পুলিশ : নিপীড়ক না সেবক
“পুলিশ আমার বাপটাকে মারল। আমাদের এখন কী হবে”? এমন আহাজারি রাজুর। রাজু মিরপুরে চাঁদার টাকা না দেয়ায় পুলিশের আগুনে দগ্ধ চা দোকানি বাবুল মাতুব্বরের ছেলে। কিন্তু রাজু জানে না, রাষ্ট্র, তার নেতারা, তার বাহিনী এমন আহাজারি শুনতে প্রস্তুত নয়। এমন আহাজারি আজ শহর, নগর, গ্রামের নানা প্রান্তে।
মানুষের জীবনের মূল্য কত তুচ্ছ জ্ঞান করলে একজন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এমনটা করতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ এটি। আমাদের হয়তোবা শুনতে হবে নিহত চা দোকানি বাবুল পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দিয়েছিল যা ফৌজদারি অপরাধের শামিল। গত বুধবার রাতে রাজধানীর মিরপুরে চাঁদা না পেয়ে পুলিশের ছোড়া তেলের চুলার বিস্ফোরণে চা-দোকানি বাবুল মাতুব্বর দগ্ধ হন বলে অভিযোগ ওঠে। দগ্ধ বাবুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তাঁর শরীরের ৯৫ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল। এবং পরদিন তিনি মারা যান। একটি পরিবার একজন পুলিশ সদস্যের নির্মমতার শিকার হয়ে এখন পথে নিক্ষিপ্ত।
ঘটনার সাথে সাথে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। পুলিশের বাড়াবাড়ি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, অত্যাচারী পুলিশ আমাদের প্রয়োজন নেই। তাই কি আসলে? নাকি এটা কথার কথা? তিনি বলেন, আমরা শুনি, কিন্তু যারা ব্যবস্থা নেবেন, তারা কতটুকু শোনেন তার কথা?
গত কিছুদিনের বেশ কিছু ঘটনা পুলিশ সদস্যরা ঘটিয়েছেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, নিয়ন্ত্রণহীন পুলিশের এখন লাগাম টেনে ধরা দরকার। কথা সত্য, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে?
ক’দিন আগেই গেল পুলিশ সপ্তাহ, ঘটা করে পালিত হয়েছে, অনেক কথা আমাদের শুনতে হয়েছে, যেমন সারাজীবন শুনেছি যে পুলিশ নিপীড়ক নয় জনগণের সেবক। কিন্তু তা কি লক্ষণীয়? কিছু প্রশ্ন সব সময় আলোচনার জন্য উত্থাপিত হয়। পুলিশবাহিনীতে কর্মিসংখ্যা কত হওয়া প্রয়োজন, কর্মী-নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণের পদ্ধতি কী হবে, এবং সেই বাহিনীতে কী ধরনের শৃঙ্খলা প্রয়োজন, কী ধরনের অস্ত্র, এবং আনুষঙ্গিক রসদ প্রয়োজন, গ্রামীণ পুলিশ কী ভাবে কাজ করবে, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বের থেকে তদন্তের দায়িত্বকে কী ভাবে পৃথক রাখা হবে, পুলিশের হাতে কতখানি ক্ষমতা থাকবে এবং তার কর্তব্য কী হবে, কী ভাবে নথি বজায় রাখা হবে, কী ভাবে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির মোকাবেলা করা হবে, এবং পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কী হবে?
এই যে সাধারণ মানুষের সাথে এই বাহিনীর সম্পর্ক, তা কখনোই মধুর হয়নি এদেশে, যদিও বলা হয় পুলিশ জনগণের বন্ধু। সম্পর্কটা এমনই যা ভাগ্যে জুটেছে মিরপুরের চা দোকানির, কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বা সিটি কর্পোরেশনের পরিদর্শকের।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ দমন, সন্ত্রাস মোকাবেলা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পেশাদার, দক্ষ, জনবান্ধ্বব এবং জবাবদিহিমূলক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। বিগত বছরগুলোতে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদস্যরা বড় সাফল্যও দেখিয়েছেন। এবং এ ধরনের কাজ তার জন্য স্বাভাবিক। পুলিশের ভূমিকা মূলত আইনের রক্ষক তথা জনগণের সেবকের। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রে এর বিপরীত।
নাগরিকদের উপর ভয়ংকরভাবে চড়াও হবার নজির আমরা ইদানীং বেশ ঘন ঘন দেখছি। বাংলাদেশে পুলিশ সংস্কার নিয়ে বহু কমিটি, কমিশন তৈরি হয়েছে। মুশকিল হল, সেগুলোর রিপোর্টে শুধু ধুলোই জমেছে।
আমাদের দেশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। সে যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তাদের মনোজগতে কোথায় যেন একটা উপনিবেশিক নিবর্তনমূলক মানসিকতা বিরাজমান। পুলিশ জনগণের সেবক। জনগণের সেবা করাই তার কাজ, এমন কথা বহুবার উচ্চারিত। হওয়া উচিতও তাই-ই। কিন্তু সাধারণভাবে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত নয়। জনগণের হতে হলে পুলিশকে জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। ঢাকার বাইরের কথা বাদ দিলাম, খোদ রাজধানীতেই গত কিছুদিনে যেসব ঘটনার স্বাক্ষী সাধারণ মানুষ, তাতে খুব দ্রুত এই বাহিনীর ভেতর একটি শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন বলেই মনে হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খখলা বাহিনী হিসেব পুলিশ সদস্যরা আইনের পথে হাঁটবেন, কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না, এটা প্রত্যাশিত। মাঠপর্যায়ের পুলিশের নিয়োগ থেকে শুরু করে তাদের আচরণ বড় প্রশ্নের মুখে আজ। অসাধু পুলিশ সদস্যদের দাপট বাড়ছে এমন করে যে, তারা অপরাধ দমনের পরিবর্তে নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পোশাক পরে এবং সাদা পোশাকে দু’ভাবেই জনগণকে হয়রানির কথা আমরা শুনছি। পুলিশের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করলেই তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য, ছিনতাই চুরির মামলার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের ঘটনা আকছার ঘটে চলেছে। কয়টিইবা গণমাধ্যমে আসছে?
পুলিশের এমন অপকর্মের খবর যেটুকু আসে তারপর শোনা যায় শুধু ক্লোজ করা বা প্রত্যাহারের খবর। স্বচ্ছতার অভাব এমনই যে, জনগণ আর জানতে পারে না কার কি সাজা হলো বা আদৌ হয়েছে কিনা। পুলিশ সপ্তাহে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাহিনীর সদসদের পুরষ্কৃত করার রেওয়াজ আমরা জানি। কিন্তু জনধারণা পাল্টাতে এমন দিনে কত জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার জানান দেয়াটাও জরুরি।
মানুষ মনে করে পুলিশের অপরাধ এবং অপরাধী পুলিশকে কঠোরভাবে দমন করা হয় না। ফলে পুলিশের ভাবমূর্তি অনুজ্জ্বলই থেকে যায় আজীবন। পুলিশের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। কিন্তু আরো প্রয়োজন তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের প্রশিক্ষণ। মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে জনসেবা দেয়া যায় না। পুলিশের নানা সীমাবদ্ধতার কথা আমরা জানি। পর্যাপ্ত যানবাহন নেই, জনবল সঙ্কটও আছে। কিন্তু মানবাধিকার আর মানবিক দিকগুলোও এমন অবহেলিত হতে থাকলে জনবল, অস্ত্র, যানবাহন দিয়ে আধুনিকায়ন করেও ধারণা পাল্টাবে না, পুলিশও জনগণের হয়ে উঠতে পারবে না।
এইচআর/এমএস