স্রষ্টার সৃষ্টিকে অবহেলা করে স্রষ্টাকে তুষ্ট করা যায় কী?
বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার ভুক্ত, সৃষ্টির মধ্যে সেই ততোধিক প্রিয় যে পরিবারের অন্যান্যদের সহিত সহানুভূতি প্রদর্শন করে।’
হজরত মুহাম্মদ (সা.) সমস্ত বিশ্বের জন্য রহমত হয়ে এসেছেন। তিনি বিশ্ব মানবের জন্য শান্তির বাহক। তিনি নির্দিষ্ট কোনো দেশ, জাতি বা গোত্রের জন্য প্রেরিত হননি। তার উদার মহান শিক্ষা ও আদর্শ পূর্ব পশ্চিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মহানবির (সা.) উপরোক্ত বাণীটি এরই প্রতিপাদক যে, তিনি বিশ্বনবি। বিশ্বের জন্য তিনি রহমত স্বরূপ। এ বাণীটিতে তিনি জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি এমনকি অপরাপর জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনের বিষয়েও ইঙ্গিত করেছেন।
হাদিস গ্রন্থাবলী হতে আমরা জানতে পারি যে, একজন নারী এ কারণে নরকাগ্নিতে প্রবেশ করেছে যে, একটি বিড়ালকে সে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রেখেছিল। অপরদিকে এক ব্যক্তি পিপাসার্ত একটি কুকুরকে পানি পান করানোর ফলে বেহেশত লাভ করেছেন। সৃষ্টির সেবা যে কত মহান কাজ, তা উল্লিখিত দু’টি ঘটনার দ্বারা সহজে অনুমেয়। ধর্ম, মানুষের সুখ-শান্তি ও পথ প্রদর্শন এবং আলোর সন্ধান দিবার জন্য। ধর্মের মৌলিক অংশ দু’টি। প্রথমটি হল আল্লাহর প্রতি মানুষের কর্তব্য।
নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি। আল্লাহর গুণ প্রকাশ, মহিমা কীর্তন ও তার পবিত্রতা ঘোষণা, তা আল্লাহর নির্দেশিত যে নিয়মেই হোক না কেন, তা মৌখিক ভাবে প্রকাশ, আন্তরিকতার সাথে বিশ্বাস এবং কার্যত প্রকাশ করলে সাধারণত আল্লাহর হক আদায় হয়। দ্বিতীয়টি হল মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য। আল্লাহ যা আদেশ দিয়েছেন তা পালনে মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারে।
মানুষের প্রতি মানুষের করণীয় যা আছে তা পালনে বান্দার হক আদায় হয়। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে ভালোবাসে, জীবন ধারণের জন্য একে অপরের প্রতি নির্ভর করে। একা কেউই তার সম্পূর্ণ প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ করতে পারে না। একে অপরের সহায়তা করবে এবং করে থাকে এটাই স্বাভাবিক।
কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির কেবল স্তুপীকৃত সম্পদ থাকলেই তার জন্য মহাপ্রাসাদ গড়ে উঠবে না। সে জন্য তাকে রাজ মিস্ত্রী হতে শুরু করে সাধারণ মজুরের প্রতি নির্ভর করতে হয়। তাই কাউকে ছোট বা হেয় করারও শিক্ষা ইসলামে নেই।
এছাড়া যাদেরকে আল্লাহতায়ালা ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তাদের উচিত অন্যদের সাহায্য করা। দেখা যায়, গরীব ছেলেরা লেখাপড়া করতে বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। আবার প্রাইভেট শিক্ষকের নিকট পড়ার সামর্থ্যও তাদের হয় না। সম্পদশালীরা তাদের অর্থের দ্বারা এবং শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের বিদ্যার দ্বারা তাদের সাহায্য করতে পারেন। কারো জ্ঞান থাকলে, কেউ লিখতে পারলে, লেখার মাধ্যমে সে জনসেবার দায়িত্ব পালন করতে পারে। বক্তা তার বক্তৃতার মাধ্যমে, লেখক তার লেখার মাধ্যমে, বিত্তশালীরা তার সম্পদ দ্বারা, বুদ্ধিমান তার বুদ্ধির দ্বারা, জ্ঞানী তার জ্ঞান দ্বারা, স্বাস্থ্যবান তার শক্তির দ্বারা সমাজের সেবা করবে। আলোর দিকে পথ দেখাবে। সুপথের দিকে আহ্বান করবে। বিদ্যার দ্বারা জনসেবা করলে বিদ্যা কমে যায় না বরং তার বৃদ্ধি ঘটে, প্রদীপ্ত হয়ে উঠে।
আল্লাহর প্রতিটি দান মানুষের উন্নতির জন্য। প্রয়োজন শুধু পরস্পর সহযোগিতার। অনেক সময় পথে ঘাটে কলা বা আমের খোসা ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আবার ঐগুলোতে পা পিছলিয়ে ধরাশায়ী হতে এমনকি হাত পা ভাঙ্গতেও দেখা গেছে। একটু কষ্ট স্বীকার করলে মানুষ পথ-ঘাট পরিষ্কার রেখে এ প্রকারের দুর্ঘটনা হতে রেহাই লাভ করতে পারে। আমরা যাকে ভালোবাসি তার দুঃখ সহ্য করতে পারি না। মানুষ যদি বাস্তবিক মানুষকে ভালোবেসে থাকে তবে সবার ব্যথায় ব্যথিত হবে ও সবার দুঃখে দুঃখিত হবে।
যদি কারো শরীরের কোন অঙ্গ আঘাত পায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে তবে সে কি আনন্দ পায়? বরং কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সমাজের এক অংশ ক্ষুধার্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, বস্ত্রহীন হলে অপর অংশ তাদের সাহায্যার্থে প্রাণঢালা সাহায্য করবে। তবেই সুষ্ঠু ও বলিষ্ঠ জাতি গড়ে উঠবে। আত্মতুষ্টির জন্যও খেদমতে খালকের প্রয়োজন রয়েছে। যদি কেউ বোঝা বহন করতে অসমর্থ হয় এবং কুলি-মজুরকে দেবার পয়সাও তার নিকটে না থাকে তবে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলে তার বোঝা বহন করা দরকার। বাস, রেলগাড়ি ইত্যাদিতে ভ্রমণের সময় বৃদ্ধলোক বা মেয়েলোকদের বসবার স্থান না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের বসার সংস্থান করে দেওয়াও খেদমতে খালকের অন্তর্গত।
প্রত্যেহ খেদমতে খালকের কত সুযোগ পাওয়া যায়, যেগুলো পালনের জন্য আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন এবং নবীকূল শ্রেষ্ঠ হজরত রাসুল করিম (সা.) স্বয়ং পালন করে গেছেন, কিন্তু আমরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করি না বরং অবহেলা করি, অবজ্ঞার চোখে দেখি। স্রষ্টার সৃষ্টিকে অবহেলা করে স্রষ্টাকে তুষ্ট করা চলে না।
মানুষের দুঃখ ও ব্যথায় ব্যথিত হয়ে, তাকে মনে প্রাণে অনুভব করে তার প্রতিকার করার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা করতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বের প্রতি সজাগ থাকে তবেই খেদমতে খালকের মহান সংঘ গড়ে উঠবে! অপরের প্রতি অনুকম্পা, সহানুভূতি উদারতা ও দয়া প্রদর্শন করা একান্ত প্রয়োজন। দয়া হতে দানশীলতার সৃষ্টি হয়। দানশীলতা ও সেবা করা মানবচরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য, নির্দয় ব্যক্তি পাষাণবৎ।
অপরের অশ্রু দর্শনে যার হৃদয় বিগলিত হয় না, সে জনসেবার দাবি করতে পারে বটে, কিন্তু কার্যত কোনো উপকারই করতে পারে না। দুঃখির দুঃখমোচন, বিপন্নকে উদ্ধার, শোকাতুরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা খেদমতে খালকের অন্তর্ভুক্ত। দুঃখমোচন যেমন মানব ধর্ম, ভিক্ষার প্রশ্রয় অথবা অপরের ওপর নির্ভর করে থাকার সুযোগ দেওয়াও সেরূপ অধর্ম। লোক দেখানো দয়া, দান, উপাসনাকে সৃষ্টিকর্তা পছন্দ করেন না। কর্তব্যানুসারে জনসেবা করতে হবে প্রকাশ্যে ও গোপনে। তবে এতে বিনয় অবলম্বনই শ্রেয়।
লেখক: গবেষক।
এইচআর/জিকেএস