ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দৃশ্যমান ও অদৃশ্য

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০২২

বাংলাদেশ থেকে বাইরের কোনো দেশে আশ্রয় নেওয়া একজন ‘বিপ্লবী’, যার একটি বাংলা নাম এবং একসময় সিপিবি করতেন, পেশায় চিকিৎসক। তিনি গণজাগরণ মঞ্চ যখন হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, তখন বেশ সক্রিয় ছিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার কখনো সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়েছে বলে মনে পড়ে না। তবে তিনি সম্প্রতি আমাকে বিখ্যাত বানিয়েছেন। কোনো এক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন যে আমার সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। আমি যেসব লেখালেখি করি তা র’র পরামর্শে। ভদ্র লোকের নাম পিনাকী ভট্টাচার্য। তার নাকি বিপুল ভক্তকূল।

পিনাকী ভট্টাচার্যের এখনকার প্রকৃত পেশা কি, তার জীবিকা কীভাবে নির্বাহ হয়, তা আমি জানি না। তিনি কার পক্ষ নিয়ে কার জন্য কথা বলেন, সে সব নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। তবে আমার মতো নগণ্য একজন পেশাদার সাংবাদিকের প্রতি যে তার নজর আছে, সেটা জেনে একটু পুলক অনুভব করেছি বৈ কি! পিনাকী ভট্টাচার্যের বক্তব্য সরাসরি শোনার সুযোগ আমার হয়নি। আমি আমার কাজের জন্য যতটুকু তথ্য জানা প্রয়োজন, তার বাইরে কারও মনের মধ্যে কি আছে, তা জানার কৌতূহল বোধ করি না।

আমি গনক বা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হই হবে কোনো বিষয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করি না। কিন্তু পিনাকী ভট্টাচার্য নাকি দিব্যচোখে সব দেখতে পারেন, তাই তিনি শেখ হাসিনার সরকারের সামনে শুধু দুর্দিন দেখেন আর আওয়ামী লীগবিরোধীদের সুদিন দেখেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের পতন হলে কারা ক্ষমতায় আসবে এবং সে পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের কি লাভ হবে, তা আমি জানি না। পিনাকী ভট্টাচার্য হয়তো জানেন। তার মতো বেশি জানা মানুষ আমার মতো কম জানা মানুষকে কেন র’য়ের এজেন্ট বানাতে গেলেন, বুঝলাম না। আমার বাংলা নাম হওয়ায় এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির পক্ষে লিখতে পারি না বা লিখি না বলেই কি তার মনে হয়েছে, আমি র’য়ের লোক না হয়েই পারি না!

ভারতের সঙ্গে অকারণ মাখামাখি যেমন আমি পছন্দ করি না, তেমন অকারণ ভারতের মতো বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে কান খুঁচিয়ে ঝগড়া করারও আমি ঘোরতর বিরোধী। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বড় সহযোগিতা করেছে বলেই ভারতের দাদাগিরি আমাদের মেনে নিতে হবে, তা কিন্তু হতে পারে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকার যে নীতি নিয়েছে তা কোনোভাবেই বাংলাদেশের স্বার্থানাকূল হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের একজন বামপন্থি বুদ্ধিজীবী গৌতম রায় ‘তিস্তার পানি আটকাবার পেছনে মোদী-মমতার আসল উদ্দেশ্য’ শিরোনামে সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে লিখেছেন: দীর্ঘ প্রায় একযুগ ধরে ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিচুক্তি স্বাক্ষর করছে না। তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিমে। নদীটি পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো আন্তর্জাতিক নদীর পানি উৎপত্তিস্থলের দেশ গায়ের জোরে বন্ধ করে রেখে উজানে বওয়া দেশকে শুকিয়ে মারতে পারবে না।

গৌতম রায়ের বক্তব্য ঠিক আছে। কিন্তু এরপর তিনি যা লিখেছেন তা কি ঠিক। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করার কার্যত বিনিময় হিসেবেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গঙ্গার শাখা পদ্মাকে শুকিয়ে মারতে ফারাক্কা বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। ভারতের এই আধিপত্যবাদ, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, গাজোয়ারি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলেছিল। তার শত্রুশিবির ইন্দিরা গান্ধীর কর্মকাণ্ডে উৎসাহ পেয়েছিল। উৎসাহিত হয়েছিল হানাদার পাক শক্তি।

খুনি খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেও যে ফারাক্কা বাঁধ ঘিরে ভারতের গা-জোয়ারি, দাদাগিরি একটা বাড়তি সুযোগ করে দেয়নি- এ কথা বলা যায় না। শ্রীমতী গান্ধীর সেই স্বৈরাচারী মানসিকতার যোগ্য উত্তর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু গঙ্গার পানি চুক্তি রূপায়ণে মুখ্য ভূমিকা পালনের ভিতর দিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময়ে জ্যোতিবাবু তো বটেই, তার অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের জনপ্রিয়তা এমন উচ্চতায় বাংলাদেশে পৌঁছেছিল যে, শেখ হাসিনা রসিকতা করে আমাকে বলেছিলেন- আমার কনস্টিটুয়েন্সি থেকে অসীমবাবু দাঁড়ালে আমি হেরে যেতে পারি!’

গৌতম রায়ের বক্তব্য কি ইতিহাসের সত্য তুলে ধরেছে, নাকি এতে জ্যোতি বসু ও অসীম দাশগুপ্তের অতিরিক্ত প্রশস্তি করা হয়েছে। গঙ্গার পানি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে নিশ্চয়ই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গঙ্গা চুক্তি নিয়েও জ্যোতি বসু বাগড়া দিলে বড় সমস্যা হতো। কিন্তু সেজন্য এটা বলা কি অতিস্বয়োক্তি নয় যে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের জনপ্রিয়তা শেখ হাসিনাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল? আমরা সংবাদকর্মী হিসেবেও তো তখন অসীম দাশগুপ্তের ‘এতবড়’ ভূমিকার কথা শুনিনি। ঘটনার এত বছর পরে এসে প্রবীণ লেখক গৌতম রায় কেন এই বোমা ফাটালেন এবং দৈনিক সংবাদের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা এটা ছাপলো?

এখানেই শেষ নয়। গৌতম রায় আরও ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন তার লেখায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা নিয়ে যে খেলা খেলছেন তা আসলে ‘শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করবার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শরিক হিসেবে ভূমিকা’- এটা কি আগে কখনো শোনা গেছে?
গৌতম রায় লিখেছেন: ‘মমতা মুখে শেখ হাসিনার প্রতি সৌহার্দপূর্ণ কথাবার্তা বলেন, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে হাসিনাবিরোধী মানসিকতারই সব রকম পরিচয় রাখেন। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে মমতার দলের এক সময়ের রাজ্যসভার এক সদস্যের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও মমতার দলের সেই সময়ের কর্মরত সাংসদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে ভারত সরকারকে জানানো হয়েছিল বলে বিভিন্ন ভারতীয় খবরের কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।’

গৌতম রায়ের সর্বশেষ বক্তব্যটি আরও মারাত্মক। তিনি লিখেছেন: ‘আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শরিক হিসেবেই আরএসএস-বিজেপি চায় বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হোন শেখ হাসিনা। আমেরিকার তালে তাল দিয়ে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি চায় বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানের ছায়া ঔপনিবেশ হয়ে উঠুক। এজন্যই বাংলাদেশে যাতে শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তা হারান- সেই উদ্দেশেই ভারতের সমস্ত ধরনের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা চায় তিস্তার পানি চুক্তি না হোক।’

ভারতে আরএসএস-বিজেপি আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার পরাজয় চায়– এই বার্তা কি তাহলে বিএনপি-জামায়াতের কাছে পৌঁছে গেছে? সেজন্যই কি বিএনপির ১০ ডিসেম্বর নিয়ে এত উত্তেজনা? বিএনপি কি তাহলে ভারতের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি কখনো সরল রেখায় চলে বলে মনে হয় না। যারা মনে করছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে বিদেশিরা হাওয়া দিতে শুরু করেছে, তাদের কিন্তু অনেক কিছু মাথায় রাখতে হবে। কোনো একটি দেশ চাইলেই অন্য দেশের সমস্যা চাপ দিয়ে সমাধান করতে পারে না। মিয়ানমারকে বাগ মানানো যায় না। রাশিয়া-ইউক্রেন শান্ত করা যায় না। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সবাই বিবেচনায় থাকার কথা।

পিনাকী ভট্টাচার্যরা কল্পকাহিনি বানিয়ে প্রচার করে কোনো কিছু বদল ঘটাতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমাকে র’য়ের লোক বানিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্য তৃপ্তি পেলেও আমার অতৃপ্তি ,এত সব গোপন খবর আমি তো পাই না। আমাকে তো বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে নির্ভর করতে হয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ওপর। গত ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সব সময় ভারতের কাছ থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ভারতের একটি নীতি রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যেকোনো বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পায় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশকে ভারতের ‘খুব ভালো বন্ধু’ উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন, এ অঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে কাজ করবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুস্পষ্টভাবে বলেন, বাংলাদেশ কখনোই সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম ও সীমানা নেই। তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কখনো সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয় না এবং বাংলাদেশের মাটিকে কখনোই এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে দেয় না।’

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত আলোচনার মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানিবণ্টনসহ অমীমাংসিত সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। তিনি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।

প্রণয় ভার্মা বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রণয় ভার্মা বলেন, ভারত বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা দেবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রশংসা করেন।
শেখ হাসিনা যখন আর আশা-ভরসার কেন্দ্রে থাকবেন না, তখন কি হবে সেটা বলার মতো রাজনৈতিক জ্যোতিষীর খোঁজ পাওয়া গেছে কি?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন