মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব
বিনিময় প্রথার যুগে দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্য কেনাবেচা আমাদের সবারই জানা। পরবর্তীসময়ে অ্যাডাম স্মিথ তার ‘ওয়েলথ অব ন্যাশনস’ গ্রন্থে ‘বার্টার সিস্টেম’র মাধ্যমে দ্রব্য বিনিময়ের সংশোধনী এনে তাকে বাজারজাতকরণের আধুনিকায়ন করেছেন। অতি প্রাচীনকাল থেকেই পণ্যের মতো হাটে-বাজারে মানুষ বিক্রি হতো।
গ্রিসের অন্যতম প্রাচীন দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, দাস ব্যবস্থা প্রকৃতিরই নিয়ম। গ্রিকরা দাস বা স্লেইভ বোঝাতে ‘মানুষের মতো জীব’ কথাটি ব্যবহার করতো। দাস প্রথার আদ্যোপান্ত খুব ভালো করেই ফুটে উঠেছে উপন্যাসিক হাওয়ার্ড ফাস্ট রচিত স্টেনলি কুবরিক পরিচালিত হলিউডি চলচিত্র ‘স্পার্টকাস’ এ। দাস ব্যবস্থার প্রথম সফল বিপ্লবী মহানায়ক স্পার্টাকাসের সময়কাল খিষ্ট্রপূর্ব একশত বছর।
ইতিহাসবেত্তারা দাসপ্রথার সর্বশেষ সময়কে ১৯৬৩ ধরলেও আদতে এর কোনো শেষ বলে কিছুই ঘটেনি। আমাদের আচরণ, স্বভাব ও রক্তের সাথে মিশে আছে এই দাসত্ব। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। তবে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী ২ ডিসেম্বরকে পালন করা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এবলিশন অব স্লেভারি’ অর্থাৎ আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা মুক্ত দিবস হিসেবে।
আজও আমরা বেচাকেনা হই মজুরির বিনিময়ে। আমরা বন্দি করপোরেট সাম্রাজ্যের চার দেওয়ালে। আমাদের স্বকীয়তা নিয়ন্ত্রিত হয় করপোরেট সম্রাটদের ইচ্ছায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা বা রাত, অধিকন্তু সমগ্র চাকরি জীবন আমরা থাকি পরাধীন শৃঙ্খলে। এখানে ব্যক্তিগত কোনো আবেগ, অনুভূতি এবং প্রয়োজন বলে কিছু নেই পেশাদারিত্বের লেবাসে।
‘প্রফেশনালিজম’ বন্দিত্বের নতুন কবজ। গৃহপালিত পশুর মতো ছকে আঁকা জীবনের চলচ্চিত্র এটি। মনস্তাত্ত্বিক দাসত্বের বাণিজ্যিকীকরণ এখানে। সচরাচর আমাদের দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে একটি দৃষ্টান্ত প্রতীয়মান। পারিবারিক দাস-দাসির ইতিকথা আর গৃহপরিচারিকার চারণভূমি এই ভারতমহাদেশ। স্থায়ী গৃহপরিচারিকার প্রচলিত ভাষা রূপান্তর ‘চাকর বা চাকরানি’। তাদের পাখির খাঁচার মতো পরাধীন জীবন বন্দনা মধ্যযুগীয় দাস প্রথারই প্রতিচ্ছবি।
এখানে জীবন বড্ড বেরসিক। শারীরিক বন্দিত্বের চেয়ে মানসিক বন্দিত্ব চরম এখানে। এক অদৃশ্য বেড়িবাঁধা থাকে মনের পায়ে। মনস্তাত্ত্বিক দাসত্বের প্রভূত্ব মেনে নিয়ে এরা পৌঁছে যায় ত্যাগ, সেবা আর মহত্বের শিখরে। রবীন্দ্রনাথ তার ‘খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন’ গল্পে পারিবারিক ভৃত্যের যে চরিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে আচরণ ও স্বভাবসিদ্ধ ভৃত্য রায়চরণের বংশ পরম্পরায় তিন পুরুষের সেবা করা আর যা কিছুরই প্রমাণ দিক মূলত তা মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব।
রায়হান সাহেব চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের আগে একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরিরত ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন প্রায় প্রতি ছুটির দিনগুলোতে বিশেষত জাতীয় দিবসগুলোতে কোম্পানি বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো; যেমন- ‘ক কোম্পানি ফুটবল কম্পিটিশন’। আর এধরনের প্রত্যেক অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত থাকতে হতো কোম্পানি প্রতিনিধি হয়ে।
একসময় রায়হান সাহেব বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজন থেকে নিজেকে আলাদা আবিষ্কার করলেন। তার মনে হলো তিনি যেন ছিটকে পড়ছেন সমাজ থেকে। তাই তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি ছেড়ে দেওয়ার এবং পরে যোগ দিলেন শিক্ষকতায়।
আমরা সবাই জানি সার্কাসের বিশালদেহী হাতি কেমন করে তার মালিকের সাথে সুবোধ হয়ে খেলা করে কোনোরকম হুমকি ছাড়াই। শিকার মানানোর পদক্ষেপ হিসেবে হাতিটিকে প্রথমে চিকন অথচ শক্ত ধরনের এমন কিছু শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।
যখনই ওই হাতিটি পালানোর জন্য এদিক ওদিক চোটাছুটি করে তখনই সে পায়ে দড়ির টান পায় এবং পায়ে চোট লাগে। এমনি করতে করতে হয়তো পায়ে ঘা পড়ে যায়। পক্ষান্তরে, চোট পাওয়ার ভয়ে হাতিটি আর পালাতে চায় না। সে ওই গণ্ডির মধ্যে থাকতে এবং মনিবের প্রভুত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়।
আজ সকালে বড় এক করপোরেশনের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম- সারি সারি এক্সিকিউটিভের দল গলায় টাই ঝুলিয়ে মুরগির ছানার মতো তড়িঘড়ি করে খোয়াড় স্বরূপ অফিসে ঢুকছে। দেখে মনে হলো যেন ঢুকতে পাছে দেরি না হয়ে যায়। শোনা গেলো এ তড়িঘড়ির পেছনে কারণ ছিল প্রতি তিনদিনের বিলম্বে একদিনের বেতন কর্তন।
এমন অনেক ঘটনা পরিক্রমার এমন এক একটি জীবন, এক একটি নাটক, এক একটি গদ্য অথবা পদ্য ঔপনিবেশিক অতীতের নির্মম দাস বাণিজ্যের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। সত্যিকারের মুক্তির মন্দির এখনো সভ্যতার ইতিহাসে স্থাপিত হয়নি। তবে আমরা আশা করি ১ মে তথা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মতো আমাদের দেশেও ২ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা মুক্ত দিবস’ যথাযথ ভাবগাম্ভির্যতার সাথে পালিত হোক (যদিও অনেক বড় বড় দেশীয় কোম্পানি ১ মে তে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্জক্রম বহাল তবিয়তে চলমান রাখে)।
সচেতনতা বাড়ুক সব শ্রেণির পেশাদার বা চাকরিজীবীদের মধ্যে। তৈরি হোক কাজের সুষ্ঠু, বন্ধুসুলভ ও সামাজিক পরিবেশ। দূর হোক মানসিক দাসত্ব ও নির্যাতন। মানসিকতা হোক মানবিক।
লেখক: কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস