সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ
নারীর জয় তবু রাষ্ট্র নারীবান্ধব নয়!
নহ কন্যা, নহ জায়া, নহ জননী, নহ চৌকাঠ জুড়ে থাকা কোনো ঘরণী। সত্যি নারীকে এখন আর কোনো গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। নারী তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের এমন কোনো বিষয়বস্তু নেই যেখানে নারী তার সাফল্যের পদচিহ্ন অঙ্কন করেনি। আজকের পৃথিবীর নারীরাই পারে মাটিতে ভর করে দাঁড়িয়ে আকাশ আগলে রাখতে। বাংলাদেশের নারীরাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের নারীরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ লাল-সবুজের পতাকা ওড়ালেন। ক্রীড়াঙ্গনে ব্যর্থতার গল্প শুনতে শুনতে ক্লান্ত জাতিকে তারা ভাসিয়েছেন জয়ের আনন্দে।
তবে তাদের এই যাত্রার পথটি কিন্তু মসৃণ ছিল না। পদে পদে পোহাতে হয়েছে বিড়ম্বনা। ধর্মান্ধ আর মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রতিটি পদে পদে তাদের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে নারী ফুটবলারদের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে।
ছুটি পেয়ে লোকাল বাসে বাড়ি যাওয়ার সময় হেনস্তা হতে হয়েছিল সেই দলে থাকা সানজিদা-তহুরাসহ ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের ৯ ফুটবলারকে। বাসের অন্য যাত্রীদের কয়েকজন বিশ্রী ভাষায় তাদের গালি দেয় বলে তারা জানিয়েছিল। এই নারীদের পোশাককে কেন্দ্র করে চূড়ান্ত নোংরামি করেছিল কিছু মানুষরূপী জানোয়ার। বলতে দ্বিধা নেই সেই জানোয়ারদের নোংরামিতে সায় দিয়েছিল কিছু নারীকূলে জন্ম নেওয়া কুলাঙ্গার।
এত প্রতিকূলতা নারীকে সহ্য করতে হয়েছে কারণ রাষ্ট্র নারীবান্ধব নয়। রাষ্ট্র নারীবান্ধব নয় বলেই নারী ফুটবলাররা যে বেতন পান তা একজন পুরুষ ফুটবলারের তুলনায় এতই কম যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ‘এ’ ক্যাটাগরির ফুটবলারদের মাসিক বেতন ১২ হাজার টাকা। ‘বি’ এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির যথাক্রমে ১০ হাজার এবং ৮ হাজার টাকা। রাষ্ট্র নারীবন্ধব নয় বলেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও নারীর স্বাধীনতার প্রশ্নে , নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নে সমাজের গাত্রদাহ শুরু হয়।
যে দেশে মহাসমারোহে নারী দিবস পালিত হয় সেই দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়, সামাজিক গণমাধ্যমে নারীকে নিয়ে ট্রল করা হয়, বডি শেমিং করা হয় এমনকি মূলধারার গণমাধ্যমেও বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে নারীকে আপত্তিকর ভাবে উপস্থাপন করা হয়।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে বাংলাদেশে নারীদের সম্মানে এই নারী দিবস পালিত হয় সেই বাংলাদেশের নারীরা কেমন আছে? পরিসংখ্যান কী বলে– মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, বিদায়ী বছরটিতে ৬২৯টি কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ১৮ জন। এছাড়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬২টি কন্যাশিশুসহ ১৭৯ জন। ২২টি কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩১ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। এছাড়া ৯৩টি কন্যাশিশুসহ ১৫৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০২১ সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও কন্যাশিশু হত্যার শিকার যেমন হয়েছেন, তেমনি নানা কারণে আত্মহত্যাও করেছেন অনেকেই। এর মধ্যে অনেকেই উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
গত বছরের তথ্য বলছে, বিভিন্ন কারণে ১১৪টি কন্যাশিশুসহ ৪৪৪ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অক্টোবর মাসে সবচেয়ে বেশি ৫১ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে এই সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন ১২ জন। এছাড়া ২০২১ সালে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমবেশি একইরকম ছিল। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৪১ জন, মার্চে ৪৯ জন, এপ্রিলে ৪০ জন, মে মাসে ৪১ জন, জুনে ৩৮ জন, জুলাইয়ে ২৮ জন, আগস্টে ৩০ জন, সেপ্টেম্বরে ৪৩ জন, নভেম্বরে ৩৯ জন ও ডিসেম্বরে ৩২ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
এছাড়া ১৯টি কন্যাশিশুসহ ৮৭ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া ১৩১টি কন্যাশিশুসহ ৪২৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে গত বছর। একই সময়ে ৫৮টি কন্যাশিশুসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। ৩২টি কন্যাশিশুসহ ৪৬ জনকে উত্ত্যক্ত করার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে একটি কন্যাশিশুসহ উত্ত্যক্ত হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুজন। এছাড়া ৪৩টি কন্যাশিশুসহ ১২১ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে গত বছর। আত্মহত্যায় প্ররোচনার ঘটনা ঘটেছে চারটি। পাঁচটি কন্যাশিশুসহ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ১১ জন।
২০২১ সালে বাল্যবিয়ের ঘটনা উদ্বেগ ছড়িয়েছে। ২০২০ সালে ১১৭টি বাল্যবিয়ের তথ্য পাওয়া গেলেও বিদায়ী বছরে বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ৩২৭টি। এর মধ্যে মাত্র ৪৩টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা গেছে। ১৩টি দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে ১৮৫টি। এরপরই নভেম্বর মাসে ৭৪টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে চারটি, ফেব্রুয়ারিতে ১০টি, মার্চে পাঁচটি, এপ্রিলে দুটি, মে মাসে একটি, জুলাই মাসে দুটি ও অক্টোবরে একটি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। জুন, আগস্ট ও ডিসেম্বর মাসে বাল্যবিয়ের ঘটনা কোনো পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি।
মহিলা পরিষদের প্রদত্ত তথ্য বলছে, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর কেবল কিশোরগঞ্জ জেলায়ই ২৬০ মাদরাসাছাত্রীর বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত দেড় বছরে কেবল টাঙ্গাইল জেলায়ই ১ হাজার ২৪২টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। বাল্যবিয়ের পাশাপাশি যৌতুক গ্রহণ ও এ সংক্রান্ত নির্যাতনের ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনক। একটি কন্যাশিশুসহ যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন। এর মধ্যে ৪৫ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে।
লকডাউন ও করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও থেমে ছিল না অপহরণ ও পাচার। ১৫৩টি কন্যাশিশুসহ এ বছর অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৮০ জন। এছাড়া আটটি কন্যাশিশুসহ ১১ জনকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। ছয়টি কন্যাশিশুসহ ৪২ জন নারী ও কন্যাশিশু পাচারের শিকার হয়েছেন। মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে পাঁচটি কন্যাশিশুসহ এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছেন ২২ জন। এর মধ্যে এসিডদগ্ধ হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছেন তিনটি কন্যাশিশুসহ ২৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১০ জন।
এবার আসুন তাকাই একটু আইন অঙ্গনের তথ্য-উপাত্তের দিকে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি থেকে বলা হয়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে শুধু নারী ও শিশু সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা আনুমানিক ১৯ হাজার।
প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে এই কথা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের নারীদের এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। বাংলাদেশের নারীদের নির্যাতন এবং নিপীড়নের এক অদৃশ্য আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। বাংলাদেশের ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার জায়গার মধ্যে এমন এক ইঞ্চি জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে একজন নারী নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে। যাপিত জীবনে এমন একটি সম্পর্ক পাওয়া যাবে না যে সম্পর্কের কাছে নারী নিরাপদ।
পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থা শুধু নারীকে নির্যাতন কিংবা নিপীড়ন করেই থেমে থাকে না। এই নির্যাতনকে কীভাবে জায়েজ করা যায়, কীভাবে একজন নির্যাতনকারীকে বীরোচিতভাবে উপস্থাপন করা যায় তা নিয়ে প্রচেষ্টা চলে অবিরাম। নির্যাতনের শিকার নারীর চরিত্রে কালিমা লেপনের এক কুৎসিত আনন্দে মেতে ওঠে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
উন্নয়নের মহাসড়কের বলতে আমরা শুধু কাঠামোগত উন্নয়নই বুঝি। কাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সাথে মানসিক অবস্থার উন্নয়ন, সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন সেই ধ্রুব সত্য আমরা বেমালুম ভুলে যাই। যে দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। যে দেশের নারীরা পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে এনেছে বাংলাদেশ। যে দেশের জন্মের সাথে রয়েছে বহু নারীর আত্মত্যাগের ইতিহাস। অথচ সেই দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তার দেশের নারীদের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। কত দুর্ভাগা আমরা!
যে দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। যে দেশে নারীরা প্রায় সব উচ্চ পর্যায়ের পদ অলংকৃত করার যোগ্যতা রাখে সেই দেশের নারীদের দাবিয়ে রাখার সাধ্য কারও নেই। শুধু চাই নারী জাগরণের মাধ্যমে সব ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সব প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ এবং এই সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমেও একমাত্র একটি নারীবান্ধব রাষ্ট্র গঠন সম্ভব
লেখক: পিএইচডি গবেষক ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস