ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মৌলবাদ নিয়ে হতাশা বাড়ছে পাকিস্তানে

ফারাজী আজমল হোসেন | প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ৩০ আগস্ট ২০২২

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে যখন সাফল্যের জন্য প্রশংসা কুড়াচ্ছে বাংলাদেশ। ঠিক সে সময় ধর্মের মোড়কে সব ব্যর্থতাকে ঢাকতে চাইছে পাকিস্তান। কিন্তু দিন দিন দেশটিতে প্রকট হচ্ছে মানুষের সমস্যা। পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাটাই এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই। পাকিস্তান সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা আর মানুষের হতাশার চিত্রটি ফুটে উঠেছে সেখানকার জনপ্রিয় গণমাধ্যম ডনে প্রকাশিত এক কলামে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুহাম্মদ আমির রানার এই কলামে পাকিস্তানে গণতন্ত্র বিপন্নতার ছবি আরও স্পষ্ট হয়েছে।

গত ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। দেশের স্বাধীনতা দিবস পালনে নাচ-গানের অনুষ্ঠান নিয়ে আপত্তি তুলেছে মৌলবাদীরা। তাদের সমালোচনা হজম করতে হয়েছে পাকিস্তান সরকারকেও। ডনের মতে, এধরনের মামুলি বিষয়েও মৌলবাদীদের আপত্তি দেশকে বিপথে চালিত করছে। মৌলবাদীরা স্বাধীনতা দিবস পালনের অনুষ্ঠানকেও পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থি বলার সাহস দেখাতে পারছে। তাদের মতে, স্বাধীনতা দিবস উদযাপনও নাকি আপত্তিজনক!

ডন পত্রিকায় লেখা হয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। মৌলবাদীদেরও রয়েছে সেই স্বাধীনতা। তবে স্বাধীনতা দিবসের মতো জাতীয় অনুষ্ঠান ঘিরে মৌলবাদীদের এধরনের সমালোচনা দেশের জাতীয় চরিত্রের পরিপন্থি। শুধু রাজনীতি বা সামাজিক ক্ষেত্রেই নয়, দেশের জাতীয় সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও এই মাওলানারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে স্পষ্ট জানিয়েছে ডন। এক্ষেত্রে সরকারি প্রশ্রয়েরও সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও পাকিস্তান এধরনের দ্বিধাবিভক্তি থেকে বের হতে পারেনি।

সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অরাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে দাবি করেও সর্বদা বল প্রয়োগ এবং সরকারের ওপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় চাপ প্রদান করে যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম নামে মৌলবাদী এই গোষ্ঠী।

ডনে প্রকাশিত কলামে আমির রানার মতে, পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকরা ধর্ম মেনেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে চান। কিন্তু সরকার এবং মৌলবাদীরা এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। ধর্ম ক্ষমতাবানদের হাতের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাকিস্তানের জাতিসত্তাকে দাবিয়ে রাখার কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে ধর্মীয় আবেগ এবং অনুশাসন। পাকিস্তানিদের জাতীয় পরিচয়ও আজ এই মৌলবাদীদের হাতের পুতুল হয়ে উঠেছে।

নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা প্রায়ই ধর্মকে হাতিয়ার করেন। কর্তৃত্ববাদীরা ধর্মকে বর্ম করে ক্ষমতা ভোগ করেন, মানছে পাকিস্তানি গণমাধ্যমটি। তবে একই সঙ্গে লেখা হয়েছে, ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পাকিস্তানি সমাজ অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত এবং দেশ আজ গভীর সংকটের মুখে।

একদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সূচক যেমন নিম্নগামী, অন্যদিকে ঊর্ধ্বমুখী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জৌলুস। ডন পত্রিকার মতে, এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের যুব সমাজ। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের যুবকরা ধারাবাহিক উন্নতি করে চললেও পাকিস্তানি যুবকদের সামনে তেমন আশার ঝিলিকটুকুও নেই। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও পাকিস্তানে বাস্তবে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই।

আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক সূচকে পাকিস্তানের স্থান এখন ১২৩ নম্বরে। তালেবান জঙ্গিবাদীদের শাসনাধীন আফগানিস্তানের থেকে তারা মাত্র দুই পয়েন্ট ওপর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফ্রিডম হাউজ’র সর্বশেষ জরিপ বলছে, পাকিস্তান গণতন্ত্রের প্রশ্নে দুনিয়ার খারাপ ৩৭টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি। রাজনৈতিক এবং মৌলিক অধিকার সেখানে অনিশ্চিত। ওয়াশিংটনের ‘ফান্ড ফর পিস’ সংস্থাটিও পাকিস্তানের সার্বিক অবনমনের দিকটি তুলে ধরেছে। ডন এসব রিপোর্টকে তুলে ধরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটিতে জনসংখ্যার চাপের পাশাপাশি ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাবানদের স্বার্থপরতার কারণে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের শোচনীয় পরিস্থিতির কথাও উল্লেখ করা হয়।

ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির সময় মাতৃভূমির যে এমন করুণ দশা হবে সেটা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা বা তাদের সমর্থকরা কেউই দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। এই সংকট থেকে বের হওয়ার রাস্তাও দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। বাড়ছে হতাশা। ক্ষমতাবান এবং ধর্মীয় নেতারা সব সুবিধা ভোগ করলেও সাধারণ মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ। তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে।

ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রবৃত্তির মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের ‘সমন্বিত’ রাখার সহজ উপায় বেছে নিয়েছেন উচ্চবিত্তরা। শিক্ষা ব্যবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে শিক্ষিত যুবকদেরও যুক্তিবাদের প্রতি আস্থা নেই। ধর্মকে কাজে লাগিয়ে চলছে কিছু লোকের অবাধ লুটপাট। ফলে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে থাকলেও বিত্তশালীরা আরও ধনী হয়ে উঠছেন।

তাই ‘পাক ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ’র জরিপে প্রকাশিত, শিক্ষিত যুবকদেরও বড় অংশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপরিচালনার বিরোধী। তাদের মতে, সামরিক শাসন অনেক ভালো ছিল। একনায়কতন্ত্রকে গোটা দুনিয়া ঘৃণা করলেও পাকিস্তানি যুবকরা ব্যতিক্রম। পাকিস্তানি পত্রিকাটির মতে, দেশের সব প্রতিষ্ঠানই ব্যর্থ। তাদের জন্যই যুবকরাও আজ বিপথে চালিত। ডনের মতে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে সব প্রতিষ্ঠানই দেশের এই সংকট থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। কিন্তু বাস্তব ছবিটা ঠিক উল্টো।

চলতি মাসেও পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উঠে এসেছে দেশটির ক্রমাগত অবক্ষয়ের কথা। বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষজ্ঞরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পক্ষে সওয়াল করছেন। ভূ-কৌশলগত পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারা শিক্ষা থেকে প্রশাসন সবকিছুতেই সংস্কার চাইছেন। কিন্তু তাদের মূল্যবান পরামর্শগুলো কে শুনবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ডন।

পাকিস্তানের এই ঘোরতর বিপদের সময় সবার মধ্যে সমন্বয় জরুরি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সংকটমোচনের পথ খুঁজতে হবে। কিন্তু প্রশ্নটা উঠছে বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা কে বাঁধবে? আর কেনই বা বাঁধবে? সিনেটর রাজা রাব্বানিও সামরিক ও অসামরিক শক্তির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরেই আলোচনা জরুরি বলে চর্চা চলছে বলে ডন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটির লেখক আমির রানাও মন্তব্য করেছেন। তবে একই সঙ্গে তার প্রশ্ন, ‘কিন্তু কেন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান (সেনা ও মৌলবাদী শক্তি) দুর্বল প্রতিষ্ঠানের (নির্বাচিত সরকার) সাথে সমান শর্তে কথা বলবে? বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন পরাধীন থাকতেই খুশি?’

পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশা ব্যক্ত করেও ডন লিখছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক মৌলিক কাঠামো এবং সংসদকে শক্তিশালী করার জন্য সংলাপ শুরু করতেই হবে। মৌলবাদীদের হাত থেকে মুক্তি পেতে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও চাইছেন নেতারা উদ্যোগী হয়ে ধ্বংসের হাত থেকে দেশটি রক্ষা করুন। ডনের প্রতিবেদনটিতে ইমরান খান, মিয়া নওয়াজ শরিফ, বিলাওয়াল ভুট্টো, আসিফ আলি জারদারিদের কাছে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

ডনের সাফ কথা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অপরিহার্য। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজেরও জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য একটি সনদ প্রয়োজন। নিজেদের জন্যই একটি মধ্যপন্থি ও গ্রহণযোগ্য সনদ জরুরি। দুর্বলরাও যাতে পাকিস্তানে নিরাপদ বোধ করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার পাশাপাশি ধর্মের অপব্যবহারও বন্ধ করতে হবে। সামরিক ও ধর্মীয় শক্তির হাত থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত করার কথা বলা হয়েছে ডনের প্রতিবেদনে।

 

ডন পত্রিকার এই বিশ্লেষণে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের আর্তনাদই প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। কারণ মৌলবাদী শক্তি, সেনা কর্তা এবং কিছু ক্ষমতাবানের আস্ফালনে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন পাকিস্তানে এখন চরম সংকটাপন্ন। ধর্মের নামে মানুষকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে চরম দুর্ভোগের দিকে। তারা মুক্তি চাইছেন। কিন্তু সেই মুক্তির পথও দাবিয়ে রাখা হয়েছে ধর্মীয় ও সামরিক শক্তি দিয়ে। আশার কথা, তাদের সেই দুর্দশার ছবি কিছুটা হলেও ফুটে উঠতে শুরু করেছে পাকিস্তানি গণমাধ্যমে।

পাকিস্তানের স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে যেই উপলব্ধি, তা থেকে হাজার পথ দূরে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। মৌলবাদী রাষ্ট্র কাঠামো একটি দেশকে কোনদিকে ধাবিত করে তার সবচাইতে বড় উদাহরণ পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান। বিশ্বের বুকে শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চায় শীর্ষে থাকা এই দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচাইতে বাজে অবস্থা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের। কেননা তারা নিজেদের মৌলবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।

ইরানে মৌলবাদের উত্থান শেষে তা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। কিন্তু আফগানিস্তানের তালেবান এবং পাকিস্তানের লস্কর-এ-তৈয়েব বা এ ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মোকাবিলায় কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয়। শত শত মানুষকে হত্যার দায় যেই জঙ্গি নেতাদের ওপর, তারা ৫-১০ বছরের সাজা পায় দেশটিতে। জেলে বসেও চলে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও পরিকল্পনা। এ কারণেই বলছি বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকে হাজার ক্রোশ দূরে রয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশেও সম্প্রতি মাথাচাড়া দিয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো। স্বতন্ত্রভাবে বড় সমাবেশসহ লুটপাট, ভাঙচুর ও হামলার মাধ্যমে তারা নিজেদের পেশিশক্তি প্রদর্শন করছে। রাষ্ট্রকে অকার্যকর করতে তারা হঠাৎ করে হামলা চালাচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা সংস্কৃতি ও সংখ্যালঘুদের ওপর।

পাকিস্তান জন্মের পর যেভাবে মৌলবাদীরা গুটি গুটি পায়ে ছোট ছোট দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, তাদের মতো করেই এদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোও অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর সব দফা উত্থাপন করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের মাধ্যমে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু তার সেই অর্জনকে ম্লান করে দিতে এক হেফাজতে ইসলামই কী যথেষ্ট নয়?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন