ইমরান খানের খুঁটির জোর কোথায়?
‘হার কার জিতনেওয়ালে কো বাজিগর কেহতে হ্যায়’। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যেন সেই বাজিগর হতে চান পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। খেলোয়াড়ি জীবনে ল্যাংড়া ঘোড়া দিয়েও বাজিমাত করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী এই অধিনায়ক শেষ বল পর্যন্ত হাল ছাড়তে নারাজ। রাজনীতির ময়দানেও সেই উন্মাদনা বহাল আছে। অন্ধকারেও আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে লড়াইয়ের ডাক দিতে তাই পিছপা হন না।
নজিরবিহীন জোট গড়ে পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে নওয়াজের মুসলিম লীগ, পিপিপিসহ বিরোধীরা। ধারণা করা হয়, পর্দার আড়ালে এই জোটের নেতা দেশটির সেনাবাহিনী। তাদের পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা। যদিও দেশি-বিদেশি এই শক্তি একসময় ইমরানকে অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির রেওয়াজ ভেঙে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চেয়েছিলেন ইমরান খান।
যাতে কখনও ওআইসির বিকল্প মালয়েশিয়া, তুরস্ক নেতৃত্বাধীন জোটে তার উপস্থিতির দেখা মেলে। সৌদির ধমক খেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেও এই তৎপরতা ছাড়েননি তিনি। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ভয় উপেক্ষা করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর সময়ে মস্কো সফর করেন ইমরান খান, যা তার পতনকে ত্বরান্বিত করে।
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে চির শত্রু ও চির বন্ধু বলে কিছু নেই। সবই জাতীয় স্বার্থের নিরিখে বিবেচিত হয়। সেই পররাষ্ট্র নীতিই নিতে চেয়েছিলেন ইমরান খান। চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারত যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ঠিক রেখেই রাশিয়ার সঙ্গে দেনা পাওনার হিসাব মেলায়। তখন পাকিস্তান বসে থাকবে কেন। বিশেষ করে রাশিয়ার অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা S-400 কিনেছে ভারত, যা প্রতিরক্ষা শক্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে কিছুটা পেছনে ফেলে দিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন বলয়ের বাইরে যাওয়ার এই পররাষ্ট্র নীতি ইমরান খানকে যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল করেছে। যার ফল ক্ষমতাচ্যুত তিনি। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র তো নন ইমরান। সভা-সমাবেশ আর মার্কিনবিরোধী কথনে বর্তমান পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীকে ব্যাপক চাপে রেখেছেন তিনি। তার ওপরও পাল্টা চাপ তৈরি করা হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইনসহ একাধিক মামলা রুজু হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলে কারাগারে রয়েছেন পিটিআই নেতা শাহবাজ গিল। অভিযোগ রয়েছে রিমান্ডে তাকে মারধরও করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইমরান খানের এমন বিদ্রোহের খুঁটির জোর কোথায়? পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রধান বিদেশি শক্তি যুক্তরাষ্ট্র তার বিপক্ষে আর দেশটির অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি সেনাবাহিনীরও তিনি বিরাগভাজন। জবাব অনুসন্ধানে এই মুহূর্তে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে দেশটি। ধার-কর্জ, খয়রাত করেও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে পারছে না।
তিন মাসে আমদানি খরচের জন্য ন্যূনতম ১৭ বিলিয়ন ডলার দরকার হয় পাকিস্তানের। সেখানে ৭-৮ বিলিয়ন ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশি ঋণ ১৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। জুলাই মাসে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ২৫ শতাংশ, যা ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এক ডলার কিনতে ২১৮ রুপির বেশি দিতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের লাগামহীন দামে দিশেহারা মানুষ। ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে বিশ্বে পরমাণু শক্তিধর দেশটির ভাবমূর্তি তলানিতে।
মোটা দাগে বলতে হয়, অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে পাকিস্তান। ৭৫ বছরের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকেই হাতিয়ার বানিয়েছেন ইমরান খান। মার্কিনিরা যতই তার বিপক্ষে থাক, ইমরানকে যদি বেনজির ভুট্টোর মতো হত্যা করা হয় বা তার দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন পীড়ন চলে সেক্ষেত্রে ইউটার্ন নিতে সময় নেবে না যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমারাও হাঁটবে একই পথে। ফলে ইমরানকে গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না তারা।
দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে নিজের একটি বলিষ্ঠ ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন খান সাহেব, যা তার জনপ্রিয়তা শিখরে নিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বও তিনি। পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যার এক ঝলকের দেখা মিলেছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের ছেলেকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ইমরানের মনোনীত ব্যক্তি। ধারণা করা হচ্ছে, পাকিস্তানে এই মুহূর্তে পার্লামেন্ট নির্বাচন হলে নিরঙ্কুশ সংখাগরিষ্ঠতা পাবে ইমরান খানের পিটিআই।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস