ধর্ম
পবিত্র কুরআন: বিশ্ব শান্তির পবিত্র বৃক্ষ
বিশ্বের প্রতিটি মানুষের একটিই আশা-আকাঙ্খা, শান্তিতে বসবাস করা। একটি পরিবারের একজন যদি খারাপ হয় তাহলে গোটা পরিবারেরই শান্তি বিনষ্ট হয়ে যায়। পরিবারের সবাই যদি ভাল হয় তাহলে শুধু নিজ পরিবারই শান্তিতে থাকবে তা নয় বরং আশেপাশে যারা থাকে তারাও শান্তি পাবে। তাই শান্তির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শান্তির এই অভিযাত্রা কিন্তু এক ব্যক্তি সত্তা থেকেই শুরু হয়। এর বীজ মূলত সবচেয়ে প্রথমে মানুষের হৃদয়ে বপন করা হয়। এটি যখন বর্ধিত হয় তখন সেই ব্যক্তির পরিবার শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। এরপর এটি পারিবারিক জীবনকে ছাড়িয়ে শান্তির এই কল্যাণ সমাজে এবং চারপাশে বিস্তার লাভ করে। এর পরবর্তী ধাপ জাতীয় শান্তি ও নিরাপত্তা হয়ে থাকে যা অবশেষে আন্তর্জাতিক শান্তির রূপ ধারণ করে নেয়। এটি কোন ধারণাপ্রসূত ও কাল্পনিক ফরমুলা নয় বরং এটি এমনই সত্য যার প্রকাশ পুরো বিশ্বে দৃষ্টিগোচর হয়। তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে নিজ পরিবার থেকে এর উদ্যোগ নিতে হবে এবং পবিত্র কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। পৃথিবীর সর্বত্র যে অশান্তি বিরাজ করছে এর জন্য আমরা প্রত্যেকেই দায়ী। কেননা, আজ আমরা পবিত্র কোরআনের শিক্ষা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। শান্তির জন্য চাই শান্তির বৃক্ষে আশ্রয় নেয়া আর এ শান্তির বৃক্ষ হচ্ছে পবিত্র কুরআন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক নূর এবং উজ্জ্বল কিতাবও। এর মাধ্যমে আল্লাহ সেসব লোককে শান্তির পথে পরিচালিত করেন, যারা তার সন্তুষ্টির পথে চলে। আর তিনি নিজ আদেশে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং সরলসুদৃঢ় পথে তাদের পরিচালিত করেন’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ১৫-১৬)। পবিত্র কুরআন মজিদ শান্তির বীজ হিসাবে আল্লাহতাআলার অস্তিত্বে পূর্ণ ঈমান আনাকে উপস্থাপন করেছে। এর এর স্পষ্ট প্রমাণ হলো, যারা আল্লাহতাআলার অস্তিত্বে জীবন্ত ঈমান রাখে তারা কখনও অস্থিরতা, অস্বস্তি বা মানসিক চাপের ততটুকু শিকার হয় না যাতে নিজের জীবন সম্পর্কেই নিরাশ হয়ে যেতে হয়। আমরা দেখি, সেসব মনোনীত ব্যক্তি যাদেরকে আল্লাহতাআলা নিজে বেছে নিয়ে নবুয়্যতের মর্যাদায় ভুষিত করে তাদের হৃদয়ে এমন শান্তি ও প্রশান্তি ভরে দেন যে, পার্থিব জগতের শত বিরোধিতা এবং বিপদাপদের ঝড়-তুফান সত্ত্বেও তারা সর্বদা আল্লাহতাআলার আঁচলের সাথে সম্পৃক্ত থাকার ফলে শান্তি ও নিরাপত্তার জান্নাতে জীবন কাটান।
পৃথিবীর ইতিহাসে একজন নবীও এমন অতিবাহিত হন নি যিনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন বা তার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন। যেহেতু তাদের হৃদয় সর্বদাস্থায়ী শান্তি ও স্বস্তির আবাসস্থল হয়ে থাকে, তাই তাদের হৃদয়কে আল্লাহতাআলা সর্বদা আলোকিত রাখেন। প্রত্যেক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সময় রহিম ও করিম খোদার রহমতের ছায়া তাদের মাথার ওপর বিরাজ করে এবং আল্লাহতাআলার ক্ষমতাবলে তাদের তত্তাবধান করেন। কুরআন মজীদ এই মৌলিক বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছে, ‘হৃদয়ে প্রকৃত ও সত্যিকারের শান্তি ও স্বস্তি আল্লাহতাআলার স্মরণেই পাওয়া সম্ভব’ (সুরা রাদ: ২৮)। আর আল্লাহতাআলাকে স্মরণ করার সম্পদ আল্লাহতাআলার সত্তায় পূর্ণ ঈমান বলেই পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, হৃদয়ে যদি আল্লাহতাআলার অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে এবং দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয়ে যায় তাহলে এটিই সেই ব্যবস্থাপত্র যা বিশ্ব শান্তির নিশ্চিত ও সত্যিকার মাধ্যম।
সমাজে বসবাসকারী সকল সদস্যদের সাথে উত্তম আচরণ করা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার আচরণ অবলম্বন করার বিষয়ে মহানবী (সা.) ইসলামি শিক্ষামালার সারাংশ এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে-ই, যার কথা এবং হাত থেকে কোন মানুষ কোনরূপ কষ্ট বা ক্ষতির সম্মুক্ষিন হয় না’ (সুনানে নিসাই, কিতাবুল ঈমান)। এই ভাষ্যে মুসলমান, অমুসলমান, বর্ণ ও জাত বা পূর্বসূরির সম্পর্কের ভিত্তিতে কোন-রূপ তারতম্য করা হয় নি। এই সুপ্রতিষ্ঠিত ভিত্তিতে গড়ে উঠা সমাজ উন্নতি করে জাতীয় শান্তি ও নিরাপত্তার জামিনদার হয়ে যায় এবং অবশেষে যদি বিশ্বের সকল রাষ্ট্র নিজ নিজ স্বার্থের উর্ধ্বে গিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এসব মূলনীতিতে সংঘবদ্ধ হয়ে যায় এবং কুরআনি শিক্ষামালাকে পথ-নির্দেশক বানিয়ে এসব মূলনীতি বাস্তাবায়ন করে তাহলে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলা যায়, বিশ্বশান্তি পুরো বিশ্বের ভাগ্যে অবশ্যই জুটবে।
পবিত্র কোরআন পারস্পারিক সম্মান, ভক্তি ও মর্যাদা প্রদর্শনের বিষয়ে কতই না উত্তম শিক্ষা দিয়েছে, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে যারা ঈমান এনেছো! (তোমাদের) কোন জাতি অন্য কোন জাতিকে উপহাস করবে না। হতে পারে তারা এদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরাও অন্য কোন নারীদের (উপহাস করবে) না। হতে পারে তারা এদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা নিজেদের লোকদের অপবাদ দিয়ো না। আর নাম বিকৃত করে তোমরা একে অন্যকে উপহাস করো না। ঈমান (আনার) পর দুর্নামের ভাগীদার হওয়া অবশ্যই মন্দ। আর যারা অনুতাপ করে না তারাই দুষ্কৃতকারী’ (সুরা হুজরাত, আয়াত: ১২)।
আরেকটি দোষ যা পুরো বিশ্বের শান্তি বিনষ্ট করে রেখেছে তা হলো মিথ্যা ও ভ্রান্ত বর্ণনা। সব শ্রেণিতে এই দোষটি এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, মানুষের স্বভাবে এটি মায়ের দুধের মত মিশ্রিত হয়ে গেছে। এর ফলশ্রুতিতে মানুষের মাঝে এবং জাতিতে জাতিতে পারস্পরিক আস্থা উঠে গেছে। কপটতা এবং প্রতারণা সমাজে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, বড় বড় দেশ গরিব দেশগুলোকে সহমর্মিতার নামে সাহায্য দেয়ার সময় বিভিন্ন শর্তারোপের বাহানায় সর্বদার জন্য তাদেরকে নিজেদের হীন গোলাম বানিয়ে নেয়। এই দোষটি ব্যক্তিগত শান্তি এবং আন্তর্জাতিক শান্তিকে উইপোকার মত কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পবিত্র কোরআন এই দোষকে কঠোরভাবে তিরস্কার করে। আল্লাহতাআলার ভাষ্য, ‘আর সর্বদা সোজা সরল কথা বল’ (সুরা আল হাজ, আয়াত: ৩১)। আমরা যদি পবিত্র কুরআনের শিক্ষামালা অনুযায়ী চলতাম তাহলে পৃথিবীর অবস্থা আজ এমন হত না।
পবিত্র কুরআনের এই নীতি পুরো বিশ্বে শান্তির জন্য এক স্বর্ণালী নীতি। সততার সাথে যদি এর ওপর আমল করা হয় তাহলে এই প্রশ্নই উঠে না যে, কোন রাষ্ট্র অন্য কোন রাষ্ট্রের বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করবে এবং এই বাহানায় তাদের সম্পদের ভাণ্ডার হরণ করবে বা এগুলোকে নিজের করায়ত্বে নিয়ে নিবে।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আল্লাহতাআলা পবিত্র কুরআনে যেসব শিক্ষা বর্ণনা করেছেন এগুলোই শান্তি প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। এতে মুসলমানরাও সম্বোধিত এবং বিশ্বের অন্যান্য লোকেরাও সম্বোধিত। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সত্যিকারের আকাঙ্খী ও আগ্রহী প্রত্যেক ব্যক্তি এসব শিক্ষার সম্বোধিত। বর্তমান যুগের সংকটাপন্ন পরিস্থিতি দাবি করে, পবিত্র কুরআনের এসব শিক্ষামালাকে যদি হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে কার্যে বাস্তবায়ন করা হয় তবেই সারা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার ক্রোড়ে আশ্রয় নিবে।
তাই আসুন! আমরা সবাই সবার স্থানে থেকে সমাজ ও দেশে শান্তির জন্য কাজ করি আর সে কাজ প্রথমে শুরু করি নিজ থেকে।
এইচআর/জিকেএস