ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

১০ ডিসেম্বর

নয়াপল্টন না সোহরাওয়ার্দী উদ্যান?

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ২৮ নভেম্বর ২০২২

বিভাগীয় পর্যায়ে ধারাবাহিক গণসমাবেশের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে বিএনপি। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের সমাবেশ দিয়ে শুরু হওয়া এ কর্মসূচির আটটি সমাবেশ এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীর পর বাকি থাকবে শুধু ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ।

সফলভাবে বিভাগীয় পর্যায়ে আটটি সমাবেশ করে বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন দারুণ চাঙা, কেন্দ্রীয় নেতারাও আত্মবিশ্বাসী। বিশেষ করে বিএনপির সাথে জনগণের সম্পর্ক নেই, তারা রাজপথে আন্দোলন করতে পারে না; এমন অভিযোগ করার সুযোগ আর নেই। বিভাগীয় সমাবেশের সুবাদে দেশজুড়ে বিএনপির নেতাকর্মী এবং তাদের সমর্থক সাধারণ মানুষের মধ্যেও দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলনে নামলেও তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড়। তবে আন্দোলনের সুবাদে পাওয়া আত্মবিশ্বাস তাদের নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করে কি না, সেটার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে দেশজুড়ে সফলভাবে বিভাগীয় সমাবেশ করতে পারার পর নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে দেশে-বিদেশে বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সময় আছে। আপাতত সবার মনোযোগ ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ ঘিরে।

শুধু মনোযোগ বললে ভুল হবে, ১০ ডিসেম্বর ঘিরে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা ও টানাপোড়েন চলছে। উত্তেজনার দায়টা বিএনপিকে নিতে হবে। কর্মসূচি ঘোষণার সময়ই বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান হুঙ্কার দেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে। এরপর বিএনপির আরও কয়েকজন নেতাও একই ধরনের কথা বলেন। কেউ কেউ তো ১০ ডিসেম্বর নেতাকর্মীদের তারেক রহমানকে বরণ করতে ফুলের মালা নিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকার আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন।

১০ ডিসেম্বর কোনো নির্বাচন হবে না, একটি সমাবেশ হবে মাত্র। কিন্তু সমাবেশের মাধ্যমে কীভাবে সরকার পতন হয়ে যাবে, কীভাবে দণ্ডিত খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে, কীভাবে দণ্ডিত তারেক রহমান দেশে ফিরবেন; তার কোনো ব্যাখ্যা বিএনপি নেতারা দেননি। তবে আশার কথা হলো, মাঝারি সারির নেতাদের এই আস্ফালনে সায় মেলেনি বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। তারা বরং সরকারকে আশ্বস্ত করতে চাইছেন, ১০ ডিসেম্বর তারা ঢাকায় একটি সমাবেশ করবেন মাত্র। সরকারকে বিপাকে ফেলার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন ঘোষণা আসতে পারে।

বিএনপি নেতারা এখন কিছুটা পিছিয়ে এলেও তাদের হুমকিকে সিরিয়াসলি নিয়েছে সরকার। হেফাজতের মতো বিএনপিও সমাবেশের নামে রাজপথে অবস্থান নিতে পারে, রাজপথ দখলের মাধ্যমে সরকার পতনের ডাক দিতে পারে। এ কারণে আগে থেকেই সরকার সতর্ক। সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার আগে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন দেখার কথা বলেছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

আওয়ামী লীগ সেদিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পাহারা বসানোর কথা বলেছে। এটা ঠিক, বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে মাঠে নেমে পড়ায় আওয়ামী লীগও পাল্লা দিয়ে মাঠে নেমেছে। সভা-সমাবেশ, সম্মেলন নানা কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগও জনসমাগম দেখাতে চাইছে। বিএনপির সমাবেশে যেমন লোকসমাগম হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সমাবেশেও হচ্ছে।

গত ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরের জনসভা থেকে কার্যত নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। করোনার কারণে প্রধানমন্ত্রী অনেকদিন গণভবনের বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। অধিকাংশ কর্মসূচিতে তিনি ভার্চুয়ালি যুক্ত হতেন। করোনার প্রকোপ কমে আসায় ঢাকায় নানা কর্মসূচিতে সশরীরে যোগ দেওয়া শুরু করলেও যশোরের সমাবেশটি ঢাকার বাইরে প্রথম। যশোরের বিশাল সমাবেশ আওয়ামী লীগকেও আত্মবিশ্বাসী করবে। আগামী ৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। সেখানেও বিশাল সমাবেশের প্রস্তুতি চলছে। দেশের বড় দুটি দলই জনগণের কাছে যাচ্ছে, জনসমাগমে পাল্লা দিচ্ছে; এটা ভালো কথা। কিন্তু বিএনপির সমাবেশের দিনই ঢাকায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পাহারা বসানোর পরিকল্পনা সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সারাদেশে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পর ঢাকায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করাটা শুভ হবে না।

তবে ১০ ডিসেম্বরের সব উত্তেজনা এখন সমাবেশের ভেন্যুকে ঘিরে। কোথায় হবে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ? বিএনপি নয়াপল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনেই সমাবেশ করতে চায়। তবে সরকারি দল কোনোভাবেই রাজপথে তাদের কর্মসূচি করতে দিতে রাজি নয়। সরকার এখন বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু তাতে রাজি নয় বিএনপি।

সরকারি দলের প্রাথমিক অবস্থান ছিল, বিএনপিকে ঢাকার মধ্যে সমাবেশ করতে না দেওয়া। সরকারি দলের পরামর্শ ছিল মিরপুর, টঙ্গী ইজতেমা মাঠ বা পূর্বাচল। সরকারি দলের নেতারা বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো করেই সমাবেশ টঙ্গী বা পূর্বাচলে নেওয়ার কথা বলছিল। বিভিন্ন আয়োজনে বিএনপি নেতারা ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ লোকের সমাবেশ করার কথা বলছিলেন। সরকারি দলের নেতাদের যুক্তি হলো, ১০ লাখ লোকের সমাবেশ করার মতো কোনো ভেন্যু ঢাকার ভেতরে নেই।

বিএনপি যদি সত্যি বড় সমাবেশ করতে চায়, তাহলে তাদের বড় ভেন্যু দরকার। সে কারণেই তারা টঙ্গী বা পূর্বাচলকে বেছে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু মুখে যতই বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী সাজুক, সরকারি দলের নেতাদের আসল কৌশল ১০ ডিসেম্বরের উত্তেজনাকে ঢাকায় ঢুকতে না দেওয়া। তবে বিএনপি যেমন ‘১০ ডিসেম্বর সরকারকে বিপাকে ফেলার কোনো পরিকল্পনা নেই’ বলে কিছুটা পিছিয়ে এসেছে; সরকারি দলও ঢাকার বাইরের বদলে ঢাকার ভেতরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে দিতে চাইছে।

কিন্তু বিএনপি এখনও নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা আশা করছেন, সরকার নয়াপল্টনেই তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেবে। একসময় ঢাকায় বড় সমাবেশ হতো পল্টন ময়দানে। ঐতিহ্যবাহী পল্টন ময়দান এখন খেলার মাঠ হয়ে গেছে, জনসভা করার জায়গা নেই।

বিভিন্ন সময়ে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ, পান্থপথ, এমনকি প্যারেড গ্রাউন্ডেও জনসভার আয়োজন হয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ যাতে কম হয়, তাই রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশে না করার চেষ্টা ছিল। তবে অনেকদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং বিএনপি নয়াপল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনেই নিজেদের কর্মসূচি পালন করে আসছে।

এটা আসলে একটা কমফোর্টেরও ব্যাপার। তবে নয়াপল্টনে সমাবেশের ব্যাপারে বিএনপির অনড় থাকার অনেকগুলো কারণ আছে। অভ্যস্ততা তো আছেই, চাইলে সমাবেশটি পশ্চিমে কাকরাইল থেকে পূর্বে আরামবাগ পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তবে বিশাল সমাবেশে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে রাজপথ বন্ধ থাকলে তা বিশাল জনভোগান্তির কারণ হবে। তারচেয়ে বড় কথা বিএনপি নয়াপল্টনের আশপাশে ২০-২৫টি আসা-যাওযার পথ আছে। তাই মানুষ সহজেই আসতে পারবে। আর কোনো সংঘর্ষ হলে সহজে পালাতে পারবে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধলেও অনেকক্ষণ তা চালিয়ে নিতে পারে।

তাছাড়া বেশি বিপদ হলে অনেকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও আশ্রয় নিতে পারেন। তাই তারা নয়াপল্টনের ব্যাপারে অনড়। তবে সরকারি দল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ব্যাপারে সিরিয়াস। এখানে সরকারের সুবিধাটা হলো, বিএনপিকে তাদের কমফোর্ট জোন থেকে বের করে আনা। তারচেয়ে বড় কথা হলো, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশপথ মাত্র দুটি। ফলে বিএনপির সমাবেশ মনিটর করা এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের জন্য সহজ হবে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চাইলেও বিএনপির পক্ষে কোনো ঝামেলায় জড়ানো সম্ভব হবে না। কারণ সমাবেশে কার্যত তারা বন্দি থাকবেন। আর নয়াপল্টনের মতো সমাবেশকে আশেপাশের রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। তারচেয়ে বড় কথা হলো, ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে সমাবেশ করা বিএনপির জন্য একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপও বটে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে না চাওয়ার ব্যাপারে বিএনপি আবার আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী বনে গেছে। যুবলীগের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ১১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় সমাবেশ হয়। সে উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল মঞ্চও বানানো হয়েছে। সেই মঞ্চেই আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নানা কর্মসূচি বা জাতীয় সম্মেলন চলছে।

আগামী ২৪ ডিসেম্বর হবে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। মাঝে ৮ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন ছাড়াও ১৫ ডিসেম্বর যুব মহিলা লীগের সম্মেলন। তাই বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগের আয়োজনে ভাগ বসাতে চায় না। তাছাড়া ৮ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলন হলে বিএনপি তাদের সমাবেশের মঞ্চ তৈরি ও অন্যান্য প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় পাবে না। তবে সরকারি দল বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করতে দিতে চায়। সে কারণে এরই মধ্যে ছাত্রলীগের সম্মেলন দুদিন এগিয়ে ৬ ডিসেম্বর পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে ছাত্রলীগের সম্মেলনের পরও বিএনপি প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় পায়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা মাঠে বা পূর্বাচলে সমাবেশ করার কথাও বলা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত এসেছেন, পল্টন পর্যন্তও আসবেন।’ সত্যিই সরকার পল্টন পর্যন্ত আসবে নাকি বিএনপিকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে হয়, সেটা দেখার জন্য আরও দুয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে।

২৭ নভেম্বর, ২০২২

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন