারাগারে বন্দিগণ লৌহনির্ম্মিত বেড়ী পরে, আমরা স্বর্ণ রৌপ্যের বেড়ী পরিয়া বলি "মল পরিয়াছি। উহাদের হাতকড়ী লৌহনির্ম্মিত, আমাদের হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্ম্মিত "চুড়ি!"... অশ্ব হস্তী প্রভৃতি পশু লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণশৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া বলি "হার পরিয়াছি!" গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া "নাকা দড়ী" পরায়, আমাদের স্বামী আমাদের নাকে "নোলক" পরাইয়াছেন। অতএব দেখিলে ভগিনি, আমাদের ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি দাসত্বের নিদর্শন ব্যতীত আর কিছুই নহে! ... অভ্যাসের কি অপার মহিমা! দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্বসূচক গহনাও ভালো লাগে। অহিফেন তিক্ত হইলেও আফিংচির অতি প্রিয় সামগ্রী। মাদক দ্রব্যে যতই সর্বনাশ হউক না কেন, মাতাল তাহা ছাড়িতে চাহে না। সেইরূপ আমরা অঙ্গে দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিয়াও আপনাকে গৌরবান্বিতা মনে করি। ... হিন্দুমতে সধবা স্ত্রীলোকের কেশকর্ত্তন নিষিদ্ধ কেন? সধবানারীর স্বামী ক্রুদ্ধ হইলে স্ত্রীর সুদীর্ঘ কুম্ভলদাম হস্তে জড়াইয়া ধরিয়া উত্তম মধ্যম দিতে পারিবে। ... ধিক আমাদিগকে!আমরা আশৈশব এই চুলের কত যত্ন করি! কি চমৎকার সৌন্দর্য্যজ্ঞান!

দাস যখন শিকল কাটতে চায়, পালাতে চায় তখন বোঝা যায় তার দেহ দাসত্ব করলেও মন বেঁচে আছে, স্বাধীন আছে। কিন্তু দাস যখন আনন্দের সঙ্গে দাসত্ব করে, এবং দাসত্বকেই পরম প্রাপ্তি বলে মনে করে সেটা এক ভয়ংকর অবস্থা। আমাদের সমাজ এখনও সেই ভয়ংকর অবস্থার ভিতর দিয়ে চলছে। এখনও নারীরা মনেপ্রাণে মুক্ত হতে তো পারেইনি, মুক্ত হওয়ার ইচ্ছাটাও অনেক সময় পোষণ করছে না। বরং অধীনতাকেই ‘চয়েজ’ বলে ভাবতে শিখছে।

পুরুষতন্ত্রের শিখানো বুলি আউড়ে ভাবছে এটা তার নিজেরই কথা, নিজেরই মনোবাসনা। এখানেই রোকেয়ার প্রয়োজন খুব বেশি। আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচানোর জন্য এখন চাই রোকেয়ার রচনা পাঠ। রোকেয়ার জীবনী পাঠ। প্রতিটি মানবাধিকার সংস্থা থেকে রোকেয়া রচনার পাঠচক্র গড়ে তোলা হোক। প্রতিটি নারীকে, কিশোরীকে, তরুণীকে উপহার দেয়া হোক রোকেয়া রচনাবলী। একবারের জন্য হলেও যদি কৌতূহলবশে পাতাটা উল্টে দেখে, যদি রোকেয়ার অন্তরের আলোক শিখা কোনভাবে তার ঘুমন্ত মনকে স্পর্শ করে তাহলে হয়তো দাসীর খোলস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে একজন পূর্ণ মানব। রোকেয়া রচনাবলীর অনুবাদ হোক বিভিন্ন ভাষায়। তাহলে বিশ্বের সামনে আমরা বাঙালি জাতির মানসঐশ্বর্য তুলে ধরতে পারবো।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন