ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রম্য

অল্পের জন্য রক্ষা হইছে!

মোকাম্মেল হোসেন | প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ২১ অক্টোবর ২০২২

রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে নৈমদ্দির ডেরায় গিয়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন ইসব মাতবর। গ্রামে ফিরে নৈমদ্দির হাল-হকিকত এবং তার মেজবানির গল্প অনেকবার অনেকের কাছে করেছেন। সেই নৈমদ্দি যখন হঠাৎ গ্রামে ফিরে এলো এবং ঘোষণা দিল-সে আর শহরে ফিরে যাবে না; তখন ইসব মাতবর অবাক হলেন। নৈমদ্দিকে একদিন কাছে পেয়ে ইসব মাতবর বললেন-

: শহরে তো বেশ ভালাই আছিলি!
: তা আছিলাম।
: সব ছাইড়া-ছুইড়া আইসা পড়লি যে!
: সরকার বস্তি ভাইঙ্গা দিল!
: ক্যান?
: নানান অভিযোগ, এর মধ্যে প্রধান অভিযোগ হইল ফেনসিডিল-ইয়াবার বেচাকেনা লইয়া।
: বস্তিতে কি ফেনসিডিল-ইয়াবার কারখানা ছিল?
: না। এইগুলা তো দেশের বাইরে থেইক্যা আসে।
: তাইলে বস্তি ভাইঙ্গা কোন ফায়দা? কান খোঁচাইলে কি দাঁত পরিষ্কার হয়? দাঁত পরিষ্কারের জন্য দাঁতমাজার প্রয়োজন পড়ে। ফেনসিডিল-ইয়াবা তো আর আসমানের মেঘ না, বস্তির ওপর আইসা টুপ কইরা বৃষ্টি হইয়া ঝইরা পড়ে!
: যার যেমন বুঝ; দাড়ির কাইট্যা রাখে মোচ!
: এখন কী করবি?
: গরু-ছাগল একটা কিছু লইয়া নড়াচড়া করার নিয়ত করছি।

অষ্টধার বাজারে প্রতি মঙ্গলাবার গরু-ছাগলের হাট বসে। নৈমদ্দি তার জমানো টাকা দিয়ে দুটো এঁড়ে বাছুর ও কয়েকটা ছাগল কিনবে বলে ঠিক করেছিল। বাজারে যাওয়ার পর সে দেখল, বাছুরের দাম অত্যধিক চড়া। তাই বাছুরের দিকে হাত না বাড়িয়ে ছাগল কিনে ফেলল কয়েকটা।

ছাগল লালন-পালন ভালোই চলছিল। একদিন জরুরি কাজে বিদ্যাগঞ্জ গিয়েছিল নৈমদ্দি। ফিরে এসে দেখে প্রতিবেশী সুরুজ মিয়ার সঙ্গে তারাবানুর তুমুল ঝগড়া চলছে। কিছুক্ষণ উভয়পক্ষের কথাবার্তা শোনার পর নৈমদ্দি সুরুজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করল-

: কী হইছে?
: তোমার ছাগলের পাল আমার পাটক্ষেতের বারোটা বাজাইয়া দিছে!
: ছাগলে পাটগাছ খাইছে?
: খাইছে মানে? ছাগল হইল পাটগাছের রাক্ষস। আগায় ধইরা টান দিয়া গোড়ায় গিয়া থামছে।

সুরুজ মিয়ার হাতেপায়ে ধরে বিষয়টার সুরাহা হলেও কিছুদিন পর আর মুখের কথায় কাজ হল না, পকেটে টান পড়ল। আবুল মিয়ার পানবরজের বেড়া ভেঙ্গে পানগাছ সাবাড় করার অভিযোগে ছাগলগুলোকে সে খোঁয়াড়ে চালান করে দিল। প্রতিটি ছাগলের জন্য ২৫০ টাকা করে জরিমানা দেয়ার পর খোঁয়াড় থেকে ছাগলগুলো মুক্ত করা সম্ভব হল। এরও কিছুদিন বাদে নতুন যন্ত্রণার মুখোমুখি হল নৈমদ্দি। রাতে একটা ছাগল চেঁচিয়ে তার ঘুম হারাম করে দিল। বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে নৈমদ্দি তার স্ত্রী তারাবানুকে বলল-

: এইটা এত ব্যাঁ-ব্যাঁ করতেছে কী জন্য?
তারাবানু চোখ বড় করে বলল-
: কী জন্য ব্যাঁ-ব্যাঁ করতেছে, বুঝেন না? ছাগল লইয়া খামারের বাজারে যান। এইটারে পাল-খাওয়ানির সময় হইছে।

পরদিন ভোরে চোখ কচলাতে কচলাতে ছাগল নিয়ে খামারের বাজারে হাজির হল নৈমদ্দি। এরপর যা শুনল, তাতে ওর মাথায় হাত। সে শুনল-এখানে যে দুই ব্যক্তি পাঁঠা রাখতেন, তাদের একজন মারা গেছেন। আর অন্যজন পেশা বদল করেছেন। হতাশ হয়ে ফেরার সময় এক ব্যক্তি নৈমদ্দিকে ঝাপারকান্দা গ্রামের সামছু মগুলের বাড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দিলে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-

: মুসলমান পাঁঠা রাখে?
নৈমদ্দির কথা শুনে লোকটি বিজ্ঞের মতো বলল-
: যাদের এই কাম করার কথা, তারা যদি তা না করে, তাইলে অন্যদের না কইরা উপায় আছে?
নৈমদ্দি লোকটার যুক্তি মেনে নিয়ে ঝাপারকান্দা গ্রামে গিয়ে সামছু মণ্ডলের বাড়িতে উপস্থিত হল। বয়স্ক এক লোককে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল-
: মণ্ডলসাব কি বাড়িতে আছেন?

সারারাত চেঁচিয়ে ছাগলের গলার স্বর বদলে গিয়েছিল। ছাগলটি এখন আর ব্যাঁ-ব্যাঁ করছিল না; চ্যাঁ-চ্যাঁ করছিল। লোকটি বাড়ির উঠানে চ্যাঁ-চ্যাঁরত ছাগলসহ নৈমদ্দির উপস্থিতি দেখে অবাক হয়ে বলল-
: আমিই সামছু মণ্ডল। বিষয় কী?
নৈমদ্দি তার চাহিদা পেশ করল। শুনে সামছু মণ্ডল বললেন-
: আপনে একটু দাঁড়ান। আমি বাড়ি ভেতর থেইক্যা পাঁঠা আনতেছি।
পাঁঠা আনার কথা বলে সামছু মণ্ডল ইয়া বড় এক রামদা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হল। নৈমদ্দি দেখল, জান বাঁচানো কঠিন। সে ছাগল ফেলেই দৌড় দিল। নৈমদ্দিকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দেখে একজন গ্রামবাসী জিজ্ঞেস করলেন-

: কী হইছে ভাই! এইভাবে কাছা খুইল্যা দৌড় দিছেন ক্যান?
নৈমদ্দি হাঁপাতে হাঁপাতে সবকিছু খুলে বলার পর তিনি বললেন-

: ভাই, অল্পের জন্য রক্ষা হইছে! সামছু মণ্ডল পাঁঠা রাখবে কোন দুঃখে? তার কী টাকা-পয়সার অভাব আছে? আসলে ঘটনা হইল-মণ্ডলের বউ মারা যাওনের পর সে চল্লিশ দিনও পার হইতে দেয় নাই, তার আগেই আবার বিয়া করছে। এই জন্য এলাকার মানুষ আড়ালে তারে পাঁঠা বইল্যা ডাকে।

নৈমদ্দিকে খালিহাতে বাড়ি ফিরতে দেখে তারাবানু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-
: ছাগল কই!
নৈমদ্দি স্ত্রীর কাছে সত্য গোপন করল। রহস্য করে বলল-
ছাগল পালে পাগলে
হাঁস খাইল শিয়ালে।
আমি এখন ঢুকি কোন গোয়ালে?
ছাগলের যন্ত্রণায় তারাবানু অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে দেখল, এই সুযোগ। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল-
: আপনে আগের গোয়ালেই ঢুকেন।
এরপর নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে তারাবানু ছড়া কাটল-
যদি পড়ে কহর।
তবুও না ছাড়িও শহর।

অনেক চিন্তা-ভাবনার পর শহরে ফিরে যাওয়াই সাব্যস্ত করল নৈমদ্দি। ঈদ-পার্বণে এসে ইস্ত্রি করা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নৈমদ্দি যে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছে, এখন সে গ্রামেই পরের বাড়িতে কামলা খেটে দিন গুজরান করা তার কাছে মারাত্মক অপমানের ব্যাপার বলে মনে হল। তাই একদিন ভোরের ট্রেনে গ্রাম ছেড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সে রাজধানীতে ফিরে এলো। রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ বস্তিতে নৈমদ্দির পূর্বপরিচিত আরজ আলী থাকে। নৈমদ্দি আরজ আলীর সামনে দাঁড়িয়ে আরজ করল-

: মহাজনরে বইল্যা আমারে একটা রিকশা লইয়া দেও।
আরজ আলী মুখ বেঁকিয়ে বলল-
: ঢাকা শহরে রিকশা চালাইয়া আগের মতো জুৎ নাই। সব মেইন রোডে রিকশা চলাচল বন্ধ, অথচ রিকশার জমা বাড়াইছে কয়েকগুণ। সবচাইতে বড় সমস্যা হইল জ্যামের সমস্যা। জ্যামে একবার পড়লে কর্ম সাবাড়। শরীলের হাঁড়গোড় সব গোল হইয়া যায়।

: তাইলে পাবলিক আপ-ডাউন করে কেমনে?
: কুয়ার ব্যাঙের মতন প্যাচাপেচি আর গুতাগুতি কইরা কোনোরকমে চলে আর কী! আমার নিজের কথা শুনলে তো তুই দৌড় দিবি। আমি সারাদিনে যা কামাই করি, চাইলডাইল কিননের পর পকেটে বিড়ির পয়সাও থাকে না।
: মসিবত!
: খালি মসিবত না, মহামসিবত।
: তাইলে এখন করমু কী!

: ঠ্যাঙ্গে চটের ছালা প্যাচাইয়া ফার্মগেইট ওভারব্রিজে একটা থালা সামনে লইয়া বইসা পড়। প্রচুর ইনকাম। ঢাকা শহরের ফকির-মিসকিনরা ঠ্যাঙ্গের ওপর ঠ্যাঙ্গ তুইল্যা একদিনে যা কামাই করে, আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেইল্যা দশদিনেও তা কামাই করবার পারি না।

মুখে যাই বলুক, আরজ আলী নৈমদ্দির জন্য একটা রিকশার বন্দোবস্ত করল। সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতে আরজ আলীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর নৈমদ্দি বলল-

: ঢাকা শহরের অনেক পরিবর্তন হইছে; সৌন্দর্যও বাড়ছে!
: এই সৌন্দর্য দেইখ্যাই তুই অস্থির হইয়া গেলি? এয়ারপোর্ট রোডের সৌন্দর্য দেখলে তো খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুইল্যা যাবি!
: তাইলে চল, আজই যাই।
: আজই যাবি?
: হ।

আরজ আলী নৈমদ্দিকে নিয়ে বাসে চড়ল। কুড়িল ফ্লাইওভার পার হওয়ার দুজন বাস থেকে নেমে পড়ল। এখান থেকেই সৌন্দর্যের সূচনা। হাঁটতে হাঁটতে বিমানবন্দর অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল আরজ আলী ও নৈমদ্দি। শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে আসার পর আরজ আলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নৈমদ্দি বলল-

: ছাতির মতন চারপাশে ডালপালা ও লতা ছড়াইন্যা এত পুরাতন একটা গাছ কাইট্যা ফেলতেছে ক্যান!
: বিদেশ থেইক্যা আমদানি করা লাখ টাকা দামের টুইন্যা গাছ লাগানোর জন্য।
আরজ আলীর কথা শুনে কৌতূহলী ভঙ্গিতে নৈমদ্দি বলল-
: টুইন্যারা পরে পুইন্যা হইয়া যাবে না তো!
নৈমদ্দির প্রশ্ন শুনে আরজ আলী বিজ্ঞের মতো বলল-

: যারা এইখানে সৌন্দর্য রচনা করতেছেন, এইটা সেইসব বড় বড় মাথাওয়ালা আর ভুড়িওয়ালাদের বিষয়। তর-আমার বিষয় না। টুইন্যার পরে পুইন্যা হবে। পুইন্যার পরে মইন্যা হবে। এইভাবে চলতেই থাকবে। এইসব বাদ দে। তুই আমারে ক’, কেমন লাগতেছে?

: মারাত্মক সৌন্দর্য!
এয়ারপোর্ট পার হওয়ার পর নৈমদ্দি হঠাৎ ক্ষীণস্বরে আরজ আলীকে বলল-
: ক্ষিদা লাগছে।
আরজ আলী অবাক হয়ে বললেন-
: কস কী!
: হ। খুব ক্ষিদা লাগছে।
: এইখানে আসার আগে তরে জিগাইলাম- খাওন-দাওন করবি কিনা, তখন তো বললি, কিছু খাবি না! এখন খাওয়ার কথা বলতেছস কীজন্য?
আরজ আলীর কথার উত্তর দিতে গিয়ে বিষণ্ণ গলায় নৈমদ্দি বলল-

: তুমি যখন বললা, সৌন্দর্য দেখলে খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুইল্যা যাবি, তখন ভাবলাম-বিষয়টা পরীক্ষা কইরা দেখি। তোমার কথা যদি সত্য হয়, তাইলে আমার পরিচিত যত অভাবী মানুষ আছে, সবাইরে যাইয়া বলব-চিন্তার কুনু কারণ নাই। ঢাকা শহরে এমন এক সৌন্দর্যের জন্ম হইছে, যেইটা দেখলে খাওন-দাওনের প্রয়োজন পড়ে না; অটোমেটিক পেট ভইরা যায়। তাই আমি তোমারে খামু না কইছিলাম; কিন্তু ভাই- এখন দেখতেছি, সৌন্দর্যে পেট ভরে না!
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।

[email protected]

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন