ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আদরের সন্তানরা দেশের সম্পদে পরিণত হোক

মাহমুদ আহমদ | প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ১১ নভেম্বর ২০২২

সম্প্রতি একটি সংবাদ আমাদের জন্য নতুন করে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘জঙ্গিবাদে জড়িয়ে অনুশোচনায় কাঁদলেন কেবিন ক্রু, কাঁদালেন সবাইকে।’ (৯ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে কান্না করতে করতে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে এমিলি বলেন, ‘আব্বু… তুমি যদি আমার মেসেজ পেয়ে থাকো, তাহলে বলছি তুমি চরম ভুল পথে আছ। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো মাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না, বিশৃঙ্খলা করবে না। আমি অনুরোধ করছি তুমি আত্মসমর্পণ করো।’

জন্মের পর থেকে শিশু তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শিখতে শুরু করে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে ও বংশগত ভাবে কতগুলো বিষয় শিশুর মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। বিশেষ করে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় মাতার অনেক আচরণ ও আমল শিশুর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু সাধারণ অর্থে শিক্ষার যে সংজ্ঞা, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, জন্মের পর একটি সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে শিক্ষা।

মানুষকে নীতিবান ও বিবেকবান করে তোলে শিক্ষা। এ কারণে আগে যে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল তা ছিল গুরুগৃহে অবস্থানপূর্বক শিক্ষা লাভ করা। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গুরুগৃহে অবস্থান করতে হতো। শিক্ষাগুরু শিক্ষার্থীকে দৈনন্দিন শিষ্টাচার, ধর্মীয় শিক্ষাসহ জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিতেন। প্রাচীন ভারতেও এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শিক্ষার্থী শিক্ষাগুরুর শিষ্যত্ব লাভ করে সাহচর্যে থেকে বিভিন্ন শাস্ত্রে পান্ডিত্যসহ চরিত্র গঠন, আদব-কায়দা ও ধর্মীয় শিক্ষা লাভের সুযোগ পেত। গুরুগৃহে শিষ্যের অবস্থানের মেয়াদ ছিল ৫ বছর থেকে ১০-১৫ বছরকাল। তখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা খুবই কম ছিল। থাকলেও প্রথমে গুরুগৃহে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো।

তাই দেখা যায় বড় বড় মনিষীরা ও জ্ঞানীগুণী পন্ডিতরা যারা গত হয়েছেন তারা কোনো না কোনো গুরুর শিষ্য হয়ে জ্ঞান লাভ করেছেন। অনেক সময় দেখা গেছে যে শিষ্য গুরুকে ছাড়িয়ে গেছেন। তবে এ পদ্ধতিতে শিক্ষা লাভ করাকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষালাভ করা হয় বলে ধরা যায় না। ইসলাম এ পদ্ধতিকে সমর্থন করে না। কারণ এ পদ্ধতিতে শিক্ষালাভ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়, কেবল বিত্তবান, সামর্থ্যবান এবং কোনো জ্ঞানপিপাসুরাই এভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারতো। এতে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ শিক্ষা লাভের সুযোগ পেত, সিংহভাগ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতো কিন্তু ইসলামই সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা দিয়েছে।

ইসলাম জ্ঞান আহরণের জন্য বিভিন্ন স্থানে গমনপূর্বক শিক্ষালাভকে একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে; তবে একে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা বলা হয় না। কেননা আল্লাহতাআলা সন্তানের জন্য পিতা-মাতাকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং তার পক্ষ থেকে পৃথিবীতে পিতা-মাতা হলেন তাদের নিজ নিজ সন্তানদের অভিভাবক। কাজেই জন্মের পর থেকে পিতা-মাতাই হলো সন্তানের শিক্ষাগুরু।

আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থাও ইসলাম কায়েম করেছে। এতে গুরুগৃহে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও পরিবারই সে যান্ত্রিক যুগে কীভাবে একটি শিশু ছোটবেলা থেকে শিক্ষা লাভ করে একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে সে বিধিবিধান বা নিয়ম-কানুন কোরআন এবং রাসুল করিমের (সা.) সুন্নাহর মধ্যে নিহিত রয়েছে।

এক্ষেত্রে ইসলাম পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। পুঁথিগত বিদ্যা অর্থাৎ তোতাপাখির মতো মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সনদ বা সার্টিফিকেট পাওয়া যায় বটে কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে যদি তার প্রতিফলন না ঘটে তবে সে শিক্ষার কোনো মূল্যই থাকে না। ‘শিক্ষা’র অর্থ হলো ‘আলো’। কাজেই যে শিক্ষা বা আলো অন্ধকার অর্থাৎ সব প্রকার অজ্ঞতা দূর করতে ব্যর্থ হয় সে শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করা আর না করা একই সমান। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত প্রবাদ বাক্যটির কথা, যেমন- ‘বে আদবের লেখাপড়া যেমন সাপের ফণা ধরা’।

প্রবাদ বাক্যটি দ্বারা এটাই প্রতিপন্ন হয় যে, বেআদব কোনো শিক্ষার্থী লেখাপাড়া শিখে বড় মাপের একজন শিক্ষিত জঙ্গিরূপে পরিণত হয়। সে সমাজের কোনো উপকারে আসে না বরং সমাজ তার দ্বারা কলুষিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ আদব-কায়দা, মান-মান্যতা ও শিষ্টাচার বিবর্জিত শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি সত্যিকার মানুষ বলে গণ্য নয়। সে বিবেক-বিবেচনাহীন ও একগুয়েমি স্বভাবের হয় বলে কেউ তাকে ভালোবাসে না, শ্রদ্ধা করে না এবং তার প্রতি কারও কোনো আস্থা থাকে না। তাই সে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নামের অযোগ্য বলে সে আল্লাহতাআলার কাছেও অপছন্দনীয়। কাজেই সত্যিকার শিক্ষা বলতে যা বোঝায় তা একমাত্র ইসলামই প্রদান করেছে। সুশীল সমাজও শ্রেষ্ঠ জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের বিকল্প আর কিছু নেই।

হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে শিশুর শিক্ষা শুরু হয় মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায়।’ শিশু বিজ্ঞানীরাও একই মত পোষণ করেছেন। এ সময়ে মায়ের আমল, চিন্তাভাবনা, ধর্মপরায়ণা ও সুষম খাদ্যগ্রহণ ইত্যাদি সব কিছুই গর্ভের সন্তানের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে এবং তা শিশুর সঠিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই এ সময় মাতাকে বিশেষ সচেতন থাকতে হয় এবং নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। কারণ অসৎ আমল, কুচিন্তা, ধর্মহীনতা ও অসম খাদ্য গ্রহণ দ্বারা সুস্থ ও পবিত্র শিশু জন্মলাভ করতে পারে না।

রাসুল করিম (সা.) তাই বলেছেন, ‘সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই তার তরবিয়ত অর্থাৎ চরিত্র গঠন শুরু করা উচিত।’ জন্মের পর শিশুর শিক্ষা পরিবারের আওতাভুক্ত থাকে। পরিবার ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভালো হলে শিশুর শিক্ষাও সঠিক এবং সুন্দর হয়। এখানে শিশুর শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকাই প্রধান। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আগে গৃহের পরিবেশই হলো শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন, যেখানে শিশুর সত্যিকার স্তম্ভ গঠিত হয়।

শিশুকে আদর্শ ও দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়া তোলার পেছনে পিতা-মাতার ভূমিকাই সর্বাগ্রে। তাই আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদের বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেই। সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলি যেন সে কারও জন্য ক্ষতির কারণ না হয়। আমাদের সন্তানরা কোনোভাবেই বিপথে যাবে না বরং প্রত্যেকটি সন্তান সুসন্তান হবে এবং দেশ ও জাতির জন্য সম্পদে পরিণত হবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: গবেষক, ধর্মীয় চিন্তাবিদ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন